সংশয়বাদীর প্রশ্নের জবাব । আরিফ আজাদ ।


আরিফ আজাদ
কিছুদিন আগে একজন পাঠক আমাকে একটি মেইল পাঠিয়েছিলেন উনার পাঠানো মেইলে আমার জন্য বেশকিছু প্রশ্ন ছিলো ভদ্রলোক কোন নাস্তিক বা এগনোস্টিক টাইপ কিছু নন কেবল কিছু ব্যাপার তিনি বুঝে উঠতে পারছিলেন না বলেই আমাকে লিখেছেন বলে জানালেন
যাহোক, ভদ্রলোককে কথা দিয়েছিলাম সময় করে উনাকে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো কিন্তু মাঝখানে রমজান, নিজের অসুস্থতা, রোহিঙ্গাদের নিয়ে কিছু কাজে লেগে পড়ায় আর উত্তর করা সম্ভবপর হয়ে উঠেনি

উনার করা প্রশ্নগুলোর প্রতিটি বিস্তারিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের দাবি রাখে সবগুলো প্রশ্নের উত্তর একসাথে দেওয়াও সম্ভব না ভাবলাম, একটি একটি দেওয়া যাক

উনার প্রথম প্রশ্ন ছিলো এরকম,- ‘সূরা বাকারার শুরুর দিকে ফেরেস্তাদের সাথে আল্লাহর কথোপকথনের কিছু অংশ আমরা দেখতে পাই সেখানে দেখা যায়, ফেরেস্তা এবং হজরত আদম (আঃ) এর মধ্যে একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়
দেখা যায়, আল্লাহ প্রথমে আদম (আঃ) কে সব জিনিসের নাম শিখিয়ে দেন এরপর জিনিসগুলো ফেরেস্তাদের কাছে ধরে সেগুলোর নাম জিজ্ঞেস করেন ফেরেস্তারা বলতে পারেনা ফেরেস্তারা ব্যর্থ হলে আল্লাহ তা'লা আদম (আঃ) এর কাছে সেগুলোর নাম জানতে চান দেখা গেলো, ফেরেস্তারা না পারলেও, আদম (আঃ) সব জিনিসের নাম ঠিকঠাক বলতে পেরেছেন'
এমতাবস্থায়, উনার প্রশ্ন হচ্ছে- আল্লাহ কী এখানে পক্ষপাতিত্ব করলেন না? উনি জিনিসের নাম শিখালেন আদম (আঃ) কে, অথচ পরীক্ষা নিলেন ফেরেস্তাদের কাছ থেকেও যেহেতু ফেরেস্তাদের সেসব জিনিসের নাম শেখানো হয়নি, সেহেতু তারা তার উত্তর দিতে পারার কথা নয় আদম (আঃ) কে আগে শিখিয়ে দিয়ে বিজয়ী করে দেওয়াটা কী ফেরেস্তাদের সাথে অন্যায় করা হলো না?

খুবই সুন্দর প্রশ্ন এটি আমরা প্রথমে আয়াতগুলো দেখি, এরপর আলোচনায় আসা যাবে...

[আল বাকারা- ৩০]

স্মরণ কর, তোমার প্রতিপালক যখন ফেরেশতাদেরকে বললেন, ‘আমি যমীনে প্রতিনিধি সৃষ্টি করছি’; তারা বলল, ‘আপনি কি সেখানে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন যে অশান্তি করবে ও রক্তপাত ঘটাবে? আমরাই তো আপনার প্রশংসামূলক স্তুতিগান ও পবিত্রতা ঘোষণা করি তিনি বললেন, ‘আমি যা জানি, তোমরা তা জান না

আল বাকারা- ৩১]

এবং তিনি আদম (আঃ) কে সকল বস্তুর নাম শিক্ষা দিলেন, তারপর সেগুলো ফেরেশতাদের সামনে উপস্থাপন করলেন এবং বললেন, ‘এ বস্তুগুলোর নাম আমাকে বলে দাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হও

