অপ্রমাণ্যের প্রমাণ

#সত্যকথন_১২১
[১]
সকাল সকাল আবু বকরের (রদিআল্লাহু আ’নহু) কাছে উপস্থিত হয়েছে কিছু লোক। কী যেন শুনতে এসেছে তারা। চোখে মুখে উন্নাসিকতা আর উচ্ছ্বাস।
“তোমার বন্ধু সম্পর্কে এখন কী বলবে হে আবু বকর!? তিনি তো এখন দাবি করছেন - তিনি নাকি গতরাতে বায়তুল মুকাদ্দাস গিয়েছিলেন, সেখানে নাকি ইবাদাত করেছেন, আবার একরাতের মধ্যেই মক্কায় ফিরে এসেছেন।”
আবু বকর (রদিআল্লাহু আ’নহু) ভাবলেন স্বভাবসুলভ মিথ্যাচারই হয়তো করছে কুরাঈশরা। “তোমরা আমাকে আগে বল তিনি কি সত্যিই একথা বলেছেন কিনা?” কুরাঈশ লোকগুলো হ্যাঁসূচক উত্তর দিল। “তিনি তো এখনও লোকেদের কাছে এই কাহিনী বর্ণনা করছেন।”
আবু বকর (রদিআল্লাহু আ’নহু) বললেন, “আল্লাহর কসম! যদি তিনি ﷺ একথা বলে থাকেন, তবে তিনি সত্য বলছেন। আর এতে এত্ত আশ্চর্য্যের কী আছে? তিনি যখন বলেন যে তাঁর কাছে আসমান থেকে ওহী নাযিল হয়, একজন ফেরেশতা তা তাঁর কাছে নিয়ে আসেন আমি তো সেসব কথায় বিশ্বাস করি; আর সেগুলোতো তোমাদের এখনকার বর্ণনার চেয়েও বিস্ময়কর!”
[২]
মানুষ প্রমাণ খুঁজে, প্রমাণের উপযুক্ততা নিয়ে প্রশ্ন তুলে শত আলোচনা করে জ্ঞান জাহির করে ছাড়ে। গবেষণা আর বিজ্ঞানচর্চার এই যুগে প্রমাণগুলো আজ বৈজ্ঞানিক হয়ে উঠেছে। কিন্তু প্রমাণ চাই করতে করতে মানুষ যে গুরুত্বপূর্ণ একটি বাস্তবতা ভুলে যায় তা হল প্রমাণ ছাড়াই অনেক অপ্রমাণ্য বিষয়াদি সে বাস্তবজীবনে অনায়াসে স্বীকার করে নেয়, বিশ্বাস করে নেয় এমনসব অপ্রমাণ্য বিষয়াদি যা বিজ্ঞান দিয়ে প্রমাণ করা যায় না।
দর্শন ও যুক্তিবিদ্যাগত সত্য [Philosophical & Logical Truths] : বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক বা Theoretical বিষয়গুলো যুক্তি ও গণিতের উপর নির্ভর করে প্রমাণ করা হয় আর বিজ্ঞান যেসব দর্শন ও যুক্তিবিদ্যার উপর টিকে রয়েছে সেগুলো বিজ্ঞান দিয়ে প্রমাণ করা যায় না। যেমনঃ একইসাথে একটি বিষয় সত্য আবার মিথ্যা হতে পারে না – এই যুক্তিটির উপর ভিত্তি করে অনেকসময়ই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হয়। অথচ ‘একইসাথে একটি বিষয় সত্য আবার মিথ্যা হতে পারে না’ এই যুক্তিটির নিজেরই কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ দেওয়া যায় না। এটা কেবলই উপলব্ধির বিষয়। তেমনি দর্শন ও যুক্তিবিদ্যাগত অন্যান্য সমস্ত সত্যগুলোই অপ্রমাণ্য, কেবল উপলব্ধির বিষয়। ‘পৃথিবীর সমস্ত আপেল লাল’ – এই বাক্য সত্য হলে ইকবাল সাহেবের কেনা আপেলটি যে লালই হবে তার আলাদা কোনো প্রমাণ দিতে হয় না। কারণ দর্শনগত ও যুক্তিগত ধারণাগুলো বিজ্ঞান প্রথমেই সত্য ধরে নিয়েই সামনে এগোয়, তাই সেগুলো আবার প্রমাণ করতে গেলে চক্রাকারে তর্ক ছাড়া আর কিছুই হবে না (argument in a circle).
