হিল্লা বিয়েঃ ব্যাখ্যা-অব্যাখ্যার বিভ্রান্তী নিরসন.........?

হিল্লা বিয়েঃ ব্যাখ্যা-অব্যাখ্যার বিভ্রান্তী নিরসন.........?
=====================================
হিল্লা বিবাহ বলতে (আমাদের বাংলাদেশের সমাজে প্রচলিত) আসলে ইসলামে কিছুই নাই। অথচ দেশের আনাচে-কানাচে একটি বর্বর নিয়মের উপর বিবাহ হয়ে থাকে যাকে বলা হয় 'হিল্লা বিবাহ'। অনেকেই হয়ত এ ব্যাপারে কিছু না কিছু জেনে থাকবেন। কারন, গ্রাম বাংলায় এই নির্মম ইসলামী প্রথাটি এখনও এই একবিংশ শতাব্দীতেও বহাল তবিয়তে আছে এবং অনেক পরিবারে অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ব্যাপারটা হচ্ছে এই প্রকার যে,যখন স্বামী তার স্ত্রীকে ইসলামী পন্থায় স্থায়ী অর্থাৎ তিন তালাক দিয়ে দিলো- তারপর সেই স্ত্রী তার ভূতপূর্ব স্বামীর জন্য সম্পূর্ণ হারাম হয়ে যাবে। স্বামী আর কিছুতেই সেই স্ত্রীর সাথে পুনরায় স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবে না। এমনকি সেই স্ত্রীকে বিবাহও করতে পারবে না। তবে এর মাঝে হেরফের আছে। তা হচ্ছে এই যে, ঐ তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে অন্য কোন পুরুষের সাথে বিবাহে বসতে হবে। তারপর তাদের মাঝে যৌন সঙ্গম হতে হবে। এরপর এই দ্বিতীয় অস্থায়ী স্বামী মহিলাটিকে তিন তালাক দিবে। মহিলাটি তিন মাসের ইদ্দত করবে এবং যদি সে গর্ভবতী না হয় তখনই তার ভূতপূর্ব স্বামী তাকে আবার বিবাহ করতে পারবে। যদি মহিলাটি অস্থায়ী স্বামী দ্বারা গর্ভবতী হয়ে পড়ে তবে এ ব্যাপারে ইসলামী কায়দা পালন করতে হবে। অনেক ইসলামীক আলেম নামের বদমাশরা এ ব্যাপারে খুব উৎফুল্লতা প্রকাশ করে এই বলে যেঃ দেখুন ইসলাম কতই না ন্যায় বিচার করছে: এই হিল্লা প্রথা মহিলাকে আরও একটি সুযোগ দিল অন্য স্বামীর ঘর করার। ঐ সব ইসলামীক আলেম নামের বদমাশরা এও বলে যে, এই হিল্লা প্রথার জন্যই পুরুষেরা যত্রতত্র তালাক দেওয়া থেকে বিরত থাকবে। কিন্তু ইসলামীক আলেম নামের বদমাশদের এই সব আবোল তাবোল কতই না হাস্যকর। স্বামী দিল স্ত্রীকে তালাক, কিন্তু তার ভুক্তভোগী স্ত্রীকে কেন আবার বিবাহ করতে হবে এক বেগানা পুরুষকে যদি তার ভূতপূর্ব স্বামী চায় তার পূর্বের স্ত্রীর সাথে একটা সমঝোতা করে নিতে? কিসের বাধা এতে? কেনই বা ভূতপূর্ব স্ত্রীকে আবার যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে অন্য এক পুরুষের সাথে? এটা কি স্ত্রীকে সাজা দেওয়া হল না? এই সাজা তো স্বামীরই পাওয়া উচিত ছিল। কারন, সেই তো তালাক দিয়েছিল। যাই হোক, আমরা এখন দেখব কুরআন ও হাদিস কি বলছে হিল্লা বিবাহ সম্পর্কে।

