আকাশে কোন ফাটল নেই এর মানে আকাশ কঠিন ?

প্রশ্নঃ আকাশে কোন ফাটল নেই এর মানে আকাশ কঠিন ?
আমাদের পেইজে লাইক দিয়ে রাখুনঃ https://bit.ly/2VVS44A
জবাবঃ
নাস্তিকদের একটি অন্যতম অভিযোগ হচ্ছে আকাশে ফাটল নিয়ে অর্থাৎ আল্লাহ কুরআনে বলেছেন আকাশে নাকি ফাটল নাই । এই আয়াতকে কেন্দ্র করে দুটি অভিযোগ তোলা হয় সেই দুটি অভিযোগ হলঃ
⦁ আকাশে ফাটল নাই কিন্তু ব্ল্যাকহোল হচ্ছে আকাশের মাঝের একটা ফাটল
⦁ আকাশে যেহেতু ফাটল নাই এই কথা থেকে বুঝা যাচ্ছে যে , আকাশকে কঠিন হিসেবে বলা হচ্ছে
আল্লাহ সুরা কাফ এর ৬ নাম্বার আয়াতে বলে দিয়েছেন যে ,
⦁ أَفَلَمْ يَنْظُرُوا إِلَى السَّمَاءِ فَوْقَهُمْ كَيْفَ بَنَيْنَاهَا وَزَيَّنَّاهَا وَمَا لَهَا مِنْ فُرُوجٍ
⦁ তারা কি তাদের উপরে আসমানের দিকে তাকায় না, কিভাবে আমি তা বানিয়েছি এবং তা সুশোভিত করেছি? আর তাতে কোন ফাটল নেই। [1]
এখন এই আয়াতে ব্যাবহার করা ( فُرُوجٍ ) এই শব্দের একাধিক অর্থ বিদ্যমান তাও এই অর্থভেদে বিশ্লেষণ ছাড়াও কুরআন কে ভুল প্রমাণিত করা যাবেনা । প্রথমত আমাদের আগে জানতে হবে ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণ বিবর আসলে কি ।
কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাক হোল মহাবিশ্বের অস্তিত্ব ও প্রকৃতি বিষয়ক একটি বহুল প্রচলিত ধারণা। এই ধারণা অনুযায়ী কৃষ্ণগহ্বর মহাবিশ্বের এমন একটি বস্তু যা এত ঘন সন্নিবিষ্ট বা অতি ক্ষুদ্র আয়তনে এর ভর এত বেশি যে এর মহাকর্ষীয় শক্তি কোন কিছুকেই তার ভিতর থেকে বের হতে দেয় না, এমনকি তড়িৎচুম্বকীয় বিকিরণকেও (যেমন: আলো) নয়। এখানে একটু খেয়াল করুন উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে ব্ল্যাক হোল কোন ফাটল না এটি একটি বস্তু । বিপুল পরিমাণ ভর বিশিষ্ট কোন বস্তু , যার মহাকর্ষের প্রভাবে আলোক তরঙ্গ পর্যন্ত পালাতে পারে না- এ ধারণা সর্বপ্রথম প্রদান করেন ভূতত্ত্ববিদ জন মিচেল (John Michell)। তাঁর লেখা একটি চিঠিতে ১৭৮৩ সালে তিনি রয়েল সোসাইটির সদস্য এবং বিজ্ঞানী হেনরি ক্যাভেন্ডিসকে (Henry Cavendish) এ সম্পর্কে জানান।
১৭৯৬ সালে গণিতবিদ পিয়েরে সিমন ল্যাপলেস একই মতবাদ প্রদান করেন তাঁর Exposition du système du Monde বইয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় সংস্করণে । ভূতত্ত্ববিদ জন মিচেল (John Michell) এর কথা অনুযায়ী এটি একটি বিপুল পরিমাণ ভর বিশিষ্ট কোন বস্তু । তাহলে ব্ল্যাক হোল কি ? এটা কিভাবে গঠিত হয় ? সাধারণত কোনো একটি নক্ষত্র চুপসে গেলে ব্লাক হোলে পরিণত হয়। তবে নক্ষত্রগুলোর ভর হয় অনেক। আমাদের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র সূর্যের বিস্তৃতি প্রায় 1300000000 km এবং এর ভর প্রায় 2×10^30 kg এর কাছাকাছি । অর্থাৎ নক্ষত্র চুপসে গেলে সেটা ব্ল্যাক হোলে পরিণত হয় । কোন ফাটল ব্ল্যাক হোলের সৃষ্টি করেনা । [2]