আর গাণিতিক সত্যগুলোও (Mathematical Truths) দর্শনগত ও যুক্তিগত সত্যের আরেকটি রূপমাত্র। যেমনঃ যেকোনো ভাষাতেই ‘এক’ এর পর ‘দুই’ সংখ্যাটাই আসে বা এক এক যোগ করলে ‘দুই’ ই হয় – এমনসব অতিসাধারণ গাণিতিক সত্যগুলোও বিজ্ঞান দিয়ে প্রমাণ করা যায় না, কেবল প্রয়োগে দেখানো যায় মাত্র। আর যেহেতু সকল পর্যবেক্ষণই অতীত হয়ে যায়, তাই পরবর্তী ১+১=২ হবে তা কেউ অস্বীকার করলে তাকে ভুল প্রমাণ করবার কোনো উপায় নেই। কিন্তু তবুও এগুলো কেউ অস্বীকার করে না, কোনোরকম প্রমাণ ছাড়াই আমরা মেনে নিই যে পরবর্তী ১+১=২ ই হবে।
অধিবিদ্যাগত / অবস্তুগত সত্য [Metaphysical Truths] : আমাদের এই জগতটা আসলে কোনো কম্পিউটার সিম্যুলেটর বা কারও স্বপ্ন নয়, বরং বাস্তবজগত আর যেসবকিছু হচ্ছে তা বাস্তবিকই হচ্ছে, ১০ মিনিট আগে যে ঘটনাটা অতীত হয়েছে তা সত্যিই ঘটেছে, নিজ স্বত্বা বা ‘আমি’ এর অনুভূতি, অন্যান্য মানুষের স্বত্বার বা মনের অস্তিত্ব ইত্যাদি সত্যগুলো এর অন্তর্ভূক্ত আর বিজ্ঞানের আওতারই বাহিরে। কোনোরকম প্রমাণ ছাড়াই আমরা এই জগতের বাস্তবতা, অতীতের বাস্তবতা, নিজ ও অপরাপর স্বত্বার অস্তিত্ব ইত্যাদি Metaphysical ব্যাপারগুলো দিব্যি মেনে নিই।
মানবিকতা ও নৈতিকতা [Morals & Ethics] : মানবিকতা ও নৈতিকতাকে কখনো বিজ্ঞান দিয়ে প্রমাণ করা বা মাপা যায় না। নাৎসি বিজ্ঞানীরা যে গ্যাস চেম্বারে মানুষ হত্যায় মেতে উঠতো, হিংস্র সব গবেষণায় মেতে উঠতো সেগুলো যে নীতিবিবর্জিত, অমানবিক ছিল তা বিজ্ঞান দিয়ে প্রমাণ করা সম্ভব নয়। এছাড়া ধর্ষণ, অযাচার ইত্যাদির মত নৈতিকতা বিবর্জিত কার্যকলাপের কোনো বৈজ্ঞানিক সদুত্তর নেই। বিজ্ঞান এগুলোর খারাপ প্রভাব দেখাতে পারে মাত্র। কিন্তু এগুলো অপরাধ কিনা সেই প্রশ্নে বিজ্ঞান নীরব।
ধর্মীয় বিশ্বাস আর বিধিবিধানে মুক্তচিন্তার দাবিদারেরা বিজ্ঞান টেনে আনলেও ধর্ষণ, সমকামীতার মত বিষয়াদিতে ঠিকই ‘মানবিকতা’ আমদানি করে, তখন তাদের বিজ্ঞান পালিয়ে বেড়ায়। বাস্তবতা বিবর্জিত হয়ে যারা LGBT rights বা সমকামিতা সমর্থন করে আর ‘ভালবাসা যে কারও মধ্যে হতে পারে’, ‘এটা ব্যতিক্রম তবে অস্বাভাবিক কিছু না’ এধরনের ফালতু বাহানা দাঁড় করায়, তাদের বেশিরভাগও অযাচার বা Incest কে অনৈতিক মনে করে; তখন তাদের ওইসব গাঁজাখুরি যুক্তি আর দেখা যায় না। আবার কিছু কুলাঙ্গার স্রষ্টাকে অস্বীকার করে বিজ্ঞানকে রব্বের আসনে বসায়। কিন্তু বিজ্ঞান নৈতিকতার প্রশ্নে অচল হওয়ায় ওই কুলাঙ্গাররাও রক্তসম্পর্কের অযাচারকে