স্যার আইজ্যাক নিউটন।অলৌকিকতার অন্বেষণেঃ

অলৌকিকতার অন্বেষণেঃ পর্ব ১- Philosopher's
Stone
স্যার আইজ্যাক নিউটন।
তাঁর নাম জানেন না এমন শিক্ষিত লোক খুঁজে পাওয়া
সম্ভব নয়। বিজ্ঞান জগতের এক উজ্জ্বল
নক্ষত্র, অসামান্য প্রতিভা। তাঁর অবদান না থাকলে
আজকের পৃথিবী বর্তমান পর্যায়ে পৌঁছাতে হয়ত
আরও ২০০ বছর লেগে যেত... সাইন্সের প্রতিটি
স্তরেই রয়েছে তাঁর অবাধ বিচরণ...
কিন্তু...
কিন্তু, অনেকেই জেনে অবাক হবেন যে, তাঁর
সারা জীবনের যত গবেষণা তার অল্প একটা অংশই
ছিল বিজ্ঞান নিয়ে। এর চেয়ে অনেক বেশি
সময় তিনি ব্যয় করেছেন কীসের পেছনে
জানেন???
অতীন্দ্রিয় আর অতিপ্রাকৃত জিনিসের পেছনে...
তবে তাঁকে এসব কাজ করতে হয় গোপনে...
আপনি কি জানেন কেন স্যার নিউটন শেষ বয়সে
পাগল হয়ে যান?? ৩১ মার্চ, ১৭২৭ সালে ৮৪ বছর
বয়সে মারা যান ইতিহাসের শেষ আলকেমিস্ট
আইজ্যাক নিউটন। তাঁর লাশ থেকে তখন কীসের
প্রমাণ পাওয়া যায়?
কেন মারা যান তিনি? কী নিয়ে সারা জীবন
গবেষণা করে কাটিয়ে দিলেন নিউটন? আর
কেনই বা তা গোপন করে গেছেন?
এই সিরিজে আমরা ধীরে ধীরে নিউটনের এ
প্যাশন উদ্ঘাটন করব... তবে, নিউটন উপলক্ষ মাত্র,
জোর দেয়া হবে সেসব নিষিদ্ধ জিনিসের উপর
যেগুলা হারিয়ে গেছে ইতিহাসের অন্তরালে...
অতীন্দ্রিয়ের অন্বেষণে...
শুরু করা যাক...
প্রথম পর্ব সাজানো হল, আলকেমি নিয়ে। আর
অবশ্যই আলকেমির পরম আরাধ্য পরশ পাথর
(Philosopher’s Stone) আর অমৃত সুধা (Elixir Of
Life) নিয়ে... {Mind it, এটা প্রমাণভিত্তিক নোট
না, লেজেন্ডভিত্তিক। সো, রেফারেন্সপ্রিয়রা
হতাশ হতে পারেন }
আলকেমি।
অনেকে ভুলবশত আলকেমিকে কেমিস্ট্রির
সাথে গুলিয়ে ফেলেন। কিন্তু আসলে এ দুটো
বিষয়ে ব্যাপক ফারাক আছে। এটা ঠিক যে,
আলকেমি শব্দ থেকে কেমিস্ট্রি শব্দ
এসেছে। কিন্ত, আলকেমি মানেই কেমিস্ট্রি না।
আলকেমি (Alchemy) শব্দ এসেছে আরবি:
, আল-কিমিয়া শব্দ থেকে। আর আরবি
কিমিয়া শব্দ এসেছে প্রাচীন গ্রিক “কেমিয়া” শব্দ
থেকে।
আলকেমির সংজ্ঞা দিতে গেলে এমন দাঁড়াবেঃ
আলকেমি হচ্ছে সেই শাস্ত্র যার চর্চার মাধ্যমে
লাভ করা যায় পরিপূর্ণতা, ধাতুকে পরিণত করা যায়
সোনায়, আর মানুষ লাভ করতে পারে অমরত্ব।
আমকেমি আর কেমিস্ট্রির পার্থক্য কী?
আলকেমিতে দরকার একটি অদৃশ্য আধ্যাত্মিক
শক্তির অতিপ্রাকৃত সাহায্য যেটা ছাড়া কোন
আলকেমিকাল কাজ সম্পূর্ণ হবে না। এ আধ্যাত্মিক
সাহায্য আসতে পারে পজিটিভ দিক থেকে অথবা
নেগেটিভ দিক থেকে।
যখন নেগেটিভ শক্তি ব্যবহার করে করা হয় তখন
বলা হয় ডার্ক আর্টস এর সাহায্য নেয়া হচ্ছে। আর
পজিটিভ শক্তির বিষয়ে প্রথম ধারণা দেন যিনি তিনি
হলেন আল্কেমিস্ট জাবির ইবনে হাইয়ান।
অন্যদিকে, কেমিস্ট্রিতে কোন এমন সাহায্যের
প্রয়োজন পড়ে না, এটা সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক বিষয়।
আলকেমি থেকে কেমিস্ট্রি কীভাবে
আসল?? আল্কেমিস্ট জাবির ইবনে হাইয়ানকে
(৭২২-৮০৪) বলা হয় “কেমিস্ট্রির জনক”; তিনি
আলকেমি নিয়ে গবেষণা করতে করতে
অনেক কিছুই তৈরি করে ফেলেন। যেমন,
হাইড্রোক্লোরিক এসিড, নাইট্রিক এসিড,
সালফিউরিক এসিড, একুয়া রেজিয়া ইত্যাদি।
আপনি কি জানেন জাবির ইবনে হাইয়ানকে এ পথে
অনুপ্রাণিত করেন কে? ইমাম জাফর সাদিক, মুহাম্মাদ
(স) এর সরাসরি বংশধর। জাবির প্রায়ই বলতেন, “আমি
আলকেমির যা যা শিখেছি সবই আমার শিক্ষক জাফর
সাদিকের কাছ থেকে।”
যাই হোক, এবার আমরা ফিরে আসি, আলকেমির
উদ্দেশ্য কী সেটার বিষয়ে।
আলকেমির চূড়ান্ত টার্গেট হল একটা substance
তৈরি করা, যেটা সম্পর্কে বিশ্বাস করা হয়, সেই
substance দিয়ে মহাবিশ্বের সকল নিগুড়
প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে। সেই Substance
এর রয়েছে ২টা অংশ, প্রথমটা কঠিন আর দ্বিতীটি
তরল-
১) Philosopher’s Stone (পরশ মণি বা পরশ পাথর)
