হজের রীতিগুলো আরব পৌত্তলিকদের থেকে নেওয়া ?

নাস্তিকদের অভিযোগঃ হজের রীতিগুলো আরব পৌত্তলিকদের থেকে নেওয়া!
যেমন--
◘ ১)কা’বাকে কেন্দ্র করে পাক দিয়ে ঘোরা
◘ ২)হাজরে আসওয়াদ বা কালো পাথরকে চুমু খাওয়া
◘ ৩)সাফা-মারওয়া পাহাড়ে দৌঁড়ানো ও শয়তানকে পাথর ছোড়া!
জবাবঃ নিচে তাদের অভিযোগগুলো বিশ্লেষণ করে সেগুলোর খণ্ডন করা হল-
◘ কা’বাকে কেন্দ্র করে পাক দিয়ে ঘোরা(তাওয়াফ):
ইসলাম বিরোধীরা এরপরে যদি বলতে চায়ঃ কা’বা ঘর তাওয়াফ পৌত্তলিক(pagan) উপাসনা না হলে প্রাচীন আরব পৌত্তলিকরা কেন তাওয়াফ করত?
উত্তরে আমরা বলবঃ আরব পৌত্তলিকদের করা ১০০% কাজই ভুল ছিল না। তারা ছিল ইব্রাহিম(আ) ও ইসমাঈল(আ) এর বংশধর, তাঁদের একত্ববাদী দ্বীন ধীরে ধীরে তাঁদের বংশধরদের মাঝে বিকৃত হয়েছিল। তাদের ভেতর অল্প কিছু ইব্রাহিমী রীতি রাসুল(ﷺ) এর সময়েও অবশিষ্ট ছিল। এর মধ্যে আল্লাহর ঘরকে কেন্দ্র করে তাওয়াফ বা পাক দেওয়া অন্যতম।
আল কুরআনে বলা হয়েছেঃ
“আর স্মরণ কর, যখন আমি কাবাকে মানুষের জন্য মিলনকেন্দ্র ও নিরাপদ স্থান বানালাম এবং (আদেশ দিলাম যে,) ‘তোমরা মাকামে ইব্রাহিমকে সালাতের স্থানরূপে গ্রহণ কর’। আর আমি ইব্রাহিম ও ইসমাঈলকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম যে, ‘তোমরা আমার গৃহকে তাওয়াফকারী, ‘ইতিকাফকারী ও রুকূকারী-সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র কর’। ”
(কুরআন, বাকারাহ ২:১২৫;
অর্থাৎ এই তাওয়াফ ছিল স্বয়ং ইব্রাহিম(আ) ও ইসমাঈল(আ) এর সময় থেকেই আল্লাহ কর্তৃক নির্দিষ্ট রীতি। তাঁদের বংশধরদের মধ্যে পরবর্তীতে বিভিন্ন নব উদ্ভাবিত ধর্মীয় রীতি ও পৌত্তলিকতা বিস্তার লাভ করে। নবী মুহাম্মাদ(ﷺ) তাদের মধ্য থেকে নব উদ্ভাবন ও পৌত্তলিকতাগুলো দূর করে দেন এবং ইব্রাহিমী রীতিগুলোকে আল্লাহর নির্দেশে বহাল রাখেন।
◘ হাজরে আসওয়াদ বা কালো পাথরকে চুমু খাওয়াঃ
*************************************************
হাজরে আসওয়াদের উৎস কী? এটি কা’বা ঘরে কেন রয়েছে?