অনৈতিক প্রমাণ করতে পারে না; তবুও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এদেরকে যদি বলা হয় নিজ স্ত্রীকে নিজ ছেলের সাথে অযাচার করতে দেবে কিনা - তখন এদেরও নৈতিকতা উথলে উঠে। আর সর্বশেষ শ্রেণীর যেসব চূড়ান্ত কুলাঙ্গাররা সমকামীতা ছাড়াও নিজ বাবা-মা, ছেলেমেয়েদের সাথেও এমন অযাচারের বৈধতা দিয়ে দেয়, সেই কুলাঙ্গারদের ব্যাপারে বোঝাই যায় যে এরা আসলে সমাজে কী প্রতিষ্ঠা করতে চায়... এককথায় চূড়ান্ত মাত্রার ব্যাভিচার ও অরাজকতা – ঠিক যেমনটা শয়তান চায়।
নৈতিকতা এবং এর থেকে উৎসরিত অপরাধবিজ্ঞান গড়েই উঠেছে ধর্মীয় অনুশাসনগুলোকে কেন্দ্র করে। কেননা, কারও ইচ্ছা হলেই কোনোকিছু করে ফেলতে পারবে কিনা - এমন সমস্ত বিষয়াদি শেষমেশ নৈতিকতার প্রশ্নে এসে দাঁড়ায় যা বিজ্ঞানের আওতার বাহিরে। আর মানুষভেদে যেহেতু নৈতিকতার মূল্যায়ন ভিন্ন, তাই যে কেউ দাবি করতেই পারে যে সে আরেকজনের নির্ধারণ করে দেওয়া নৈতিকতার স্কেলে চলবে কেন – তাই এক্ষেত্রেও সবচেয়ে যৌক্তিক হল সৃষ্টিকর্তা নির্ধারিত সার্বজনীন নৈতিকতা মেনে নেওয়া। তাছাড়া, সৃষ্টিকর্তাই বিধান প্রদান ও নৈতিকতার স্কেল নির্ধারণের সবচেয়ে বেশি হকদার ও একচ্ছত্র অধিকারী। তানাহলে যে যা খুশি তাই করতে চাওয়ার অধিকার দিতে দিতে একসময় সভ্যতার পতন নিশ্চিত হয়; একারণেই আধুনিক Individualism, Secularism তথা সেক্যুলার ব্যবস্থা ক্রমান্বয়ে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যায়। আর সমস্ত অধঃপতনের সূত্রপাত হয় সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর নির্ধারিত নৈতিকতা ও অনুশাসন ছুঁড়ে ফেলে বিজ্ঞান দিয়ে সবকিছু ব্যাখ্যা করার চেষ্টায় মেতে উঠে।
একটি বাস্তব উদাহরণ হল, আমেরিকায় ৩০ – ৪০ বছর আগে সমকামিতাকে অপরাধ আর মানসিক ত্রুটিরূপে দেখা হলেও এখন সেখানে এটা বৈধ করা হয়ে গেছে। এছাড়া বিশ্বের কিছু জায়গায় Incest Marriage এরও বৈধতা রয়েছে! আবার কিছু জায়গায় রীতিমত উলঙ্গ ঘোরাফিরার অধিকারের জন্য আন্দোলনও চলে। আর বলাই বাহুল্য, সভ্যবেশী অসভ্যদের দেশে মানুষ উলঙ্গ চলাফেরার নাকি নির্ধারিত বহু বীচ রয়েছে! আর এসমস্তকিছুর শুরু হয়েছে স্রষ্টাকে অস্বীকার করে, তাঁর নির্ধারিত নৈতিকতাকে অস্বীকার করে বিজ্ঞান দিয়ে সবকিছু ব্যাখ্যা করার চেষ্টার পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে। কারণ ওই যে, বিজ্ঞানে ‘নৈতিকতা’ প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই!