মহান আল্লাহ্‌ বলেছেনঃ
"তারপর যদি সে স্ত্রীকে (তৃতীয় বার) তালাক দেয়া হয়, তবে সে স্ত্রী যে পর্যন্ত তাকে ছাড়া অপর কোন স্বামীর সাথে বিয়ে করে না নেবে, তার জন্য হালাল নয়। অতঃপর যদি দ্বিতীয় স্বামী তালাক দিয়ে দেয়, তাহলে তাদের উভয়ের জন্যই পরস্পরকে পুনরায় বিয়ে করতে কোন পাপ নেই, যদি আল্লাহ্‌র হুকুম বজায় রাখার ইচ্ছা থাকে। আর এই হল আল্লাহ্‌ কর্তৃক নির্ধারিত সীমা, যারা উপলব্ধি করে তাদের জন্য এসব বর্ণনা করা হয়।"
(সূরা বাকারাঃ আয়াতঃ ২:২৩০)

এখানে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল যে,হিল্লা বিবাহে অস্থায়ী স্বামীর সাথে মহিলাকে যৌন সঙ্গমে লিপ্ত হতেই হবে। তা না হলে এই হিল্লা বিবাহ সহিহ হবে না। যদি নামকা ওয়াস্তে এই হিল্লা বিবাহ, যা সাধারণত: মসজিদের ইমাম অথবা কর্মচারীর সাথে হয়ে থাকে - তবে তা মোটেই সিদ্ধ হবে না। এই আইন যেহেতু কুরআনে লিখিত; তাই বিশ্বের কারও সাধ্য নাই যে এই আইনের রদ বদল করে। এর রদের জন্য দুনিয়ার সমগ্র মুসলিম নারীরা জীবন দিয়ে ফেললেও কারও কিছু করার নেই। এটা হচ্ছে এমনই পরিস্থিতি যেমন হচ্ছে ইসলামী উত্তরাধিকারী আইন। যেমনঃমেয়ে পাবে ছেলের অর্ধেক। এই আইনও চিরকালের - বিশ্বের কোন শক্তি নেই আল্লাহ্‌র এই আইনের পরিবর্তন করতে পারে।

হিল্লা বিবাহের ব্যাপারে দেখা যাক একটি হাদিস।
ইয়াহিয়া মালিক ইবনে সাইদ আল কাশিম ইবনে মুহাম্মদ থেকে।
ইয়াহিয়া বললেন রসুলুল্লাহর (সাঃ)স্ত্রী আয়েশা (রাদিঃ)-কে বলা হলঃ "এক স্বামী তার স্ত্রীকে স্থায়ীভাবে তালাক দিয়েছে। সেই স্ত্রী অন্য এক পুরুষকে বিবাহ করল। সেই পুরুষ মহিলাকে তালাক দিয়ে দিল। মহিলাটির আগের স্বামী তার তালাক দেওয়া স্ত্রীকে পুনরায় বিবাহ করতে পারবে কি না? বিবি আয়েশা উত্তর দিলেন ততক্ষণ হবে না যতক্ষণ না সে মহিলাটি ঐ পুরুষটির সাথে যৌন সঙ্গমের মিষ্টি স্বাদ উপভোগ করেছে।"
(মালিক মুয়াত্তাঃ হাদিস নম্বরঃ ২৮/৭/১৮)

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হিল্লা বিবাহকে শুধু ঘৃনাই করতেন না বরং উভয়কেই লানত করেছেন। তারপরও, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সময় এবং আবু বকর (রাদিঃ)-এর সময় অবধি হিল্লা বিবাহ প্ৰচলিত ছিল। অতঃপর উমর (রাদিঃ) উক্ত প্ৰচলিত হিল্লা বিবাহ বন্ধ করে দেন।
প্রশ্ন হলঃ
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এবং আবু বকর (রাদিঃ)-এর সময় অবধি হিল্লা বিবাহ বন্ধ হল না কেন? উমর (রাদিঃ)-এর সময়ে হিল্লা বিবাহ বন্ধ হল কেন?
হাদিসে এসেছে যেঃ ইবনে মাসউদ (রাদিঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেছেনঃ"রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হিল্লাকারী এবং যার জন্য হিল্লা করা হয় উভয়কে লানত করেছেন।"
ইমাম তিরমিজী (রহিঃ) বলেছেন যে, এই হাদিসটি হাসান সহিহ।
জামে আত তিরমিযীঃ ২য় খন্ড, হাদিস নম্বরঃ ১১২০, হুসাইন আল মাদানী প্রকাশনী।
ইবনে মাজাহতেও আলী (রাদিঃ) হতে বর্ণিত আছে যেঃ
“রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হিল্লাকারী এবং যার জন্য হিল্লা করা হয় উভয়কে লানত ((অভিসম্পাত) করেছেন।”
সুনানে ইবনে মাজাহঃ ২য় খন্ড, হাদিস নম্বরঃ ১৯৩৫; ইসলামিক ফাউন্ডেশন।
হিল্লা সম্পর্কে সাহাবী উকবা বিন আমের (রাদিঃ) থেকে বর্ণিত আছে যেঃ তিনি বলেছেনঃ
“রাসূলুল্লুাহ (সাঃ) বলেছেনঃ আমি কি তোমাদেরকে ভাড়া করা পাঠা সম্পর্কে বলবো? তারা বললোঃ অবশ্যই হে আল্লাহর রাসূল। তিনি বললেনঃ হিল্লাকারী।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ আল্লাহ হিল্লাকারী ও যার জন্য হিল্লা করা হয় উভয়কে অভিসম্পাত করেছেন।"
সুনানে ইবনে মাজাহঃ ২য় খন্ড, হাদিস নম্বরঃ ১৯৩৬; ইসলামিক ফাউন্ডেশন।