২) Elixir Of Life (অমৃত সুধা)
দ্বিতীয় নামটা জাবির ইবনে হাইয়ান এর দেয়া। তিনি
নাম দিয়েছিলেন আরবিতে “আল-ইকসির” যেটা
হয়ে যায় “এলিক্সির” (Elixir)।
পরশমণি তৈরির যে প্রসেস আল্কেমিস্টরা অনুসরণ
করতেন সেটাকে বলা হত “ম্যাগনাম
ওপাস” (Magnum Opus); যদি বিরুক্ত বোধ না
করেন তাহলে “ম্যাগনাম ওপাস” এর স্টেপগুলো
পড়ার জন্য দিলাম। প্রসেস আর কিছু বৈশিষ্ট্য
উল্লেখ করার পরই আমি একটা কাহিনী শুরু করব-
সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণঃ আলকেমি বা জাদুবিদ্যা
সংক্রান্ত বইগুলো সাধারণত খুবই লোভনীয় বা
প্রলুব্ধকর হয়ে থাকে। যেহেতু, ইসলাম,
খ্রিস্টান আর ইহুদী ধর্মে জাদুবিদ্যা হারাম, তাই
এসব বই (বা পিডিএফ বা কোন পারফেক্ট
ওয়েব লিঙ্ক) থেকে দূরে থাকার পরামর্শ
দেয়া হয়। এর কারণ এটা না যে, এগুলো জানা
হারাম, এটার কারণ বরং এই যে, এগুলো পড়ে
প্রলুব্ধ হয়ে কালোর পথে পা বাড়াতেও
পারে কেউ। তাই যথেষ্ট ইমানি শক্তি না
থাকলে সে দিকে না যাওয়াই উত্তম।>
“ম্যাগনাম ওপাস” (The Great Work)
এ প্রসেসের ধাপ ৪টি, উপধাপ ১২-১৪টি। আমি
এখানে কেবল ৪টা ধারাবাহিক প্রধান স্টেপের নাম
বলছি-
১) নিগ্রেডোঃ কালো হতে শুরু করবে
২) আল্বেডোঃ সাদা হতে শুরু করবে
৩) সাইট্রিনিটাসঃ হলুদ হতে শুরু করবে
৪) রুবেডোঃ লাল হতে শুরু করবে
Philospher’s Stone এর কিছু ধর্ম, প্রাচীন কিছু
পাণ্ডুলিপি থেকে পাওয়া যায়। প্রথম প্রশ্ন আসে,
এ পাথরের রঙ কী??
এর উত্তর হচ্ছে, দুই রকমের পরশমণির কথা জানা
যায়। একটা সাদা, আরেকটি লাল। উপরর ৪ স্টেপের
এদিক সেদিক করলেই এই দুই রকম স্টোন পাওয়া
যায়।
সাদা স্টোনের শক্তি কম আর সেটা ধাতুকে
পরিণত করতে পারে রূপায়।
লাল স্টোনের শক্তি বেশি আর সেটা ধাতুকে
সোনায় পরিণত করতে পারে।
লাল স্টোন নিয়ে বেশি লিখা পাওয়া যায়। বলা
হয়েছে, গুড়ো করলে এ পাথরের রঙ কমলা বা
লাল এর মতো দেখায়, কিন্তু সলিড অবস্থায়
টকটকে লাল (স্যাফ্রন) অথবা লাল-পার্পলের
মাঝের একটা রঙ এর মতো দেখায়। তখন এটা
থাকে স্বচ্ছ আর কাঁচের মতো।
এর ভর, সোনার চেয়ে বেশি।
যেকোনো তরলে দ্রবীভূত।
আগুনে এটা মোটেও দাহ্য না।
No photos in free mode
Use Data to See Photos
পাথরটা হয়ত এরকমই ছিল
এবার আসা যাক এলিক্সিরের কথাতে। অর্থাৎ, অমৃত
সুধা বলে যাকে। এলিক্সির অফ লাইফ।
আলকেমিকাল টেক্সটে বলা হয়েছে, এ সাদা
রঙের তরল কয়েক ফোঁটা পান করলে দীর্ঘায়ু
লাভ করা যায়। তবে এটাকে অমরত্বের জন্যই
মূলত বানানোর চেষ্টা করা হত। কিন্তু, আসলে
অমরত্ব দেয়ার মতো কোন সাবস্টেন্স তৈরি
করা সম্ভব না। বড়জোর, দীর্ঘায়ু হতে পারে।
এর বেশি না।
ফারসিতে একে বলা হয় “আবে হায়াত”।
এবার আমরা কাহিনীতে প্রবেশ করি। কাহিনীর শুরু
মারিয়া নামের এক নারীকে দিয়ে।
খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতক।
গ্রিস।
অ্যালেকজান্ডারের দরবার।
No photos in free mode
Use Data to See Photos
দূর দেশ থেকে বেড়াতে এসেছেন মারিয়া
নামের এ সম্ভ্রান্ত “বিদুষী” নারী। তাঁকে
সাদরে গ্রহণ করা হল। রাজ্যের সকল স্কলার তাঁর
জ্ঞানপিপাসা পূরণ করতে লাগলেন।
পরে এই মারিয়া ইতিহাসের প্রথম আল্কেমিস্ট
হিসেবে পরিচিতি পান (তাঁর অবস্থান শীর্ষ ৫২
আল্কেমিস্টদের মধ্যে); তবে তিনি বেশি
পরিচিত “ইহুদিনী মারিয়া” নামেই। জন্মসূত্রে ইহুদী
থাকায় কাব্বালা (ইহুদী ডার্ক আর্টস) সম্পর্কে জানা
তাঁর জন্য অসম্ভব ছিল না।
এরপর তিনি যান মিসরে, মেমফিস নগরীতে।
সেখানে তাঁর সাথে পরিচয় হয় ডেমোক্রিটাস
নামের একজনের সাথে, যাকে তিনি বাস্তব রসায়ন
নিয়ে হালকা ধারণা দেন। ইতিহাসে
ডেমোক্রিটাসের নাম এখন স্মরণীয়।
তাঁর কথা লেখবার সময় যেটা উল্লেখ করা হত,
সেটা হল, মারিয়া এক অনন্য জ্ঞানের অধিকারিণী
ছিলেন। তিনি সোনা বানাতে পারতেন। তিনি জাবির