শিল্পকলা ও নান্দনিকতা [Aesthetic and literature] : শিল্পকলার মূল্য বিজ্ঞান দিয়ে প্রমাণ করা যায় না। সৃজনশীলতা, সৌন্দর্য্যবোধ বিষয়গুলো বিজ্ঞানের আওতার বাহিরে আর তাই শিল্পসাহিত্যও বিজ্ঞান দ্বারা মাপা যায় না। সেকারণে পাথরের ভাস্কর্য যত নিখুঁতই হোক না কেন, বিজ্ঞানের হিসাবে তার মূল্য কেজিদরে অন্যান্য পাথরের মতই। তেমনি চিত্রকর্ম, সাহিত্যকর্ম বাস্তবে যতই সৃজনশীল ও নান্দনিক হোক না কেন সেগুলোর সবই বিজ্ঞানের হিসাবে রীতিমত মূল্যহীন। কারণ শিল্পসাহিত্য বিজ্ঞান দ্বারা অপ্রমাণ্য।
দেশীয় কলাবিজ্ঞানীরা আল্লাহকে অবিশ্বাসের জন্য এত বিজ্ঞান কপচায়, অথচ শিল্পকলারই যে কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই তা তাদের মনে থাকে না। এছাড়া শিল্পবোধে আসক্তি বেশিরভাগ সময়েই নগ্নতায় গিয়ে ঠেকে। প্রাচীন গ্রিক ভাস্কর্য থেকে উপমাহাদেশীয় প্রাচীন মূর্তি, চিত্রকর্ম, সাহিত্য সবকিছু সেই সাক্ষ্যই বহন করে। কামনা বাসনাকে নির্জীব এসব শিল্পমাধ্যমে ধারণ করা মূলত Objectophilia নামক বিকারগ্রস্থতার প্রায়োগিক রূপ। শিল্পচর্চাকারীদের বেশিরভাগই এই মানসিক বিকারগ্রস্থতায় আক্রান্ত হয়ে যায় আর নিজেদের সাহিত্যে-শিল্পকর্মে নগ্নতা, বিকৃত যৌনাচার ইত্যাদির প্রকাশ ঘটায়। চিত্রকর ছবিতে এগুলো ফুটিয়ে তোলে, সাহিত্যিক নিজের গল্প-কবিতা-উপন্যাসের কল্পিত চরিত্রদের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলে আর ভাস্কর ফুটিয়ে তোলে ভাস্কর্যে। শিল্পের আধুনিক রূপ সিনেমা, গান ইত্যাদিতেও শিল্পের নামে বেহায়াপনা, অশ্লীলতার প্রসার হয়। শিল্পের নামে ওদের কাছে সবই চলে।
কিন্তু ইসলামী অনুশাসন কখনও এরকম বেহায়াপনা, অশ্লীলতা, অবাধ যৌনাচার বা এমনকিছু হওয়ার সুযোগ রয়েছে তেমন বেশিরভাগ মাধ্যমগুলোরই বৈধতা দেয় না, বৈধতা দেয় না কোনোটিরই লাগামহীনতার। সেকারণেই যুগে যুগে কলাচর্চাকারীদের এত বিদ্বেষ। এককথায় তারা শিল্পের নামে যা খুশি করার স্বাধীনতা চায়। অর্থাৎ, তারা সেক্যুলারিজমই চায় ‘শিল্প’ নামক মুখোশের আড়ালে। একারণেই দেখা যায় - যেই শিল্পসাহিত্য সচেতন সেই সেক্যুলার। আবার যে সেক্যুলার, সেও শিল্পসাহিত্যের প্রতি অনুরাগী।
চৈতন্যবোধ [Conscience / Consciousness] : নিজস্ব অনুভূতি বা চৈতন্যবোধ কখনও বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। বিজ্ঞান কখনোই বলতে পারে না ভালবাসার, ঘৃণার, রাগ-অভিমান করার বা বিশ্বাসঘাতকতার স্বীকার হবার অনুভূতি কেমন। স্ক্যান করে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় কিন্তু অনুভূতিগুলো আসলে কেমন তা জানা যায় না।
এছাড়াও অনুভূতি-অভিজ্ঞতা হয় একান্তই নিজস্ব ও ব্যক্তিভেদে একেকরকম। বিশ্বাস, ভালবাসা ইত্যাদি ছাড়াও সমুদ্রের পাড়ে সূর্যাস্ত দেখার অনুভূতি কেমন, ঝর্ণার মৃদু শব্দ শোনার অনুভূতি কেমন এসব থেকে শুরু করে সাধারণ লাল রং দেখার অনুভূতিটিও আসলে একজনের নিকট কেমন তা বিজ্ঞান তো দূরের কথা, ২য় আরেকজনও বলতে পারে না। এমনকি ২য় জনকেও হুবহু একই বিষয়াদি দেখানো-শোনানো হলেও। চেতনা, অনুভূতি, অভিজ্ঞতার একান্তই ব্যক্তিগত হওয়ার এই ব্যাপারটিকে Qualia বলা হয়ে থাকে।