এই হল হিল্লা বিবাহের মর্মকথা।
হিল্লা বিবাহের নামে আমাদের সমাজে যা করা হয় তা সবচেয়ে নিকৃষ্ট সামাজিক ব্যাধি এবং কুরআন ও সুন্নাহর অবমাননা। হিল্লা বিবাহের আরও দলিল থাকলে মেহেরবানী করে মন্তব্য করুন।

হিল্লা বিয়ে আসলে নারীর জন্য শাস্তি নয় বরং তার জন্য রহমত। স্ত্রী হিসেবে নারীর যে সম্মান, তালাক তা কমিয়ে দেয়। যে স্বামী কথায় কথায় বা রাগের মাথায় স্ত্রীকে তালাক দিতে পারে, সে মূলত স্ত্রীকে অসম্মানই
করে। এটা অনেকটা এরকম যে, আপনি একটা খেলনার পুতুল দিয়ে ইচ্ছে মতো খেললেন, এরপর যখন মন চায় ভেঙে ফেললেন। স্ত্রী নিশ্চয় খেলনা নন। স্ত্রী হলেন জীবনসঙ্গীনী। জীবন বলতে জীবনের হাসি-কান্না, সুখ-দু:খ, মান-সম্মান সবকিছুরই সাথী স্ত্রী। বিনা অজুহাতে, রাগের মাথায় তাকে তালাক দেয়ার অর্থ তাকে অসম্মান করা। তালাক হলো আল্লাহ তাআলার হালাল করা সর্ব নিকৃষ্ট বিষয়।অর্থাৎ তালাকের অনুমতি দেয়া হয়েছে একমাত্র নিরুপায় অবস্থায়।যে ক্ষেত্রে স্বামী স্ত্রীর কোনো ভাবেই একসঙ্গে থাকা সম্ভব হয় না, তখন
তালাক দেয়া যায়। এই নিকৃষ্ট হালালকে যখন যত্রতত্র ব্যবহার করা হয়, তখন তা ক্ষমতার অপব্যবহার হয়।
স্ত্রী হিসেবে নারীর সম্মান তখন ধুলোয় মিশিয়ে দেয়া হয়।ইসলাম মনে করে নারীর একটা সম্মানজনক জীবন আছে। যে জীবনে বারবার তাকে তালাক শুনতে হবে না,
বরং সম্মানের সাথে সে জীবন যাপন করতে পারবে। এ জন্যই ইসলাম একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক তালাকের অনুমতি
স্বামীকে দিয়েছে। এর অর্থ, স্ত্রীকে সতর্ক করার জন্য স্বামী সর্বোচ্চ তিনবার এই শব্দ ব্যবহার করার অনুমতি পাবে। প্রথম দু’বার ব্যবহারের পর ভুল শুধরে ফিরিয়ে
নেয়ার অবকাশ আছে। কিন্তু তৃতীয়বার আর সেই অবকাশ নেই। দেখুন, এক সঙ্গে তিন তালাক দেয়াকে
রাসূল স. ও তাঁর সাহাবীগণ প্রচন্ড রকম অপছন্দ করতেন। এ জন্য একসঙ্গে তিন তালাককে বিদাতী তালাক বলারহয় ফিকহের পরিভাষায়। মূলত তালাক দেয়ার সুন্নাহ সমর্থিত নিয়ম হলো, একবার কেবল এক তালাক দেয়া। এরপর তিন ঋতু পর্যন্ত অপেক্ষা করা। যদি বনিবনা হয়ে যায়, তাহলে এর মধ্যে ঋতু পরবর্তী পবিত্রতাকালীন সময়ে স্বামী তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে
নিতে পারবে। আর যদি বনিবনা না হয়, তাহলে তিন ঋতু অতিবাহিত হলে বিবাহ ভেঙে যাবে। তবে দেখুন
ইসলামের মাহাত্ম্য..এখন আবার স্বামী-স্ত্রী বিবাহ করতে চাইলে কোনো হিল্লা বিয়ে লাগবে না।স্বামী সরাসরি স্ত্রীকে বিয়ে করে নিতে পারবে।এভাবে আবার প্রয়োজন হলে দ্বিতীয় তালাক দিতে পারবে স্বামী। এরপর আবার তিন ঋতু পর্যন্ত অপেক্ষা করবে।চাইলে ফিরিয়ে নিবে, না ফেরালে বিয়ে ভেঙে যাবে। বিয়ে ভাঙ্গার পর চাইলে হিল্লা বিয়ে ছাড়াই আবার ফিরিয়ে নিতে পারবে। দেখুন, দুই দুই বার তালাক দেয়ার পর হিল্লা বিয়ে ছাড়া ফিরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা ইসলাম রেখেছে।