ইবনে হাইয়ানের আগেই HCl আবিস্কার করেন
বলে জানা যায়।
রহস্যময়ী মারিয়া ইতিহাসের পাতা থেকে এরপর
হারিয়ে যান। কিন্তু এরপর থেকে অনেক জায়গায়
আলকেমি নিয়ে গবেষণা শুরু হয়ে যায়। সাফল্য
নাকি ব্যর্থতার সাথে, সেটা আমরা জানি না। হয়ত
জানবও না।
অষ্টম শতক পর্যন্ত এভাবেই চলতে থাকে
আলকেমির কাজ। ঠিক তখন মুসলিম বিশ্বে
আলকেমি সূচনা করেন জাবির ইবনে হাইয়ান। এবং
প্রথমবারের মতো তিনি আধ্যাত্মিক শক্তিই
হিসেবে ঈশ্বর/আল্লাহ্র সাহায্যের কথা উল্লেখ
করেন।
কিন্তু ৯ম থেকে ১৪শ শতক পর্যন্ত অনেক
মুসলিম কেমিস্ট (আল্কেমিস্ট না) এর কাছেই
জাবিরের আলকেমিকাল থিয়োরি বিরোধিতার
সম্মুখীন হয়। এর মধ্যে আছেন প্রখ্যাত আল-
বিরুনি আর ইবনে সিনা। তারা ছিলেন বিরোধী পক্ষ।
তাদের মতে, কখনই এক পদার্থকে অন্য
পদার্থে রুপান্তর করা সম্ভব না। {আসলে সম্ভব।
Transmutation দ্বারা}
সম্ভবত জাবিরের সমসাময়িক সময়ে মদ্ধপ্রাচ্যে
আর ইসরায়েলে আলকেমির প্রসার ঘটে।
অভাবনীয় প্রসার ঘটে।
আর এরকম আল্কেমিস্টদের কিছু পান্ডুলিপি
যোগাড়ের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েন
ইউরোপের আল্কেমিস্টরা।
অ্যালবারটাস ম্যাগ্নাস এর নাম হয়ত কেউ কেউ
শুনে থাকবেন, তিনি “স্বচক্ষে” ধাতুকে
সোনাতে পরিণত হতে দেখেছেন বলে
লিখেছেন। তার জ্ঞান পাস করে দেন তাঁর ছাত্র
থমাস এনরিকের কাছে।
ঠিক এ সময়ে আমাদের কাহিনীর দৃশ্যপটে
আগমন ঘটবে এমন একজনের যার নাম এমনিতেই
চলে আসে আলকেমি আর ফিলোসোফারস
স্টোন এর কথা বলতে গেলে? কে তিনি??
তাঁর নাম নিকোলাস ফ্লামেল।
যদি কেউ মনে করে থাকেন, নিকোলাস
ফ্লামেল একটা গল্প উপন্যাসের চরিত্র ছাড়া কিছুই
না, তাহলে অনেক বড় ভুল করে থাকবেন। বরং
তাঁর জীবন এত অসাধারণ ছিল যে সেটা অনেক
গল্প উপন্যাসকে প্রভাবিত করেছে। তাঁর জীবন
“লেজেন্ডারি”ই না কেবল, যথেষ্ট ঐতিহাসিক। তাঁর
লিখাগুলো নিজের হাতে সংরক্ষিত আছে
প্যারিসের The Bibliotheque Nationale-এ।
আনুমানিক ১৩৩০ সাল।
প্যারিসের পন্টয়েজ নামের এক মফস্বল এলাকায়
জন্ম নেন কিংবদন্তী নিকোলাস ফ্লামেল
(Nicolas Flamel )।
তাঁর শিশুকাল নিয়ে আমরা তেমন কিছু জানতে পারি না।
তবে, এটুকু আমরা জানি, ১৩৫০ সালের দিকে তরুণ
নিকোলাস প্যারিসে খুলে বসেন একটা ছোট্ট
বইয়ের স্টল। ছোট থেকেই বইয়ের প্রতি
অসম্ভব নেশা ছিল তাঁর।
স্টল বলছি কেন জানেন? কারণ, ওটা দোকান ছিল
না। নীলক্ষেতের ফুটপাতে যেমন
বইবিক্রেতারা বসে থাকেন, সেরকম দুই
ফিট বাই আড়াই ফিট একটা স্টল নিয়ে বসলেন
নিকোলাস। কিন্তু নিজের সব শ্রম তিনি ঢেলে
দেন তাঁর বইয়ের দোকানের জন্য। ধীরে
ধীরে নিকোলাসের ব্যবসায় লাভ বাড়তে
থাকে। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন বড়সড় দোকান
দেবার।
প্যারিসের পুরনো মারিভাক্স সড়কে তিনি একটা বাড়ি
কিনে ফেললেন। তার নিচের তালায় তিনি দোকান
দিলেন। শুধু তাই না, এক সময় মানুষকে চাকরি দিতে
লাগলেন নিকোলাস। এদেরই একজনকে নিজের
সারভেন্ট করে নিলেন তিনি।
প্রত্যেক লোকের জীবনেই হয়ত এমন এক
নারী আসে, যাকে দেখেই মনে হয়, হ্যাঁ, এ-ই
হল আমার যোগ্য সঙ্গিনী, এর সাথেই আমার
জীবন কাটাতে হবে। নিকোলাসের জীবনে
সেই নারী ছিলেন পেরেনেল।
পেরেনেল ছিলেন বিধবা কিন্তু সুন্দরী। ছিলেন
সম্পদশালী। বয়সে নিকোলাসের চেয়ে কিছুটা
বড় যদিও। তবে বয়স বাধা মানে নি। তারা বিবাহ করে
ফেললেন। নিকোলাসের স্ত্রী হলেন
পেরেনেল ফ্লামেল (Perenelle Flamel)।
পেরেনেল কেবল সুন্দরীই ছিলেন না,
ছিলেন খুবই জ্ঞানপিপাসু। নিকোলাসের জন্য
যাকে আদর্শ বললেও কম বলা হবে।
পেরেনেল স্বামীর ভবিষ্যৎ জীবনের
গোপন কথাগুলো চেপে রেখেছিলেন
সার্থকভাবে। নিকোলাসের লিখাগুলো না
পেলে আমরা হয়ত এই নারীর জ্ঞানপিপাসা
সম্পর্কে জানতেই পারতাম না।
নিকোলাস প্রথম জীবনে ছোট্ট সেই
বইয়ের দোকান দিয়েছিলেন, মনে আছে?