[৩]
বিজ্ঞান দ্বারা এত এত অপ্রমাণ্য বিষয়াদি জানার পর কিছু বিষয় লক্ষণীয়।
প্রথমত, অনেকে বিজ্ঞানকে সব সমস্যার সমাধান মনে করে, মনে করে বিজ্ঞান হল Omnipotent. অথচ দর্শন, যুক্তি, মানবিকতা-নৈতিকতা ইত্যাদি বিষয়াদি যে বিজ্ঞান দিয়ে অপ্রমাণ্য তা তাদের মাথায় আসে না। তাছাড়াও ‘বিজ্ঞান দিয়ে সব ব্যাখ্যা করা যায়’ বা ‘বিজ্ঞান হল Omnipotent’ অথবা ‘বিজ্ঞান একসময় ঠিকই উত্তর খুঁজে বের করবে’ এই কথাগুলোও স্রেফ দর্শনগত উক্তি বা বিশ্বাসমাত্র। এই কথাগুলোরও কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই! এগুলোও বিজ্ঞানের প্রতি অন্ধবিশ্বাস – একে বলা হয় Scientism যা কিনা Neo-Atheism এর ভিত্তি।
দ্বিতীয়ত, বিজ্ঞান আসলে কী? পর্যবেক্ষণ, গবেষণা, যুক্তিতর্ক, দর্শন ইত্যাদির মাধ্যমে জগত সম্বন্ধে জানবার পদ্ধতিগত উপায়ই হল বিজ্ঞান। সাধারণত বিজ্ঞান দুই উপায়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছায় – Deductive reasoning আর Inductive Reasoning. Deductive reasoning এর মাধ্যমে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য কিছু দর্শন, যুক্তিতর্ককে সত্য ধরে নিয়ে শেষমেশ সিদ্ধান্তে আসা হয়। আর Inductive Reasoning এ পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্তে আসা হয়। প্রথমটিতে যে কেবলই উপলব্ধি ও দর্শনগত কিছু সত্যকে মেনে নিয়েই সামনে আগানো হয় তা আগেই আলোচিত হয়েছে। আর ২য় উপায়ে অর্থাৎ, Inductive Reasoning এ পরবর্তী পর্যবেক্ষণ সবসময়ই ভিন্ন ফলাফল দেখাতে পারে। তাছাড়া আরেকজনের পর্যবেক্ষণ করে আসা সিদ্ধান্ত যে আসলেও সত্য - সেটা মেনে নিয়ে আমরা মূলত সিস্টেম নির্গত ‘বিজ্ঞানী’ দাবিদারদেরকে বিশ্বাস করে যাই। কেবল বিশ্বাস করতে পারি না ৪০ বছর ধরে ‘আল-আমীন’ বা বিশ্বাসী মানুষটি সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে শেষ নবুওয়্যাতের দাবি নিয়ে এলে, এক রাতের মধ্যে ইসরা-মিরাজের দাবি নিয়ে এলে। আর লেখাপড়া না জেনেও কুরআনের মত অশ্রুতপূর্ব বাণী নিয়ে এলে।
তৃতীয়ত, বিজ্ঞান বিভিন্ন বিষয়াদির ব্যাখ্যাস্বরূপ অনেক তত্ত্ব দাঁড় করায়। আর অনেকসময়ই সেসব তত্ত্ব পর্যবেক্ষণেরও অযোগ্য হলেও মানুষ তাতে ‘বিশ্বাস’ করে, স্রেফ সিস্টেম নির্গত ‘বিজ্ঞানীরা’ বিশ্বাস করেন বলে। যেমনঃ Multiverse Theory তে অনেক বিজ্ঞানীই বিশ্বাসী, অথচ সবাই জানে যে এই মহাবিশ্বের বাহিরে কোনোকিছু পর্যবেক্ষণও সম্ভব নয়। এখন স্রষ্টাও পর্যবেক্ষণ আওতামুক্ত, আবার অন্য মহাবিশ্বও পর্যবেক্ষণ আওতার বাহিরে। তাহলে কেন শেষমেশ থিউরিই বেছে নেওয়া! যেন স্রষ্টাকে অবিশ্বাসের জন্যই এতসব নাটক। তানাহলে যে বস্তুবাদী হওয়া যায় না, করা যায় না যা খুশি তা।