তালাক মানে কী?
জীবনের এক বড় বন্ধন থেকে মুক্ত করে দেয়া। বন্ধন ভেঙে গেলে বা ভেঙে দিলে তা কয় বার জোড়া লাগতে পারে? একবার?দুইবার? এরপরও যদি এই বন্ধন ভেঙে
দেয়া হয়, তাহলে তা আর জোড়া লাগার অবকাশ রাখে না। জোড়া লাগলেও সে বন্ধনের আর মূল্য থাকে না। তখন তা নিছক বালিকার হাতের পুতুল হয়ে যায়।চাইলে সে তাকে নিয়ে খেলে,চাইলে তা ভেঙে ফেলে।

এজন্য তৃতীয়বার তালাক দেয়ার পর বিয়ে পুরোপুরি ভেঙে যায়। তখন আর তিন ঋতু পর্যন্ত ফিরিয়ে নেয়ার সুযোগ থাকে না। তখন বরং ইসলাম নারীর পক্ষে থাকে। স্বামীর অত্যাচার থেকে সরিয়ে নিতে ইসলাম নারীকে
পছন্দমতো দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করার সুযোগ দেয়। এবং প্রথম স্বামী আবার ফিরিয়ে নিতে চাইলেও তাকে সহজে এ সুযোগ দেয়া হয় না। বরং দ্বিতীয় স্বামী স্বেচ্ছায় তালাক দিলেই কেবল প্রথম স্বামী তাকে গ্রহণ করতে
পারে। এটার নামই হিল্লা বিয়ে।দেখুন, এ বিধান যদি না থাকত,তাহলে প্রতিদিনই স্বামী তার স্ত্রীকে তিন তালাক দিত। কথায় কথায়, রাগের মাথায় সবসময়ই ‘তালাক
তালাক’ বলত। এরপর প্রতিদিনই আবার মায়া করে তাকে স্ত্রী হিসেবে ফিরিয়ে নিত। এভাবে মায়ার এ বন্ধন
আর বন্ধন থাকত না। তা হয়ে যেত খেলার পুতুল।
কোনো নারী নিশ্চয় এতকিছু বোঝার পর ইসলামের এই সুন্দর বিধানকে অসম্মান করবেন না। বরং নিজের সম্মান যদি নারী বুঝেন তাহলে ইসলামের এ বিধান পেয়ে নিজেকে সম্মানিতই মনে করবেন। আল্লাহ আমাদের সত্য বোঝার তাওফীক দিন। আমীন।