আল্লামা আজরুকী রহ. যা বর্ণনা করেছেন- ‘যখন কাবা নির্মাণ কাজ বর্তমান ‘হাজরে আসওয়াদ’ এর স্থান পর্যন্ত এলে, ইবরাহীম আ. ইসমাঈল আ.কে লক্ষ্য করে বললেন- ‘আমি একটি পাথরের টুকরো চাই যা আমি এই স্থানটিতে রাখবো। লোকেরা দেখে বুঝবে যে, তাওয়াফ এই স্থানটি থেকে শুরু হবে। পিতার নির্দেশে ইসমাঈল আ. পাথর খোঁজতে গিয়ে পাথর হাতে ফিরে আসার পূর্বেই জিবরাঈল আ. ‘হাজরে আসওয়াদ’ নিয়ে উপস্থিত হন।
তারপর হাজরে আসওয়াদকে তার স্বীয় স্থানে প্রতিস্থাপন করা হলো।
’ [আখবারু মক্কা, আবরুকী : ১/৬৫]
◘ হাজরে আসওয়াদ বা কালো পাথরকে চুমু খাওয়াঃ
হজের সময়ে হাজরে আসওয়াদ বা কালো পাথরকে চুমু খাওয়া নিয়ে খ্রিষ্টান মিশনারী ও নাস্তিক-মুক্তমনারা বহুমুখী অভিযোগ তোলে। অভিযোগগুলো শুধু মিথ্যাই নয়, অশ্লীলও।
প্রথমত, তারা বলতে চায়–হাজরে আসওয়াদ বা কালো পাথর নাকি নারীদের যোনীর প্রতিকৃতি যাতে মুসলিমরা চুম্বন করে (নাউযুবিল্লাহ, আসতাগফিরুল্লাহ)।
এই অভিযোগের আদৌ কোন ভিত্তি নেই। ইসলাম বিরোধীরা হাজরে আসওয়াদ বা কালো পাথরের উপরিভাগের ছবিতে এর রূপালী বর্ণের ধারকটির আকৃতি্র দিকে ইঙ্গিত করে এই উদ্ভট অভিযোগ তোলে। শিয়াদের একটি ফির্কা কারামিতারা ৩১৭ হিজরীতে কা’বা থেকে হাজরে আসওয়াদ লুট করে, ২২ বছর পর ৩৩৯ হিজরীতে তা উদ্ধার করা হয়। এই ২২ বছর হাজরে আসওয়াদ ছাড়াই হজ সম্পাদিত হয়েছিল। কারামিতারা হাজরে আসওয়াদ ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলেছিল। এ কারণে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া পাথরটিকে একত্রে জোড়া দিয়ে একটা গোল ধারক বা ফ্রেমের ভেতর স্থাপন করা হয়েছে। যে কারণে আমরা বর্তমানে গোল রূপালী রঙের ফ্রেমের মাঝে কালো পাথর বা হাজরে আসওয়াদ দেখি। প্রকৃতপক্ষে যদি আমরা পূর্ণ হাজরে আসওয়াদের ছবি দেখি, তাহলে কোনভাবেই এর সাথে নারীদের যোনীর আকৃতির কোন মিল পাওয়া যাবে না(নাউযুবিল্লাহ)।
মানুষ তো তার সন্তানকেও ভালোবেসে চুম্বন করে। এর মানে কি মানুষ তার সন্তানের উপাসনা করে?
কোন পৌত্তলিক জাতিগোষ্ঠীগুলোর উপাসনার রীতি যদি আমরা লক্ষ্য করি, তাহলেও আমরা এর সাথে মুসলিমদের কোন মিল খুঁজে পাই না। কোন ক্যাথোলিক খ্রিষ্টান কি চার্চে গিয়ে মরিয়ম(আ) কিংবা যিশুর মূর্তিকে চুমু খায়? কিংবা কোন হিন্দু কি কখনো মন্দিরে পুজার সময় দুর্গা, স্বরস্বতী, কালি এসব দেব-দেবীর মূর্তিতে চুমু খায়?হাজরে আসওয়াদকে মুসলিমরা কখনোই আল্লাহ তা’আলার মূর্তি বা প্রতিকৃতি মনে করে না (নাউযুবিল্লাহ), একে কল্যাণ-অকল্যাণের মালিকও মনে করে না, এর কাছে কোন সাহায্যও চায় না। শুধুমাত্র নবী(ﷺ) এর সুন্নাত হিসাবে মুসলিমরা হজের সময় একে চুম্বন করে। অথচ পৌত্তলিকরা যেসব বস্তুর পুজা করে সেগুলো হয় তাদের উপাস্য দেবতার মূর্তি নয়তো তারা সেগুলোর কাছে কল্যাণ প্রার্থনা করে। কাজেই হাজরে আসওয়াদকে পৌত্তলিকতার সাথে মেলানো অত্যন্ত অযৌক্তিক একটি অভিযোগ।
সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে এই পাথরে চুমু খাওয়া বাধ্যতামূলক নয়। এটি রাসুল(সাঃ) এর সুন্নত। বিদায় হজ্জের দিন তিনি দূর থেকে হাতের ইশারায় চুমু খান।(সহি বুখারী)