চতুর্থত, তাত্ত্বিক বিষয়াদি ছাড়াও মাপামাপিসহ অন্যান্য প্র্যাকটিকাল ক্ষেত্রের মূল বিষয়গুলোও আমরা কোন ধরনের প্রমাণ ছাড়া মেনে নিই। এখানকার মূল বিষয়গুলো হল এককগুলো। যেমনঃ এক মিটার আসলে কতটুকু? কেন এতটুকুই হল? কেন সামান্য বেশি বা সামান্য কম হল না – এই প্রশ্নগুলো আমরা কেউ করি না। কারণ এই ধরনের বিষয় মেনে না নিয়ে তর্ক করা আসলে অযথা কালক্ষেপণের খারাপ নিয়্যাতকেই নির্দেশ করে। অথচ একই জিনিস যে আল্লাহর দেওয়া বিধিবিধানগুলোর জন্যও প্রযোজ্য তা নাস্তিক আর সংশয়বাদীদের খেয়াল থাকে না। এই বিধান এমন কেন হল, ওইটা অমন কেন হল, কেন ওটা এইরকম হল না – এমন সমস্ত প্রশ্ন নাস্তিক, সংশয়বাদী আর সম ঘরানার প্রাণিরা তাই কেবল দুইটা কারণে করে থাকতে পারে। এক, তাদের বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তি লোপ পেয়েছে অথবা দুই, কেবল অবিশ্বাসের জন্য তারা ভন্ডামি বা Hypocrisy-তে মেতেছে।
পঞ্চমত, বিজ্ঞানের একটি শাখা Quantum Physics এর অনেক বিষয়ই আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে অনুধাবণ করা গেলেও বিজ্ঞান তার কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারে না। যেমনঃ Quantum Entanglement হল ইলেকট্রনের মত উপপারমাণবিক কণিকাগুলোর এমন এক বিশেষ অবস্থা যখন বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরত্ব হলেও দু’টি কণিকার মধ্যে একরকম যোগাযোগ থাকে। পুরো মহাবিশ্বে এই অবস্থায় কণিকারা বিরাজমান থাকায় পুরো মহাবিশ্ব রীতিমত একটা জীবন্ত দেহের মতো! অথচ এটা পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম সূত্র - মহাবিশ্বে আলোর গতিবেগ সর্বোচ্চ – এর বিপরীত। এর কারণ হিসেবে কোয়ান্টাম কণিকার জগত আর তার ধর্মকে আলাদা বিবেচনা করেই এর নিষ্পত্তি করা হয় কিন্তু বলাই বাহুল্য, অন্যান্য সবকিছুর মত এখানকার ‘কেন’ প্রশ্নেও বিজ্ঞান নীরব।
[৪]
Burden of Proof এর ভুল প্রয়োগ
এত এত কিছু প্রমাণ ছাড়া মেনে নিলেও কেবল স্রষ্টার ক্ষেত্রেই এসে Burden of Proof খোঁজাও আসলে ভান্ডামিই নির্দেশ করে। কিন্তু সেটা বাদ দিলেও ইতিহাসে Burden of Proof এর সবচেয়ে বাজে আর বুদ্ধিহীন প্রয়োগ সৃষ্টিকর্তার ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে, আর সেটা করে যত্তসব বুদ্ধিহীন অথর্বরাই। কারণ Burden of Proof এ by default বা আগে থেকেই ধরে নেওয়া হয় যে কোনো সৃষ্টিকর্তা নেই আর সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব এক নতুন দাবি। আর তাই দাবিকারীকে নিজ দাবির স্বপক্ষে প্রমাণ পেশ করতে হবে। যুক্তি ঠিক আছে তবে এক্ষেত্রে নয় মহাশয়, বরং সৃষ্টির নৈপুণ্য আর সুবিন্যাস থেকেই by default একজন Intelligent Designer / Manufacturer বা এককথায় স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়। ঠিক যেমন এই লিখাটি পড়বার সময় by default একজন লেখকের অস্তিত্ব মন স্বীকার করে নেয়।