এ প্রসঙ্গে কিছু উত্তর মিলিয়ে নিনঃ
।১।স্বামীর অত্যাচারে বা অন্য কোন কারণে স্ত্রীর অপছন্দ থাকলে স্বামীর সাথে খুলা’ ( ﺧﻠﻊ) করার বিধান
ইসলামে আছে। খুলা’ করার নিয়মটা হলো এই যে, স্ত্রী স্বামীকে মোহরানার টাকাটা ফেরৎ দেওয়ার শর্তে কিংবা অন্য কোন অংক দেওয়ার শর্তে স্বামীকর্তৃক বিবাহ বন্ধন ছেদ করিয়ে নিবে। স্বামী-স্ত্রীর সম্মতিক্রমে কৃত এই ব্যাপারটি এক তালাকে বায়েন হিসেবে গণ্য হবে।
পরবর্তীতে উভয়ে পুণরায় একে অপরকে গ্রহণ করতে চাইলে নতুন করে বিবাহ করতে হবে।খুলা’ অর্থ খোলা। এর দ্বারা রূপক অর্থে বিবাহের পরিচ্ছদ খুলে ফেলা
হয় তাই খুলা’ বলা হয়। আবার তালাকের অর্থও এর কাছাকাছি।সম্ভবত এ থেকেই এ দেশের মুসলিম পারিবারিক আইনে স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।কিন্তু মুসলিম পারিবারিক আইনে খুলা-র ভিন্ন অধ্যায় থাকায় এ সম্ভাবনা উড়িয়ে দিতে হচ্ছে। কাজেই খুলা’ছাড়া স্ত্রীকে ভিন্ন ভাবে তালাকের ক্ষমতা দেওয়াকে ‘ইসলাম সম্মত নয়’ বলতেই হচ্ছে।

।২।এখানে বলে নেওয়া ভালো যে, ইসলাম যেমন ভাবে স্ত্রীকে কেবল স্বামীর অত্যাচারের সময় কিংবা একান্ত
বনিবনা না হওয়ার ক্ষেত্রে খুলা’করার অনুমতি দিয়েছে, তেমনি স্বামীকেও স্ত্রীর চূড়ান্ত অবাধ্যতা ও সবরকম চেষ্টার পরও বনিবনা না হওয়ার ক্ষেত্রে তালাক দেওয়ার
অনুমতি দিয়েছে। সাথে সাথে বারবার এ ঘোষণা দিয়ে রেখেছে যে,“আল্লাহর নিকট সর্ব নিকৃষ্ট বৈধ বিধান হলো তালাক।” (হাদীস) কাজেই যত্রতত্র তা ব্যবহার করা
থেকে কঠোর ভাবে নিষেধ করা হয়েছে।

।৩।একটা প্রসঙ্গ প্রায়ই আলোচিত হয় যে,রাগের মাথায় স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক দিয়েছে আর ফতোয়াবাজ
মৌলভীরা স্ত্রীকে হিল্লা বিবাহে বাধ্য করছে। অমানবিক।
মানবতাবিরোধী.. সত্যিই তো.. কিন্তু কথা হচ্ছে, আপনি যদি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন যে,ইসলাম কেন এমন কঠিন নির্দেশ দিয়েছে, তা হলেই এর যথার্থতা যথার্থ ভাবে উপলব্ধি করতে পারবেন। ইসলাম বারবার স্বামীকে সতর্ক করেছে যেন সে তার প্রেয়সী স্ত্রীর
সাথে নূন্যতম খারাপ আচরণ না করে।ঘোষণা দিয়েছে, “তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সে-ই, যে তার স্ত্রীর কাছে
উত্তম।” (হাদীস)
উপদেশ দিয়েছে,“দেখো, যদি তুমি তার (স্ত্রীর) একটি
আচরণে অসন্তুষ্ট হও, তা হলে তার অন্য কোন আচরণ নিশ্চয় তোমাকে মুগ্ধ করবে। ফলে সে দিকে লক্ষ্য করে তারক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখো।” (হাদীসের মর্মার্থ)