তখন থেকেই তিনি এমন সব বই পড়তে থাকেন,
যা সাধারণের চোখে নিষিদ্ধ বিবেচিত ছিল। নিষিদ্ধ
আলকেমির বই। মিসরিয়, গ্রিক আর আরবদের
আলকেমি নিয়ে লিখা বইগুলো তিনি শেষ করে
ফেলেন। এক পর্যায়ে তিনি নিশ্চিত হয়ে যান,
যে, কোথাও না কোথাও আলকেমির এ গোপন
নথিপত্রগুলো কোডেড ভাষায় লুকিয়ে রাখা
আছে... অথবা, বিশেষ ব্যক্তিদের কাছে
আছে... কিন্তু একজন বইদোকানীর জন্য এমন
কাউকে খুঁজে বের করা খুবই দুষ্কর।
একদিনের ঘটনা। বইয়ের দোকানে বসে
আসছেন নিকোলাস, এমন সময় এক হকার টাইপ
লোক এসে ঢুকে পড়ল, বই বিক্রি করতে চায়,
কারণ তাঁর অনেক টাকার অভাব পড়েছে। পুরনো
অনেক বই নিয়ে এসেছে। সাধারণত এসব
ক্ষেত্রে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেন, কিন্তু
আজকে বিশেষ একটা বই এর দিকে চোখ
আটকে গেল নিকোলাসের। কপার বাইন্ডিং এর খুব
পুরনো সেই পাণ্ডুলিপিতে তাঁর চোখে পড়ল
খুবই ইন্টারেস্টিং কিছু চিহ্ন আর চিত্র... তিনি সিদ্ধান্ত
নিয়ে ফেললেন এটা তিনি কিনবেন। দামাদামি ছাড়াই
দুই ফ্লোরিন দিয়ে কিনে ফেললেন বইটি।
গ্রিক আর এক তাঁর অচেনা এক ভাষায় লিখা সেই বই
এর পাতাগুলো ছিল অসাধারণ, মোটেও সাধারণ
পারচমেন্ট না। বইটা সাত ভাগে ভাগ করা ছিল, প্রতি
ভাগে ছিল চার পৃষ্ঠা। প্রতি তিন পেজ পর একটা ফাঁকা
পেজ যেখানে কোন লিখা ছিল না, কিন্তু অদ্ভুত
সব ছবি ছিল। রহস্যময়। তবে প্রথমেই যেটা
নজরে পড়ে সেটা হল প্রথম পেজে সুন্দর
করে লিখা বই এর লেখকের নাম “ইহুদী যুবরাজ
আব্রাহাম”; আর, বই এর কোনা গুলো সোনায়
মুড়োনো ছিল।
নিকোলাস যেহেতু এ কদিনে আলকেমি নিয়ে
পড়েছেন তাই এ বই এর চিহ্ন দেখে বুঝতে
অসুবিধা হল না তাঁর যে এটা আল্কেমি নিয়ে বই।
“আমি কি পারব এ বইটা পড়তে?” ভাবলেন
নিকোলাস। বই এর সব ভাষা যে তিনি পড়তে
পারছেন না।
কী করবেন তিনি?
তিনি সেই বই এর কিছু পেজ নিজে লিখে নিলেন
আর সেই পেজগুলো নিয়ে বেরিয়ে
পড়লেন এমন কারো খোঁজে জিনি কিনা
বলতে পারবেন কী লিখা আছে এখানে। কিন্তু
পদে পদে তিনি অবিশ্বাসীদের বিদ্রূপ ছাড়া কিছুই
পেলেন না।
২১টা বছর কেটে গেল তাঁর। ২১টা বছর।
প্যারিসে এমন কেউ নেই যার কাছ থেকে তিনি
সাহায্য পাবেন এ বই এর ব্যাপারে। তিনি
জেনেছেন, এ বই এর অনেক লেখাই প্রাচীন
হিব্রুতে। স্বাভাবিক, কারণ একজন ইহুদীর লেখা এ
বই। তাঁকে এখন বের হতে হবে জ্ঞানী
কোন একজন ইহুদীর খোঁজে।
নিকোলাস জানতেন, ফ্রান্স থেকে ইহুদিদের
বহিষ্কার করা হয়েছে তখন। অনেক ইহুদি পালিয়ে
গেছে স্পেনে। স্পেনের মালাগা আর
গ্রানাডাতে। সেখানে এখন অনেক ইহুদীর বাস।
মুসলিম রাজত্বের আন্ডারে তারা সেখানে বসবাস
করছে শান্তিতেই। সেখানে তারা প্লেটো আর
অ্যারিস্টটল এর বইসহ অনেক নিষিদ্ধ বইও অনুবাদ
করছে... প্রচার করছে।
নিকোলাস ভাবলেন, স্পেনে গেলে তিনি হয়ত
কাব্বালাতে (ইহুদি জাদুবিদ্যা) পারদর্শী কাউকে
পেয়ে যাবেন। তাঁর সহায়তায় তিনি হয়ত বইটা অনুবাদ
করে ফেলবেন। যেই ভাবা সেই কাজ।
সেকালে এতদূরে journey অনেক কষ্টের
আর বিপজ্জনক ছিল। তিনি তীর্থযাত্রার নাম করে
বেরিয়ে পড়লেন। প্রতিবেশীরাও জানলেন,
তিনি তীর্থে যাচ্ছেন। কেউ জানল না, তাঁর আসল
উদ্দেশ্য কী। একমাত্র জানতেন তাঁর স্ত্রী
পেরেনেল ফ্লামেল।
নিকোলাস সাথে নিয়ে গেলেন সাবধানে কপি
করা সেই বই এর কিছু পৃষ্ঠা। তাও আবার লুকিয়ে।
নিকোলাসের সেই ভ্রমণে আদৌ কোন বিপদ
এসেছিল কিনা... আমরা জানি না। কারণ, তিনি সে
সম্পর্কে কিছুই লিখে যান নি। হয়ত কোন
ঝামেলাই হয় নি। হলে হয়ত লিখতেন। তিনি কেবল
বলেছেন, তিনি তীর্থের নামে বেরিয়ে
পড়েন। যাই হোক, তিনি স্পেনে পৌঁছে
ইহুদীদের সাথে কন্টাক্ট শুরু করলেন। কিন্তু,
ইহুদিরা খ্রিস্টানদের সন্দেহের চোখে দেখত,
তাও আবার ফ্রেঞ্চ! ফ্রেঞ্চ খ্রিস্টানরাই তো
তাদের দেশছাড়া করেছে...