ডিএনএ কোডিংয়ের কথাও বাদ। মহাবিশ্বের উৎপত্তি, ছায়াপথ, নক্ষত্রসমূহ থেকে শুরু করে অণু এবং আণবিক কণার মত বস্তুর আকার আকৃতিও সূক্ষাতিসূক্ষ অনেকগুলো মৌলিক ধ্রবকের উপর নির্ভর করে। আর প্রতিটি সংখ্যায় যে পরিমাণ নিখুঁত সমন্বয় করা হয়েছে তা একজন Intelligent Designer কেই নির্দেশ করে। মহাকর্ষ ধ্রুবক যদি ১০^৬০ এর (অর্থাৎ, ১ এর পরে ৬০ টি শূন্য) এক ভাগ বেশি বা কম হতো, তাহলে কোনো ছায়াপথ, গ্রহ নক্ষত্র কিছুই সৃষ্টি হতো না। শুধুমাত্র এই ধ্রুবকের অত সূক্ষ্ম পরিমাণ বিচ্যুতিতেও মহাবিশ্বের সূচনালগ্নেই এর অতিব্যপ্তি হয়ে যেত বা মুহুর্তেই ধীর ব্যপ্তির কারণে পরক্ষণেই গুটিয়ে ধ্বংস হয়ে যেত। আবার, মহাজাগতিক ধ্রুবকের মান ১০^১২০ এর এক ভাগও এদিক সেদিক হলে তা মহাবিশ্ব সম্প্রসারণের হারে একই প্রভাব ফেলে কখনও এ পর্যন্ত আসা তো দূরের কথা, মহাবিশ্ব নিমিষেই ধ্বংস হয়ে যেত। যেসমস্ত বিচ্যুতির কথা বলা হচ্ছে তা যে আসলে কত ক্ষূদ্র তা বুঝতে পৃথিবীতে মোট যতটি বালুকণা রয়েছে তা কল্পনা করা যেতে পারে। এই সংখ্যক বালুকণা দিয়ে যদি একটা ধ্রুবক গঠিত হয়েছে বলে ধরা হয়, তবে পৃথিবীতে আরেকটি বালুকণা যোগ করলে বা একটি সরিয়ে নিলে আর কোনোকিছুরই অস্তিত্ব থাকতো না! প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবক, পারমাণবিক মৌলিক কণিকাগুলোর ভর, হাবল ধ্রুবকসহ আরও বহু ধ্রুবকের এমন নিখুঁত ভারসাম্য বা Fine Tuning একজন বুদ্ধিমান সত্ত্বার দিকেই by default নিয়ে যায়। তাই Burden of Proof আসলে নাস্তিকদের ওপরেই বর্তায়। আমরা সৃষ্টিজগত থেকে স্বভাবজাতভাবেই সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব বুঝি। এটাই হল by default. এখন তোমরা নিজেদের অস্বীকারের প্রমাণ দাও।
নাস্তিক্যবাদী বিজ্ঞানীরা এমন অসম্ভব নিখুঁত বিন্যাসকে স্রষ্টা ছাড়া ব্যখ্যা করার চেষ্টায় Multiverse Theory এনেছে যেখানে মূলত বলা হয় পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলোর যত সম্ভাবনা হওয়া সম্ভব, তার সবগুলো ক্রমান্বয়ে হয়ে চলছে আর আমরা সৌভাগ্যবশত যে মহাবিশ্বটির সবকিছু এক্কেবারে Perfect হয়ে গিয়েছে সেটাতেই রয়েছি। অথচ এই তত্ত্ববিশ্বাস প্রমাণের কোনো উপায় নেই কারণ অন্যকোন মহাবিশ্ব পর্যবেক্ষণই সম্ভব নয়। এই তত্ত্বও যে Burden of Proof এর দাবি রাখে সেকথা আর কেউ বলে না। কেবল সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে অবিশ্বাসের জন্য এই রূপকথায় বিশ্বাস আর প্রচার-প্রসার করে চলে। অথচ না দেখেই আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাসের কথা এলে, আল্লাহর ইচ্ছায় এক রাতে ইসরা-মিরাজ ভ্রমণের কথা এলে এরাই আবার রূপকথা বলে বলে ফ্যানা তোলে।
আগেকার যুগের জ্ঞানীরাও by default স্রষ্টার অস্তিত্বের দিকেই ভিড়তো। তখন কেবল শুধু আজকের মতো সূক্ষ মানসহ জানা ছিল না। নবী ইব্রাহিম (আলাইহিস সালাম) নভোমন্ডোল ও ভূমন্ডলের বৈচিত্র্যময় বিষয়গুলো দেখে চিন্তাভাবনা করে স্রষ্টায় বিশ্বাসে এসে পৌঁছেছিলেন (৬ : ৭৫) , তো অ্যারিস্টটল কল্পনা করেছিল সারাটা জীবন মাটির নিচে কাটিয়ে দেওয়া কিছু মানুষেরা হঠাৎ উপরে উঠে এলে সৃষ্টিবৈচিত্র্য দেখে ঠিকই একজন স্রষ্টায় বিশ্বাসী