উমর (রা) থেকে বর্ণিত যে, তিনি হাজরে আসওয়াদের কাছে এসে তা চুম্বন করে বললেন, আমি অবশ্যই জানি যে, তুমি একখানা পাথর মাত্র, তুমি কারো কল্যাণ বা অকল্যাণ করতে পার না। নবী(ﷺ)কে তোমায় চুম্বন করতে না দেখলে কখনো আমি তোমাকে চুম্বন করতাম না।
[সহীহ বুখারী ; হাদিস নং ১৫০২]
◘ সাফা-মারওয়া পাহাড়ে দৌঁড়ানো ও শয়তানকে পাথর ছোড়াঃ
পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে যে—আরব পৌত্তলিকদের করা ১০০% কাজই ভুল ছিল না। তারা ছিল ইব্রাহিম(আ) ও ইসমাঈল(আ) এর বংশধর। তাঁদের বংশধরদের মধ্যে পরবর্তীতে বিভিন্ন নব উদ্ভাবিত ধর্মীয় রীতি ও পৌত্তলিকতা বিস্তার লাভ করে। নবী মুহাম্মাদ(ﷺ) তাদের মধ্য থেকে নব উদ্ভাবন ও পৌত্তলিকতাগুলো দূর করে দেন এবং ইব্রাহিমী রীতিগুলোকে আল্লাহর নির্দেশে বহাল রাখেন।
সাফা-মারওয়া পাহাড়ে দৌঁড়ানো ও শয়তানকে পাথর ছোড়া-এগুলোও ইব্রাহিমী রীতি যেগুলোকে মুহাম্মাদ(ﷺ) বহাল রেখেছিলেন। নবী ইব্রাহিম(আ) আল্লাহর নির্দেশে তাঁর স্ত্রী হাজেরা(আ) এবং শিশুপুত্র ইসমাঈল(আ)কে আরবের মরুভূমিতে রেখে এসেছিলেন এবং পিপাসার্ত শিশু ইসমাঈল(আ) এর পানির জন্য তাঁর মা হাজেরা(আ) সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে ৭ বার দৌঁড়েছিলেন।
[১০] এ ছাড়া, পুত্রকে কুরবানী করতে যাবার সময় ওয়াসওয়াসা দানকারী শয়তানের উদ্যেশ্যে নবী ইব্রাহিম(আ) পাথর ছুড়েছিলেন। [১১] ইব্রাহিম(আ), হাজেরা(আ), ইসমাঈল(আ) – তাঁরা সকলেই তাকওয়া অবলম্বন করেছিলেন, আল্লাহর উদ্যেশ্যে আত্মসমর্পণ ও ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন। তাঁদের এই কর্মগুলোকেই মুহাম্মাদ(ﷺ) এর শরিয়তে হজের আনুষ্ঠিকতার ভেতরে অন্তর্ভুক্ত করে চিরস্মরণীয় করে রাখা হয়েছে। এখানে আল্লাহ ছাড়া আর কারো উপাসনার কোন ব্যাপার নেই।
সাধারণ যুক্তির আলোকেও আমরা বলতে পারি—পৌত্তলিকরা কি কখনো তাদের উপাস্য দেবতার মূর্তিকে ঘৃণা করে বা পাথর ছোড়ে? নাকি তার উল্টো কাজ করে, মূর্তিকে ভক্তি করে এবং ফুল ও বিভিন্ন দ্রব্য দিয়ে পুজা করে? একই কথা সাফা-মারওয়া পাহাড়ে দৌঁড়ানোর ক্ষেত্রেও। এখানে আল্লাহর বিধানের আনুগত্য ছাড়া মুসলিমদের মানসপটে আর কোন কিছু থাকে না।
যারা হজের ভেতর বিভিন্ন প্রাচীন ঐতিহাসিক কর্মের অনুকরণমূলক কর্মকাণ্ডকে ‘পৌত্তলিকতা’ বলে, তাদের আসলে মিল্লাতে ইব্রাহিম{ইব্রাহিম(আ) এর ধর্মাদর্শ} কিংবা পৌত্তলিকতা এর কোনটা সম্পর্কেই সম্যক ধারণা নেই। মুহাম্মাদ(ﷺ) এর পূর্বেও অনেক নবী-রাসুল এসেছিলেন এবং তাঁরাও ইব্রাহিম(আ) এর দ্বীনেরই তথা ইসলামের অনুসরণ করতেন।
পরিশেষে এটাই বলব যে দ্বীন ইসলামের অন্যম রুকন বা ভিত্তি হজ এর অনুষ্ঠানাদির মধ্যে পৌত্তলিকতার লেশমাত্রও নেই এবং তা বিশুদ্ধ একত্ববাদী ইব্রাহিমী রীতিনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। যারা হজের অনুষ্ঠানাদি নিয়ে প্রশ্ন তোলে, এক রাশ অজ্ঞতা ও ডাবল স্ট্যান্ডার্ড প্রয়োগ ছাড়া তাদের দাবির কোন সুদৃঢ় ভিত্তি নেই।
“বলঃ আল্লাহ সত্য বলেছেন; অতএব তোমরা ইব্রাহিমের সুদৃঢ় ধর্মের অনুসরণ কর এবং সে মুশরিক(অংশীবাদী)দের অন্তর্গত ছিলনা।
(কুরআন, আলি ইমরান ৩:৯৫)
আশাকরি উত্তরটি পেয়েছেন।


No comments

Note: Only a member of this blog may post a comment.

Powered by Blogger.