এখন প্রশ্ন হচ্ছে কুরআনে ফাটল দিয়ে কি বুঝানো হচ্ছে ? তাহলে আকাশকে কঠিন পদার্থ সাব্যস্ত করা হচ্ছে ? না কুরআনে বলা হয়েছে ফাটল নেই । ফাটল নেই বলেই এটি কঠিন বস্তু নয় । যদি ফাটল থাকতো তাহলেই এটি কঠিন বস্তু হতে কেননা ফাটল শুধু কঠিন বস্তুর মধ্যেই হয়ে থাকে । তরল কিংবা বায়বীয় পদার্থে না । আর আআশ বা মহাকাশ যেহেতু কঠিন বস্তু নয় তাই এটিতে ফাটল ও নেই । সিম্পল একটা বিশ্লেষণ এখন আরেকটি প্রশ্ন জাগতে পারে যে , তাহলে এই আয়াত দিয়ে কি বুঝানো হচ্ছে ? তাহলে এই আয়াতের তাফসির পড়লেই বুঝা যাবে তাফসিরে আহসানুল বায়ানে বলা হচ্ছে ,
⦁ তারা কি তাদের উপরিস্থিত আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে না যে, আমি কিভাবে ওটা নির্মাণ করেছি ও তাকে সুশোভিত করেছি এবং ওতে কোন ফাটলও নেই?
এখানে ফাটল বা ( فُرُوجٍ ) এই শব্দটিকে তাফসিরে আহসানুল বায়ান সহ আরও অনেক স্কলার ত্রুটি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন [3]।
এরপর কুরআনের আরেক আয়াতে বলা হচ্ছে ,
⦁ الَّذِي خَلَقَ سَبْعَ سَمَاوَاتٍ طِبَاقًا ۖ مَا تَرَىٰ فِي خَلْقِ الرَّحْمَٰنِ مِنْ تَفَاوُتٍ ۖ فَارْجِعِ الْبَصَرَ هَلْ تَرَىٰ مِنْ فُطُورٍثُمَّ ارْجِعِ الْبَصَرَ كَرَّتَيْنِ يَنْقَلِبْ إِلَيْكَ الْبَصَرُ خَاسِئًا وَهُوَ حَسِيرٌ
⦁ ‘‘তিনি সৃষ্টি করেছেন স্তরে স্তরে সপ্তাকাশ। দয়াময় আল্লাহর সৃষ্টিতে তুমি কোন খুঁত দেখতে পাবে না; আবার তাকিয়ে দেখ, কোন ত্রুটি দেখতে পাচ্ছ কি? অতঃপর তুমি বারবার দৃষ্টি ফিরাও, সেই দৃষ্টি ব্যর্থ ও ক্লান্ত হয়ে তোমার দিকে ফিরে আসবে।’’ (সূরা মুলক ৩-৪ আয়াত) [4]
অর্থাৎ আল্লাহ যা সৃষ্টি করেছেন তার মধ্যে কোন খুঁত নেই । তিনি সবকিছু নিখুঁতভাবে সৃষ্টি করেছেন । এখন এই নিখুঁত সৃষ্টি নিয়ে অনেকে নেশ গলাবাজি করে এই বলে যে , এখানে নাকি আকাশকে কঠিন হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে । কিন্তু ব্যাপারটা কি তাই ? মোটেও না । আকাশ মূলত বেশ কয়েক স্তরে গঠিত সেগুলো হলঃ ট্রপোস্ফিয়ার (Troposphere) , স্ট্রেটোস্ফিয়ার (Stratosphere) , ওজোন স্তর ( Ozone Layer ) , মেসোস্ফিয়ার (Mesosphere) , থার্মোস্ফিয়ার(Thermosphere আয়নোস্ফিয়ার(Ionosphere) , এক্সোস্ফিয়ার( Exosphere) । এইসকল স্তর নানাভাবে পৃথিবীকে রক্ষা করছে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে । বলে রাখা ভালো বলে নেয়া ভালো যে , পৃথিবী থেকে উপরে যা কিছু আছে সবই আকাশের অন্তর্গত । এর মধ্যে বায়ুমন্ডল এবং তার বাহিরে যা কিছু আছে সেগুলোও হচ্ছে আকাশের একটি অংশ ( সূত্রঃ উইকিপিডিয়া ) ।