কিন্তু নিকোলাসের হাতে সময় বেশি নেই, যা
করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। দেশে তাঁর জন্য
অপেক্ষা করছে তাঁর স্ত্রী। তাঁর বইয়ের
দোকান।
অনেক চেষ্টা করেও নিকোলাস পেলেন না
এমন কারো সান্নিধ্য... হয়ত শেষ পর্যন্ত কেউই
তাঁকে বিশ্বাস করে নি। তিনি ফিরতি যাত্রা শুরু
করলেন। যাত্রাপথে তিনি থামলেন লিওন নামের
জায়গায়। সেখানে এক পানশালাতে রাত কাটাবেন।
রাত্রে খাবার টেবিলে বসলেন, সাথে এক
ফ্রেঞ্চ ব্যবসায়ী, বোলোন থেকে
আসছেন। দুঃখের কথা শোনালেন তাঁকে
নিকোলাস।
ভাগ্যের ব্যাপার, সেই ব্যবসায়ীর সাথে এক
জ্ঞানী ইহুদীর খাতির ছিল। নাম তাঁর মায়েস্ত্রো
কানশেস। লিওনেই থাকেন। বুড়ো মানুষ।
নিকোলাস সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, যাবেন তিনি
তাঁর কাছে।
অবশেষে তিনি দেখা করতে গেলেন
মায়েস্ত্রো কানশেস এর সাথে, কথাও বলা শুরু
করলেন। একটু আধটু হু হা... কিন্তু, তেমন একটা
দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারলেন না বুড়োর...
বললেন, ইহুদীদের বইগুলো পড়ে কত কিছু
জানতে পেরেছেন, ইত্যাদি ইত্যাদি... বুড়ো
মানুষ এরপরও কিছু বলেন না।
তখন নিকোলাস উচ্চারণ করলেন আব্রাহাম এর নাম।
ঐ বই এর লেখক। ইহুদি আব্রাহাম ইলিয়েতসার।
সাথে সাথে বুড়ো মানুষ চমকে তাকালেন তাঁর
দিকে!
নিকোলাস খুশি হয়ে গেলেন! এই লোক জানে
আব্রাহামের কথা!
পরে তিনি বলা শুরু করলেন, কে এই আব্রাহাম
ইলিয়েতসার। ইহুদি যুবরাজ। কাব্বালার উচ্চসাধক।
সবচেয়ে বিখ্যাত আলকেমির লাইনে। তাঁর বিখ্যাত
বই ছিল একটা। কিন্তু শত বছর আগেই সেটা হারিয়ে
গেছে... কেউ জানে না বইটা কোথায় এখন...
বুড়ো কানশেস সারা জীবন খুঁজেছেন এ বই।
কিন্তু পান নি। এখন তো বয়স হয়ে গেছে।
স্বপ্ন ছিল এ বই খুঁজে বের করবেন।
তখন নিকোলাস বের করে দিলেন
পেজগুলো।
বুড়ো তো খুশিতে আর বিস্ময়ে অবাক হয়ে
গেলেন। জীবনের গোধূলিলগ্নে এসে
সন্ধান পেলেন এই রত্নের।
সারা রাত কেটে গেল দুজনের আলোচনায়।
সেই কবে থেকে মায়েস্ত্রো অনুবাদ করে
আসছেন হিব্রু, তাই তাঁর কাছে কোন ব্যাপারই ছিল
না এটা। তিনি নিকোলাসকে শিখিয়ে দিলেন কী
কী করতে হবে, সিম্বলগুলোর মিনিং কী।
কিন্তু যে কটা পেজ নিকোলাস সাথে
এনেছিলেন সেগুলো যথেষ্ট ছিল না, বুড়োর
আরও জানা লাগবে। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন
নিকোলাসের সাথে প্যারিস যাবেন। কিন্তু ইহুদীরা
তো ফ্রান্সে যেতে পারবে না। তাহলে কী
করার?