এভাবে বারবার বিভিন্ন ভাবে স্বামীকে ভালো আচরণ করার নির্দেশ দিয়ে বলেছে, একান্তই যদি তোমার সাথে
মিল না হয় তবে তাকে বোঝাও।এতেও না হলে একই খাটে আলাদাআলাদা শয়ন করো। এরপর ভিন্ন খাটে
শোও। অতপর ভিন্ন ঘরে… এভাবেও ঠিক না হলে উভয় পরিবারের লোক দিয়ে মিটমাট করার চেষ্টা করো।
এরপর একেবারেই নিরুপায় হলে কেবল এক তালাক দাও। এরপর অপেক্ষা করো এক মাস। এর মধ্যে সব ঠিক হয়ে গেলেরবিনা বিবাহেই তাকে গ্রহণ করতে
পার। নতুবা এক মাস পর আরেক তালাক দাও।এবারো সব ঠিক হয়ে গেলে বিনাবিবাহে তাকে গ্রহণ করে নিতে পার।(তালাকে রাজঈর ক্ষেত্রে। বায়েন তালাকের ক্ষেত্রে নতুন বিবাহ লাগবে।)
এরপরও যদি বনিবনা না হয়,তা হলে এক মাস পর শেষ তালাক দিতে পার।তবে এটার পর স্ত্রীকে গ্রহণ করা আর সহজ হবে না। তখন হিল্লা বিবাহ লাগবে।
দেখুন, এতগুলো স্তর পেরিয়ে আসলে কেউ কি সত্যিই তিন তালাক দিবে?স্তরগুলো আমার বানানো নয়। কুরআন এবং হাদীসের সার নির্যাস এগুলো। নারীর মর্যাদা ধরে রাখার জন্যই ইসলামের এ বিধান। নারী যেন
খেলনার বস্তুতে পরিণত না হয়, যেন যখন তখন তাকে স্বামী ছেড়ে দিতে না পারে, আবার যখন তখন তাকে গ্রহণ করতে না পারে, এ জন্যই এ বিধান। কোন স্বামী যদি কল্পনা করে যে, আমি তিন তালাক দিলে আমার স্ত্রীকে অন্য স্বামীর সাথে বিবাহ বসতে হবে।তারপর তার সাথে তাকে শুতে হবে।এরপর সে তালাক দিলে আমি তাকে পুণরায় গ্রহণ করতে পারব। এত কিছু নয়, শুধু এটুকু ভাবলেই যথেষ্ট যে, ‘আমার প্রেয়সীকে পর পুরুষের সাথে রাত কাটাতে হবে’, এটুকু ভাবলেই কোন
পুরুষত্বের অধিকারী পুরুষ আর তিন তালাক দিতে পারে না। বর্তমানে মুসলিম পারিবারিক আইনে মৌখিক তালাককে অগ্রহণযোগ্য ঘোষণা দিয়ে মূলত নারীকে খেলনার পাত্র বানানো হয়েছে, যা ইসলামের মেজাজের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এতে হয়েছে কী,স্বামী যখন ইচ্ছে স্ত্রীকে তালাক দিচ্ছে, আবার সে রাতেই তার সাথে মিলিত হচ্ছে… কত ঘৃণার ব্যাপার… ছি..

অতএব, এখন যে সচেতনতা চলছে যে,
“মৌখিক তালাক দিলে তা কার্যকরী হবে না। মেম্বার চেয়ারম্যানের সার্টিফিকেট ইত্যাদি লাগবে”, তার চেয়ে বরং “তিন তালাক দিলে স্ত্রীকে পর পুরুষের সাথে শুতে হবে”এ সচেতনতা বাড়ানো দরকার। বর্তমান সচেতনতায় তিন তালাকের সংখ্যা বাড়ছে এবং ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে পাপ ও পাপীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
নারী পরিণত হচ্ছে স্বামীর হাতের খেলনা। আর তিন তালাকের ভয়াবহতার সচেতনতা বাড়ালে তিন তালাকের সংখ্যাও কমবে, নারীর মর্যাদাও বাড়বে। বিষয়টি উপলব্ধি করা দরকার গভীর ভাবে।

।৩।প্রশ্ন : আমার প্রিয় বান্ধবী’ররপ্রশ্নটাই করি………. যদি তার বিয়েরটিকিয়ে রাখার ইচ্ছা না থাকে তাহলে কেন সে খুব সহজেই সম্পর্ক টা শেষ করে দিবে না ???? তালাক কে এত কঠিন করে রাখার কারনটা কি ???