হয়ে উঠবে। অবশ্য ইবরাহিম (আলাইহিস সালাম) যে আল্লাহরই কাছে আন্তরিকভাবে সাহায্য প্রার্থনাস্বরূপ বলেছিলেন, “যদি আমার প্রতিপালক আমাকে পথ-প্রদর্শন না করেন, তবে অবশ্যই আমি বিভ্রান্ত সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব।” (৬ : ৭৭) এমন সাহায্য চাওয়া অ্যারিস্টটল বা হালের অ্যান্টনি ফ্লিউদের বেলায় শোনা যায় না। অথচ স্রষ্টার অস্তিত্ব অনুধাবনের পর তাঁর কাছে আন্তরিকভাবে সাহায্য প্রার্থনাই হল সর্বপ্রথম দায়িত্ব যা কিনা প্রকৃত মুমিনরা সূরা ফাতিহার মাধ্যমে দিনে কমপক্ষে ১৭ বার করে থাকে।
[৫]
প্রমাণ খোঁজাতে সমস্যা নেই। সমস্যা হল, যাচাইয়ের সৎ মানসিকতা থেকে প্রমাণ না খুঁজে অবিশ্বাস পুষে রেখে কালক্ষেপনের জন্য প্রমাণ চাই, প্রমাণ চাই বলে বেড়ানো। এমন মানুষদের আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিই, অন্তরে সৎ নিয়্যাত রয়েছে নাকি কালক্ষেপনের বা সংশয় সন্দেহে ডুবে থেকে দুনিয়াতে যা খুশি তাই করে বেড়ানোর ধান্দা রয়েছে তা সম্পর্কে আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল।
ইসরা ও মিরাজের রাতের পরদিন সকালে তাই মক্কার কাফিরদের জন্যও কাফেলার প্রমাণ দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তারা বিশ্বাস করে নাই। অথচ আবু বকরও (রদিআল্লাহু আ’নহু) প্রমাণ খুঁজেছিলেন। আর অতঃপর প্রমাণ পাবার পর ঠিকই সাক্ষী দিয়েছিলেন যে মুহাম্মাদ ﷺ সত্য বলছেন। অর্থাৎ, প্রমাণের চেয়েও বড় হল আসলেও আপনি আন্তরিক কিনা। নইলে শতসহস্র প্রমাণেও কোনো ফায়দা হবে না। অবশ্য আল্লাহ রব্বুল আ’লামীনই যে বান্দাদের থেকে গায়েবে বিশ্বাস চান সে অনুযায়ী কোনো প্রমাণই অকাট্য হবে না। আবু বকরের (রাদিআল্লাহু আ’নহু) মত সর্বোত্তম ঈমান না হোক, সামান্য বিশ্বাসের সদিচ্ছা আর আন্তরিকতা ব্যতীত কারও পক্ষেই বিশ্বাস সম্ভাবপর নয়।
“... এরপর আবু বকর (রদিআল্লাহু আ’নহু) সেখান থেকে সোজা রাসুলুল্লাহ ﷺ এর নিকট চলে আসলেন এবং বললেন, “হে আল্লাহর নবী! আপনি কি এদের কাছে বলেছেন যে এই রাতে আপনি বায়তুল মুকাদ্দাস গিয়েছিলেন?”
তিনি ﷺ বললেনঃ হ্যাঁ।
আবু বকর (রদিআল্লাহু আ’নহু) বললেনঃ হে আল্লাহর নবী! সে মসজিদটির বর্ণণা দিন তো; আমি সেখানে গিয়েছিলাম।
তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন যে ঐসময় বায়তুল মুকাদ্দাসকে আমার সামনে তুলে ধরা হল। আমি তার দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম।
এরপর রাসুলুল্লাহ ﷺ আবু বকর (রদিআল্লাহু আ’নহু) এর কাছে বায়তুল মুকাদ্দাসের বর্ণণা দিতে লাগলেন। আর আবু বকর (রদিআল্লাহু আ’নহু) প্রতিবারই বলতে লাগলেন, “আপনি সত্যই বলেছেন। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনি আল্লাহর রাসূল।”
Reference: [১] ও [৫] সীরাতুন্নবী ﷺ ইবন হিশাম (র), ২য় খণ্ড (ইসলামিক ফাউন্ডেশন) পৃষ্ঠা ৭৪
অপ্রমাণ্যের প্রমাণ
লেখকঃ Tanvir Ahmed


No comments

Note: Only a member of this blog may post a comment.

Powered by Blogger.