বুড়ো শেষ বয়সে এসে খ্রিস্টান হলেন।
এরপর রওনা দিলেন প্যারিসের উদ্দেশ্যে। কিন্তু,
ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস। অরলিন্স এর কাছে
আসতেই খুব বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লেন
বুড়ো। ফ্লামেল অনেক চেষ্টা করলেন
তাঁকে সুস্থ করে তুলতে। কিন্তু সে আর হল না।
সাত দিনের মাথায় বুড়ো মারা যান। সান্তা ক্রক্স
চার্চে তিনি তাঁর কবর দেয়ার ব্যবস্থা করলেন।
ব্যথিত নিকোলাস ফ্লামেল বাকি যাত্রা শুরু করলেন
অরলিন্স থেকে। এরপর প্যারিস এসে পৌঁছালেন।
অনেক দিন পর স্ত্রী পেরেনেল এর সাথে
দেখা। তাঁর দোকান। তাঁর কর্মচারী। তাঁর পাণ্ডুলিপি।
সব ঠিক আছে। কিন্তু মন মানে না, তিনি যে
পারলেন না পুরোটা জানতে।
তখনই তাঁর মনে হল, তিনি যতটা শিখেছেন সেটা
দিয়েই তো সিম্বলগুলো অনেক সল্ভ করতে
পারেন। তাই তিনি বসে পড়লেন কাজে। তিনি
পুরোটা না বুঝলেও যথেষ্ট বুঝে ফেললেন
৩ বছরে। এই তিন বছরে তিনি ব্যাপক গবেষণাও
করে ফেললেন। প্র্যাক্টিকালি। এ সময়ই তিনি তাঁর
জিবনের প্রথম transmutation করেন বলে
শোনা যায়। Transmutation মানে, এক ধাতু
থেকে অন্য ধাতুতে রূপান্তর।
সম্ভবত সালটা ১৩৭৯; নিকোলাস প্রথমবারের মত
প্রায় ০.২৩ কেজি পারদকে রূপোয় পরিণত
করলেন। আর, ১৩৮২ সালে পরিণত করলেন নিখাদ
সোনায়।
ঠিক এ সময়টায়, আমরা ইতিহাস থেকে জানতে পারি,
নিকোলাস ফ্লামেল অনেক ধনী হয়ে যান।
সামান্য একজন বই দোকানী হয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা
করেন গরিবদের জন্য পুনর্বাসনপ্রকল্প,
কবরস্থান, বিনে পয়সার হাসপাতাল আর অনেক চার্চ।
কিন্তু, ফ্লামেল নিজে কোন জাঁকজমকপূর্ণ
জীবন যাপন করেন নি। তাঁর সব কাজের সাথী
ছিলেন তাঁর স্ত্রী পেরেনেল।
“স্বামী স্ত্রী নিকোলাস আর পেরেনেল
ফ্লামেল দুজনে মিলে সমাজকল্যাণে ব্রতী
হন, তাঁদের প্রতিষ্ঠিত সেইন্ট জাক্স লা বশেরি
চার্চে ১৭৮৯ সাল পর্যন্তও লোকসমাগম ছিল,”
বলেন ইতিহাসবিদ লুই ফিউগুয়ের।
যাই হোক, এ সময় নিকোলাস ঠিকই চেষ্টা করে
যাচ্ছিলেন অন্য ধাতু থেকে সোনা প্রস্তুত
কীভাবে করা যায়। তবে, তিনি তাঁর দৈনন্দিন কাজ বন্ধ
রাখেন নি। ঠিকই তিনি আসতেন তাঁর দোকানে,
পাণ্ডুলিপি কপি করতেন, কর্মচারীদের কাজ তদারকি
করতেন... আর সোনা তৈরি কিন্তু মোটেও
নিকোলাসের আসল উদ্দেশ্য ছিল না। তাঁর
উদ্দেশ্য ছিল আরও বড়... আলকেমির আসল
লক্ষ্য দীর্ঘায়ু অর্জন সম্ভব কিনা সেটা নিয়ে
গবেষণা করা। তিনি কি পেরেছিলেন সেটা নিয়ে
সফল গবেষণা চালাতে? পেরেছিলেন সেই সুধা
তৈরি করতে? এলিক্সির অফ লাইফ?
তবে একটা ব্যাপার তাঁকে সবসময় খেয়াল রাখতে
হত, তিনি যে কাজ করছিলেন, অর্থাৎ কাব্বালার
সহায়তায় আলকেমি... সেটা দেশের আইনে
নিষিদ্ধ। যেকোনো রকমের জাদুবিদ্যাসংক্রান্ত
কিছু নিষিদ্ধ এবং দণ্ডনীয় অপরাধ। তাই তিনি ছিলেন
খুবই সতর্ক। কেউ আসলেও যেন কেউ কিছু
খুঁজে না পায় সে ব্যবস্থা তিনি করে
রেখেছিলেন।
নিকোলাস ফ্লামেল তাঁর দরদী মনের কারণে
অনেককেই অনেক উপহার পাঠাতেন। এ
উপহারগুলোর কারণে তাঁর সমসাময়িক ধনীরা
ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠে। তারা সন্দেহ ছড়াতে থাকে,
একজন সামান্য বই দোকানী এত টাকা পাবে
কীভাবে?
গুজব অবশেষে রাজা ষষ্ঠ চার্লসের কানেও
এসে পৌঁছে। তিনি স্টেট কাউন্সিলের সদস্য
ক্রামইসি-কে নির্দেশ দিলেন ব্যাপারটা তদন্ত
করে দেখতে। কিন্তু চতুর আর সাবধানী
নিকোলাসের ব্যাপারে কিছুই তিনি খুঁজে
পেলেন না। তদন্তকাজ ফ্লামেলের অনুকূলেই
গেল।
লোকচক্ষুর অন্তরালে ফ্লামেল কী করলেন
সেটা আমরা না জানলেও, এটুকু আমরা জানি,
ফ্লামেলের বাকি জীবনটা নির্বিঘ্নে কেটে
যায়। গবেষণা, দোকান থেকে বাসা, বাসা থেকে
দোকান... এই আর কী। একজন স্কলারের লাইফ
যেমন হবার কথা আর কী। রাসায়নিক উপাদান নিয়ে
নাড়াচাড়া, পুরোনো সব পান্ডুলিপি নিয়ে গবেষণা...