আমাদের কমন প্রশ্ন এইটা: মেয়েরা তালাক দিতে চাইলেও যত সহজে ছেলেরা পারবে অত সহজে
পারবে না……কেন ?
উত্তর : কঃ তালাককে এত কঠিন করে রাখার পরও যেভাবে এর অপব্যবহার হচ্ছে, সহজ করে রাখলে না জানি কীরহতো.. মেয়েদের জন্য খুলা, মুবারাত, ও
তাফউইয –এই তিন ধরনের ব্যবস্থা ইসলাম রেখেছে। খুলা’ হলো স্ত্রীর প্রস্তাবনায় স্বামীকে কোন কিছু দেওয়ার মাধ্যমে তালাক নেওয়া। তা মোহরানা ফিরিয়ে দেওয়া বা মওকুফরকরার মাধ্যমেও হতে পারে। মুবারাত হলো, স্বামী-স্ত্রী উভয়ের সম্মতিতে বিবাহ বিচ্ছেদ করণ। আর তাফউইয হলো, স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার ক্ষমতা প্রদান। আমাদের দেশের বিবাহের রেজিস্ট্রীতে
স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার যে ক্ষমতারদেওয়া হয়, তা এই তাফউইযেরনমাধ্যমেই। স্বামী যদি বিবাহের সময়
এই অপশনটিতে টিক চিহ্ণ দিয়ে রাখে, তা হলে স্ত্রী তাকে এই ক্ষমতাবলে তালাক দিতে পারবে। আমাদের দেশের মুসলিম পারিবারিক আইনে ১৯৬১ সালের সংশোধনীতে এ বিষয়টি সংযোজিত হয়। এবং আপাত দৃষ্টিতে ইসলামের সাথে এর কোন বিরোধও নেই। তবে হ্যাঁ, দেখা যায় যে, কাজী সাহেব স্বামীর অজান্তে আগেই এ অপশনটিতে টিক দিয়ে রাখেন। সে ক্ষেত্রে স্বামীকে
জানানো পূর্বক টিক দেওয়া উচিৎ।

খঃ মেয়েদের তালাক দেওয়াটা কেন একটু কঠিন তা স্বয়ং ইসলামী আইন প্রণেতাই (আল্লাহ) ভালো বলতে
পারবেন। তবে এটা ঠিক যে, একজন পুরুষ মানসিক ভাবে একজন নারীর চেয়ে অনেক শক্তিশালী। আবেগ ও ক্রোধের সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ ও বাস্তবায়ন একজন পুরুষের জন্য বেশি সহজ।(সংখ্যাধিক্যের হিসেবে) বাস্তবতা আর আবেগের মাঝে পার্থক্য করা নারীর জন্য অনেক সময়ই বেশি কঠিন। পুরুষের ন্যায় নারীদের তালাক প্রদানের ক্ষমতাটা সহজ হলে হয়তো যত্রতত্র তালাক প্রদানের মাত্রা বেড়ে যেত। তালাক পরিণত হত আবেগীর আবেগ আর খেলুড়ের খেলনায়।হয়তো.. এটাও একটি যুক্তি হতে পারে..তবে অসীম খোদার বিধানের যুক্তি খুঁজতে অনেক সময়ই আমাদের সসীমরমস্তিস্ক হার মেনে যায়। তখন একান্ত কর্তব্য হলো, সসীমকে অসীমের হাতে
বিনা বাক্য ব্যয়ে অর্পণ করে দেওয়া এবং সবকিছু অবনত মস্তকে মেনে নেওয়া। এতেই রয়েছে দাসত্ব তথা
আবদিয়্যাতের যথার্থতা। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সত্য পথে চলার তাওফীক দিন।