আল বাকারা-৩২]

তারা বলল, ‘আপনি পবিত্র মহান, আপনি আমাদেরকে যা শিক্ষা দিয়েছেন, তাছাড়া আমাদের কোন জ্ঞানই নেই, নিশ্চয়ই আপনি সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়

আল বাকারা-৩৩]

তিনি নির্দেশ করলেন, ‘হে আদম! এ জিনিসগুলোর নাম তাদেরকে জানিয়ে দাও যখন সে এ সকল নাম তাদেরকে বলে দিল, তখন তিনি বললেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের অদৃশ্য বস্তু সম্পর্কে আমি নিশ্চিতভাবে অবহিত এবং তোমরা যা প্রকাশ কর ও গোপন কর, আমি তাও অবগত’?

আয়াতগুলো থেকে আপাতঃ বোঝা যায় যে, আসলেই এখানে মনে হয় ফেরেস্তাদের সাথে একটু অন্যায় করা হয়েছে (নাউজুবিল্লাহ)
কারণ, জিনিসের নাম শেখালো আদম (আঃ) কে, কিন্তু পরীক্ষাটা নেওয়া হলো ফেরেস্তাদের থেকেও সমানভাবে দ্যাট'স নট ফেয়ার!

কিন্তু, এই আয়াত আমরা পড়তে গিয়ে জেনারেলি ভুল ভেবে বসি বা বুঝে উঠতে পারিনা, কারণ- আমরা ফেরেস্তাদের মেকানিজম সম্পর্কে জানি না
ফেরেস্তাদের মেকানিজম হচ্ছে- তারা আল্লাহর বিশেষ একটি সৃষ্টি তাদের মধ্যে কোন স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি নেই তারা শুধু ততোটুক জানতে পারে, যতোটুকু জানার পারমিশান বা এখতিয়ার তাদের আছে এর বাইরে বিন্দুমাত্র কিছুও তারা জানতে পারেনা বা বুঝতে পারে না
ব্যাপারটা আরো খোলাসা করার জন্য আমরা রোবটের কথা চিন্তা করতে পারি একটা রোবটের মধ্যে ঠিক যেরকম প্রোগ্রাম সেট করা থাকে, রোবটটি ঠিক সেরকম কাজই করতে পারে এর বাইরে নতুন বা ভিন্ন কিছু করার ক্ষমতা একটি রোবটের থাকে না
ফেরেস্তাদের ক্ষেত্রেও ঠিক এরকম তাদের ঠিক ততোটুকুই জানার আর বোঝার অধিকার, যতোটুকু জানার বা বোঝার পারমিশান তাদের আছে
ইবাদাতের ক্ষেত্রে ফেরেস্তাদের স্থান অবশ্যই মানুষের চেয়ে অনেক উঁচুতে কিন্তু জ্ঞানের ক্ষেত্রে মানুষের স্থান ফেরেস্তাদের চাইতে উঁচুতে
এবং, ইসলামে ইবাদাতের আগে জ্ঞানটাকেই বেশি প্রায়োরিটি দেওয়া হয় এজন্য সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ, ফেরেস্তা নয় কারণ, জ্ঞানের ক্ষেত্রে মানুষ ফেরেস্তার চেয়ে এগিয়ে এজন্যই কোরআনের প্রথম শব্দ 'আক্বীমুছ সালাত' নয়, কোরআনের প্রথম শব্দই হলো 'ইক্বরা'....
প্রথমেই পড়ার কথা, নামাজ বা ইবাদাতের কথা নয়...