আর বৃদ্ধা স্ত্রীর সেবা।
স্ত্রী পেরেনেল মারা গেলেন আগে। তখন
নিকোলাসের বয়স হয়েছিলো ৮০ ; শেষ কটা
দিন ফ্লামেল আলকেমির বই লিখেই কাটালেন।
আর কবরস্থানে ঘুড়ে বেড়াতেন। তিনি খুব স্পষ্ট
করে লিখে দিলেন, তাঁকে কোথায় কীভাবে
কবর দিতে হবে। সেইন্ট ক্যাক্স লা বশেরির
শেষ মাথায়। তাঁর কবরের Tombstone আর
সেখানে কী লিখা থাকবে সেটাও প্রস্তুত
করে ফেললেন তিনি। সেই পাথরের ফলকে
থাকবে অনেক অনেক চিহ্ন, আর একটা সূর্যের
ছবি, একটা চাবির ছবি আর একটা বন্ধ বই এর ছবি।
প্যারিসের Musee de Clunyতে আজও সেটা
দেখা যায়।
নিকোলাসের একটা অভ্যাস ছিল, যখনই তিনি নতুন
কোন চার্চ বা হাসপাতাল বা কবরস্থান স্থাপন
করতেন, সেখানেই তিনি নিজের একটা ছবি
আঁকিয়ে নিতেন, হাঁটু গেড়ে আছেন এমন
অবস্থায়। প্রার্থনারত ভঙ্গি। এমনকি তিনি দুটো
ভাস্কর্য বানিয়ে নেন, একটা তরুণ বয়সের,
আরেকটা বৃদ্ধ বয়সের।
No photos in free mode
Use Data to See Photos
হাঁটুগেড়ে ফ্লামেল
সেকালে, অনেক সময়ই এমন হত মর্যাদাবান বা
সেইন্ট টাইপ কারো মৃত্যু হলে তাঁর কিছু
জিনিসপত্র সাথে কবর দেয়া হত। মূল্যবান
জিনিসপত্র। আর সেই জিনিস চুরি করতে আসতো
কবরচোররা। তাই নিকোলাস বলে যান, তাঁর
স্মরণে যেন বছরে ১২ বার ধর্মীয় অনুষ্ঠান
করা হয়। অর্থাৎ তিনি চেয়েছিলেন যে, তাঁর কবর
যেন তাঁকে মুখরিত, কেউ তাঁর কবরে হামলা
করতে না আসে। তিনি খুব পাকা আর ভারি
Tombstone অর্ডার করেন।
অবশেষে, একদিন জানা গেল, ফ্লামেল মারাই
গিয়েছেন। তবে তাঁর মৃতদেহের কোন
পাবলিক ডিস্প্লে হল না।
কিন্তু, মজার ব্যাপার, তিনি মারা যাবার আগেই, তাঁর
আলকেমির সাধনার কথা কীভাবে কীভাবে জানি
প্রচার হয়ে যায়। রটে যায়, তিনি সোনা
বানিয়েছেন, তাঁর কাছে অমরত্বের সুধা আছে,
কিন্তু তিনি ব্যবহার করেন না। তাঁর কাছে
Philosopher’s Stone তৈরির ফরমুলা আছে। সেই
ফর্মুলার লোভে, দূরদূরান্ত থেকে লোভী
মানুষ জড়ো হতে লাগলো। কারণ, তারা শুনেছে
সেই “বুড়ো ধনী আল্কেমিস্ট” মরতে
বসেছেন। এমন ধারণাও রটে গেল, যে, তাঁর
কবরের উপর আঁকা সেই চিহ্নগুলো decipher
করতে পারলেই পাওয়া যাবে সেই ফর্মুলা। কে
পারবে কোড ব্রেক করতে? সকল
আল্কেমিস্টের তীর্থস্থান হয়ে দাঁড়াল এই
প্যারিস। নিকোলাসের করা সকল মূর্তি আর ফলক
রাতের আঁধারে মানুষ ভেঙে নিয়ে যেতে
লাগলো। পাছে কোন ক্লু মিস হয়ে যায়...
কত লোভী মানুষ!
যাই হোক, দুটো শতক পার হয়ে গেল।
ষোড়শ শতক।
একজন “সম্ভ্রান্ত” লোক এসে প্রমাণ করলেন,
যে, তিনি একজন বিখ্যাত আল্কেমিস্টের বন্ধু, যিনি
মারা গেছেন মাত্র। মারা যাবার আগে তিনি নাকি উইল
করে গেছেন তাঁর সমস্ত টাকা যেন
ফ্লামেলের পরিত্যক্ত বাড়ি রিপেয়ার করা হয়।
সেই কাজটাই তিনি করতে এসেছেন মৃত বন্ধুর
স্মরণে। জ্যাক্স লা বশেলির বোর্ড তাঁর কথা
মেনে নিল আর বাড়ি রিপেয়ারের অনুমোদন
দিল। সেই লোক বাড়িতে ঢুকে পড়লেন
অনেক শ্রমিক নিয়ে। বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজে
বেড়ান তিনি, কিন্তু উল্লেখযোগ্য কিছুই খুঁজে
পেলেন না। কিন্তু এক জায়গায় হায়ারোগ্লিফিকে
কিছু আঁকা দেখলেন। আর কিছুই না। এই কি একজন
আল্কেমিস্টের বাড়ি?? কোন চিহ্নই নেই কিছুর।
শেষ পর্যন্ত তিনি চলে যান। শ্রমিকদের কোন
বেতন না দিয়েই। তখন বোর্ড বুঝতে পারে
সে আসলে ভণ্ড ছিল।
কিছুদিন পর জানা গেল, এক জার্মান ব্যারন নাকি
বাড়িতে কিছু টেস্টটিউবে লাল পাউডার আবিষ্কার
করেছেন যেটা লেজেন্ডে বর্ণিত
Philosopher’s Stone এর পূর্বরূপের অনুরূপ।
তবে, এর ক্ষমতা কম। খুব কম ধাতুকেই এটা
রূপান্তর করতে পারে।
মজার ব্যাপার, সেই পাউডার ব্যবহারের আগেই
“হাতছাড়া” হয়ে যায়। আর বাকি বাড়ি দেখে মনে
হল, কেউ যেন আগে থেকেই সুকৌশলে সব
কোথাও সরিয়ে নিয়েছেন, যেন তিনি জানতেন,
সবাই exactly কী খুঁজতে আসবে।
সপ্তদশ শতক আসতে আসতে সেই বাড়ির চার
দেয়াল ছাড়া বলতে গেলে আর কিছুই থাকলো
না।
আচ্ছা, সেই ইহুদী আব্রাহাম-এর বইয়ের কী
হল?? নিকোলাস তাঁর গবেষণার জিনিস দিয়ে যান তাঁর
ভাগ্নে/ভাতিজা পেরিয়ারকে। পেরিয়ার এরপর
আত্মগোপনে চলে যান আর এরপর তাঁর
সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। তবে তিনি নিশ্চয়ই
সেই পাণ্ডুলিপি হস্তান্তর করেছিলেন কাউকে না
কাউকে। কারণ, আবারও, রাজা ত্রয়োদশ লুই এর
সময় কিছু পৃষ্ঠা খুঁজে পাওয়া যায়।
“দুবো” নামের এক লোক, রাজার দরবারে
এসে সবার উপস্থিতিতে একটা সীসার বলকে
সোনা বানিয়ে দিয়ে সবাইকে তাক করে দেয়!