।৪।প্রশ্ন : হিল্লা বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে আমার কৌতহল ছিল। আমার কাছে মনে হয়েছে, অপরাধ করেছে স্বামী
আর শাস্তি পেতে হচ্ছে স্ত্রীকে কেন.....???
উত্তর : ঠিক তা না। হিল্লা শব্দটি আরবী ﺣﻠﺔ থেকে এসেছে। এর অর্থ বৈধতা/ বৈধ করণ। ইসলামে তিন তালাকের পর্যায়টা অনেকগুলো স্তর পেরিয়ে আসতে হয়। এত দীর্ঘ সময়ের মাঝে স্বামী স্ত্রীর বনিবনা না হওয়াটা উভয়ের ভবিষ্যত সম্পর্ক ভালো না হওয়ার স্পষ্ট প্রমাণ। বলে নেওয়া ভালো যে, ইসলামে এক তালাক দেওয়ার পর এক মাসের বিরতি নিতে বলার রহস্য এটাই। এর মাঝে স্বামী তার স্ত্রীর বিরহ যথেষ্টই উপলব্ধি করতে পারবে।স্ত্রীও ভুল হয়ে থাকলে তা শুধরে নিতে পারবে। এভাবে দু’মাস, তিন মাস… অবশেষে সব পদ্ধতি ভেস্তে গেলে চূড়ান্ত ভাবে বিবাহ বিচ্ছেদ
ঘটবে। মনে রাখা উচিৎ, চূড়ান্ত বিবাহ বিচ্ছেদের অর্থ, প্রথম স্ত্রীর কাছে স্বামী আর ফিরে যেতে পারবে না।
বরং দুজন দু’মেরুতে ভিন্ন দুটো জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। স্ত্রী অন্য কাউকে বিবাহ করে নিবে। আর
স্বামীও খুঁজে নিবে অন্য কোন রমণীকে। এরপর স্ত্রীর দ্বিতীয় স্বামী যদি স্বাভাবিক জীবন যাপনের
পর কখনো মারা যায়, কিংবা স্বাভাবিক ভাবেই তাকে তালাক দেয়,তা হলে সে ক্ষেত্রে প্রথম স্বামী ইচ্ছে করলে পুনরায় তাকে গ্রহণ করতে পারে। তা হলে এমতাবস্থায় মাঝের এই বিয়েটা হিল্লা বা প্রথম স্বামীর জন্য বৈধ করণ বলে গণ্য হলো। আর এ কারণেই একে হিল্লা বিয়ে বলা হয়।
কিন্তু আজকাল যা হয় তা হলো, নাটকের ন্যায় স্ত্রীকে চুক্তির মাধ্যমে দ্বিতীয় কোন স্বামীর কাছে বিবাহ দেওয়া হয়। যেন সে এক রাত কাটিয়ে তালাক দিয়ে দেয় এবং প্রথম স্বামী তাকে পুণরায় গ্রহণ করে নিতে পারে।
কিন্তু নবীজী স: এ কাজে কঠোর অভিশাপ দিয়েছেন। কারণ এতে মূলত নারীকে অবহেলার বস্তুতে পরিণত করা হয়। আজ মন চাইল তো তালাক দিলাম,কাল মন চাইল তো অন্য জনের সাথে বিয়ে দিলাম, পরশু আবার মন চাইল তো নিজে বিয়ে করে নিলাম –ব্যাপারটা
এমনই দাঁড়ায়। নারীরও আত্মমর্যাদা আছে। যে স্বামী তাকে হেলায় খেলায় তিন তালাক দিতে পারে তার সাথে
পুণরায় ঘর করায় তো তার আত্মমর্যাদায় বাধা হওয়ার কথা।সে কেন দ্বিতীয় স্বামীর থেকে এক রাতের ব্যবধানে তালাক নিয়ে পুণরায় প্রথম স্বামীর কাছে ফিরে যাবে?
বরং নতুন জীবন শুরু করাই কি তার জন্য শ্রেয় নয়?

তবে হ্যাঁ, এ ক্ষেত্রে চুক্তি ছাড়াই যদি কোন হিতাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তি উভয় পক্ষের প্রতি সমবেদনামূলক এ বিয়ে
করে স্ত্রীকে প্রথম স্বামীর কাছে ফিরিয়ে দিতে চেষ্টা করেন, তা হলে তা বৈধ হবে এবং তিনি নিশ্চয়
আল্লাহর কাছে সওয়াব পাবেন।আসলে সব কিছুর মূলে হলো, এক বাক্যে তিন তালাক বলা বা একসাথে তিন
তালাক দেওয়া। যা আজ অহরহ হচ্ছে।হযরত ওমর রা: এর কাছে কেউ এক সাথে তিন তালাক দিয়েছে বলে খবর আসলে তাকে প্রথমে তিনি প্রহার করে নিতেন, এরপর তা কার্যকর করতেন।নবীজী স. –এর কাছেও এক ব্যক্তি এক সাথে তিন তালাক দিয়েছে বলে খবর
আসলে তিনি তাকে কঠোর ভাবে শাসিয়ে দেন।

অতএব হিল্লা বিয়ের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা দরকার।
এই ঘৃন্য কাজকে সমাজ থেকে মুলৎপাটন করতে হবে।
সেক্ষেত্রে সবারই দায়িত্ব আছে,সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে!!!


No comments

Note: Only a member of this blog may post a comment.

Powered by Blogger.