যেমন ওজোন স্তর হচ্ছে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের একটি স্তর যেখানে তুলনামূলকভাবে বেশি মাত্রায় ওজোন গ্যাস থাকে। এই স্তর থাকে প্রধানতঃ স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের নিচের অংশে, যা ভূপৃষ্ঠ থেকে কমবেশি ২০-৩০ কি:মি: উপরে অবস্থিত । বায়ুমণ্ডলে ওজোনের প্রায় ৯০ শতাংশ স্ট্রাটোস্ফিয়ারের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ওজোনস্তরে ওজোনের ঘনত্ব খুবই কম হলেও জীবনের জন্যে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সূর্য থেকে আগত ক্ষতিকর অতিবেগুনী রশ্মি এটি শোষণ করে নেয়। ওজোন স্তর সূর্যের ক্ষতিকর মধ্যম মাত্রার(তরঙ্গদৈর্ঘ্যের) শতকরা ৯৭-৯৯ অংশই শোষণ করে নেয়, যা কিনা ভূ-পৃষ্ঠে অবস্থানরত উদ্ভাসিত জীবনসমূহের সমূহ ক্ষতিসাধন করতে সক্ষম।
এখন আকাশের এই অংশটি পরিপূর্ণ নিখুঁতভাবে আছে বিধায় এইসকল উপকার আমরা পাচ্ছি যদি এই অংশটি অনিখুঁত ভাবে তৈরি থাকতো তাহলে কি হত ? বাতাসে অতিবেগুনী রশ্মি- ‘বি’ (UV-B)-এর পরিমাণ বৃদ্ধি পেত, মৃত পচনশীল জৈব পদার্থ থেকে বর্দ্ধিত পরিমাণ কার্বন মনোক্সাইড ও নাইট্রোজেন অক্সাইডস উৎপন্ন হয়ে থাকে। ভূপৃষ্ঠের নিকটবর্তী ওজোন গ্যাস এবং কার্বন মনোক্সাইড এসিড রেইন (এসিড বৃষ্টি) সৃষ্টি করে। এসিড রেইন জীব কোষের ক্ষতিসাধন করে। অতিবেগুনী রশ্মি (Ultra violet rays)(UV rays) গুলোর মধ্যে, অতিবেগুনী রশ্মি- ‘সি’(UV-C) ওজোন স্তরে সম্পূর্ণভাবে শোষিত হয়, অতিবেগুনী রশ্মি- ‘বি’ (UV-B) এর মাত্র ৫% ভূপৃষ্ঠে পৌঁছে এবং অতিবেগুনী রশ্মি- ‘এ’ (UV-A) এর ৯৫% ভাগই বায়ুমণ্ডলের স্তরসমূহ ভেদ করে ভূপৃষ্ঠে পৌঁছতে পারে। অতিবেগুনী আলোকরশ্মি (Ultra violet rays)(UV rays) গুলো গাছপালা, তরুলতা, প্রাণি, অনুপ্রাণি সকলের উপরই ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।
বিশেষজ্ঞদের মতে., ওজোন স্তর ক্ষয়ের ফলে সূর্যের অতি বেগুনী রশ্মি পৃথিবীতে এসে পৃথিবীকে মাত্রাতিরিক্ত উত্তপ্ত করবে। ফলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে, নিম্নভূমি প্লাবিত হবে, পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাবে, আকস্মিক বন্যা, নদী ভাঙন, খরা, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস প্রকট হবে। মানুষের ত্বকের ক্যান্সার ও অন্ধত্ব বৃদ্ধি পাবে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাবে। উদ্ভিদের জীবকোষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, সমুদ্রে প্রাণীর সংখ্যা কমে যাবে, ফাইটোপ্লাংকটন উৎপাদন কমে যাবে। এতে ( Eco System ) মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে ।