যাহোক, মূল আলোচনায় আসি
এখানে কী আল্লাহ ফেরেস্তাদের সাথে কোন অন্যায় করেছেন? কোন পক্ষপাত?
উত্তর হচ্ছে- একদম না
এটা মূলত আমাদের বোঝার ভুল
সূরা বাকারার ৩০-৩৩ নম্বর আয়াতগুলোতে আরেকবার নজর দিন দেখুন, সেখানে পৃথিবীতে খলিফা হিসেবে আদম (আঃ) কে সৃষ্টির কথোপকথন থেকে শুরু করে ফেরেস্তাদের কর্তৃক আদম (আঃ) কে সিজদা দেওয়ার ঘটনা পর্যন্ত, সবকিছুই কিন্তু ওপেন হচ্ছে অন্য দ্য স্পটে আল্লাহ তা'লা, ফেরেস্তা এবং আদম (আঃ) সবাই কিন্তু উপস্থিত
এমতাবস্থায়, আল্লাহ কিন্তু আদম (আঃ) কে জিনিসের নামগুলো গোপনে শিক্ষা দেন নি ফেরেস্তাদের সামনেই শিখিয়ে দিয়েছেন কিন্তু ব্যাপার হচ্ছে, ফেরেস্তাদের মেকানিজমে সেই নামগুলো ক্যাচ করার মতো এবং স্মৃতিতে ধারণ করার মতো কোন প্রোগ্রাম সেট করা নেই কিন্তু আদম (আঃ) কে ঠিক সেই মেকানিজমে তৈরি করা হয়েছে ফলে, ফেরেস্তারা শুনেও ক্যাচ করতে পারেনি বা স্মৃতিতে ধারণ করে রাখতে পারেনিকিন্তু আদম (আঃ) পেরেছিলেন এই কারণে আদম (আঃ) অনন্য....
আল্লাহ তা'লা ফেরেস্তাদের সামনে ঠিক এই পার্থক্য রেখাটি টেনে দেওয়ার জন্যই এমনটি করেছেন
উনি বোঝালেন- 'দেখো, তোমাদের মেকানিজমের চেয়ে আদমের মেকানিজম আলাদা তোমরা যা এইমাত্র শুনেও স্মৃতিতে ধারণ করতে পারলে না, আদম তা পারলো সুতরাং, আমার সৃষ্টির মধ্যে আদম তোমাদের চেয়ে সেরা'

ফেরেস্তাদের যে নির্দিষ্ট বিষয়ের বাইরে জানার অধিকার বা ক্ষমতা নেই, তা তাদের জবানেই ফুটে উঠেছে ৩২ নাম্বার আয়াতে, যখন তারা বললো- ‘তারা বললো, ‘আপনি পবিত্র! মহান! আপনি আমাদেরকে যা শিক্ষা দিয়েছেন, তাছাড়া আমাদের আর কোন জ্ঞানই নেই

অর্থাৎ, তাদের মেকানিজম অনুযায়ী তারা তাদের মধ্যে সেট করা প্রোগ্রামের বাইরের কিছুই জানতে পারবে না আদম (আঃ) কে যে নামগুলো শেখানো হচ্ছিলো ওপেনলি, সেসব ফেরেস্তারা শুনেও বুঝতে পারেনি, এবং স্মৃতিতে ধারণ করতে পারেনি এটাই হচ্ছে ফেরেস্তা এবং আদম (আঃ) এর মধ্যে পার্থক্য আর এটা প্রমাণ করে হাতে কলমে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্যই এই পরীক্ষার ব্যবস্থা...
এতে করে কোনভাবেই এটা বোঝার সুযোগ নেই যে, আল্লাহ ফেরেস্তাদের সাথে অন্যায় করেছেন বা পক্ষপাতিত্ব করেছেন
বরং আসল ব্যাপার এটাই যে, আল্লাহ ফেরেস্তাদেরকে তাদের লেভেলটা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন এটার মাধ্যমে...

এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে মুফতি তাক্বী উসমানির 'তাফসীরে তাওযীহুল কোরআন' এবং মাওলানা মওদুদীর 'তাফহিমুল কোরআন' দেখতে পারেন

Allah knows best....

No comments

Note: Only a member of this blog may post a comment.

Powered by Blogger.