অর্থাৎ আমরা দেখতেই পাচ্ছি যে , কিরকম ভয়ংকর পরিস্থিতি বিরাজ করতো । এরপরে আসি পৃথিবীকে ঘিরে থাকা আকাশের সবচেয়ে নিকটবর্তী বলয়ে রয়েছে বায়ুমণ্ডল। সেই বায়ু মণ্ডল (Atmosphere)-এ চারটি স্তর রয়েছে যা তাপমাত্রার পরিবর্তন দ্বারা পৃথক। এই স্তরগুলো হচ্ছে— ট্রপোস্ফিয়ার, স্ট্রাটোস্ফিয়ার, মেসোস্ফিয়ার ও থার্মোস্ফিয়ার। ওজোন স্তরের পাশাপাশি এইসকল স্তরের কাজের বর্ণনা দেখে নেই , ট্রোপোস্ফিয়ার এর কারণে আল্লাহর ইচ্ছায় আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটে নাহলে আবহাওয়া একই থাকতো যার কারণে জীবজগতে অনেক সমস্যা দেখা দিত । মেসোস্ফিয়ার অধিকাংশ উল্কা (Meteors) এখানে ভস্ম হয়। অর্থাৎ এই স্তর উল্কাপিন্ডকে ভস্ম করে দেয়
অর্থাৎ আকাশের এইসকল অংশ যদি অনিখুঁতভাবে থাকতো তাহলে কি হত ? এর উত্তর হচ্ছে পৃথিবী উল্কাপিন্ড দিয়ে ধ্বংস হয়ে যেত । আবহাওয়া সবসময় একই থাকতো ফলে ফসল উৎপাদনে অনেক সমস্যা দেখা দিত । তাপমাত্রা অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যেত । রাতের বেলা অতিরিক্ত তাপমাত্রা পৃথিবীর বাহিরে চলে যেতে পারতো না ফলে পৃথিবী অত্যন্ত উত্তপ্ত হয় পরতো । আজ যদি এইসমস্ত স্তর বা আকাশের অংশগুলো নিখুঁতভাবে না থাকতো অথবা ত্রুটিপূর্ণ অবস্থায় থাকতো অর্থাৎ উল্কা ভস্ম , আবহাওয়া পরিবর্তন , তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রন , অতি বেগুনি রশ্মি থেকে রক্ষা করতে সম্পূর্ণ সক্ষম না থাকতো অথবা অপারগ থাকতো তাহলে পৃথিবীর অবস্থা কি হত সেটা খানিকটা অনুমান লাগালেই বুঝা যায় আর এই জন্যই আল্লাহ বলেছেন ,
⦁ ‘‘তিনি সৃষ্টি করেছেন স্তরে স্তরে সপ্তাকাশ। দয়াময় আল্লাহর সৃষ্টিতে তুমি কোন খুঁত দেখতে পাবে না; আবার তাকিয়ে দেখ, কোন ত্রুটি দেখতে পাচ্ছ কি? অতঃপর তুমি বারবার দৃষ্টি ফিরাও, সেই দৃষ্টি ব্যর্থ ও ক্লান্ত হয়ে তোমার দিকে ফিরে আসবে।’’ (সূরা মুলক ৩-৪ আয়াত)
আশা করি উত্তর পেয়ছেন ।
তথ্যসূত্রঃ
1. সুরা কাফ আয়াত ৬
2. Wikipedia - কৃষ্ণ বিবর
3. তাফসিরে আহসানুল বায়ান / সুরা কাফ আয়াত ৬
4. সূরা মুলক ৩-৪ আয়াত


No comments

Note: Only a member of this blog may post a comment.

Powered by Blogger.