সাথে সাথে তাঁকে কার্ডিনাল রিশেলিও ডেকে
নেয়। এবং তাঁর কাছে, সেই বইয়ের পৃষ্ঠা আর
কিছু কিছু কাগজ পাওয়া যায়। তবে, সে বলে সে
আসলে কিছুই বুঝে নি এ বই এর। সে কিছু লাল
পাউডার “পেয়েছিল” যেটা দিয়ে এমন রূপান্তর করা
যায়। পরে তদন্ত করে দেখা যায়, এ লোকের
অতীতে অনেক ক্রাইম আছে, তাই তাঁর সকল
সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। ভিঞ্চেনেস এর
কারাগারে তাঁর যাবজ্জীবন হয়।
ঠিক এ সময়, এ ঘটনা প্রচার হবার পরেই, ডাকাতেরা
২০০ বছর আগের লেজেন্ড শুনে উজ্জীবিত
হয়ে নিকোলাসের কবরে আক্রমণ করে। চুরি
করার জন্য। কিন্তু, সমস্যা হল... দেখা গেল...
কবরের ভিতরে কফিন ছিল একদম ফাঁকা।
কদিন ফাঁকাই ছিল, কোন কালেই নাকি এখানে
কোন দেহ ছিল না। নিকোলাস যদি সেদিনই মারা
গিয়ে থাকেন, তবে তাঁর কবর এখানে হয় নি। এটা
ছিল একটা শো।
নিকোলাসের অস্তিত্ব নিয়ে কিছু জানতে পারল না
মানুষ, কে সুকৌশলে তাঁর সব জিনিসপত্র নিয়ে
গেল বাড়ি থেকে, সেগুলো কোথায়ই বা রাখল,
আর কেনই বা এমন করা হল, কোথা থেকে
নিকোলাস এত টাকা পেলেন, আর কেন তিনি এমন
কবর দেয়ার নাটক করালেন... তাঁর উত্তরাধিকারী
কে হল... সেই বই এর বাকি অংশ কে বা কাদের
তিনি দিয়েছিলেন?
লেজেন্ড আমাদের আরও কিছু জানায়... কিন্তু সব
তো এক পর্বের জন্য রেখে দিলে হয় না, তাই
না?
জানা যায়, সেই বইয়ের কিছু পৃষ্ঠা কার্ডিনাল
রিশেলিও নিজের কাছে রাখেন, তিনি একটা ল্যাব
বানান। কিন্তু তিনি কি পেরেছিলেন কিছু করতে?
পরে জানানো হবে।
কার্ডিনালের মারা যাবার পর সেই বই আলোর মুখ
দেখেনি। অন্তত আমরা জানি না আর কি। তবে,
বইটার সেই পেজগুলোর অনেক কপি করা হয়।
সেগুলো হয়ত পাওয়া কঠিন কিছু না।
সেই বই এর একটা কপির একটা পাতা দেখানোর
লোভ সামলাতে পারলাম না এই যে-->
No photos in free mode
Use Data to See Photos
কেমন লাগছে দেখতে? কিছু বুঝতে পারছেন
নাকি?
ফ্লামেল এর যে বাড়িটি প্যারিস এ আছে, সেটা
বর্তমানে প্যারিস এর সবচেয়ে পুরাতন stone
house... লুভর মিউজিয়াম এর কাছের একটি রাস্তার
নাম দেওয়া হয়েছে নিকোলাস ফ্লামেলের
নামে, আরেকটি রাস্তার নাম তাঁর স্ত্রীর নামে।
তাদের দুজনের মেমরিকে সম্মান দেখিয়ে।
No photos in free mode
Use Data to See Photos
আমরা কিন্তু কাহিনী বলতে বলতে সপ্তদশ
শতকে চলেই এসেছি।
আর এ শতকটা কার? মহাবিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক
নিউটনের। যার নাম জানে না এমন মানুষ কম। কিন্তু
এমন মানুষও কম যারা জানে নিউটন আসলে কতটা
passionate ছিলেন। তাঁর বিজ্ঞান সাধনাগুলো তো
আমরা জানিই। কারণ, সেগুলো প্রকাশ করা
হয়েছে। কিন্তু আমরা কি সবাই জানি, যে, নিউটন
Philosopher’s Stone নিয়ে বই লিখে গেছেন?
তাঁর ২০ বছরের সাধনা ল্যাবরেটরির আগুনে পুড়ে
যাবার পর তিনি ভেঙে পড়েন। তাঁর বেশিরভাগ
আল্কেমিকাল লেখা পুড়ে যায় সেই আগুনে।
বলা হয়, দুর্ঘটনাবশত তাঁর কুকুর Diamond সেই
আগুনের সুত্রপাত করে। তিনি আবারো কাজ শুরু
করেন।
No photos in free mode
Use Data to See Photos
আগুন লেগে যায় নিউটনের সব গবেষণায়
তাঁর লিখা গোপন রাখার আরেকটা কারণ ছিল, ১৬০৪
সালের ব্রিটেন পুনরায় আইন জারি করে, যে
কেউ জাদুবিদ্যা (আলকেমিও অন্তর্ভুক্ত) চর্চা
করবে, তাঁর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। কে প্রাণের ভয়
নিয়ে এটা প্রকাশ করবে?
আল্কেমিস্ট নিউটনের কাহিনী আসবে ইনশাল্লাহ
পরের পর্বে। এবং আপনি হয়ত বিস্মিত হবেন আর
বলবেন, নিউটন কী নিয়ে কাজ করা বাকি
রেখেছেন??
এবং, নিউটনের মাথায় “আপেল পড়া”র কাহিনী
আসলে কি সত্য? সেটাও একদম প্রমাণ আর
পান্ডুলিপির ছবিসহ তুলে ধরব।
লিওনার্দো দা ভিঞ্চিই বা কেন বাদ যাবে? তাঁর কথাও
লিখব। [আসলে এ নোটের wordlimit শেষ
হয়ে গেছে ৩৮৫০ শব্দ চলছে...]
আশা করি সিরিজের সাথেই থাকবেন। পরের
পর্বে থাকবে... নিউটনের আল্কেমিকাল
কাহিনী, লেজেন্ড আর ধর্মমতে মতে কিছু
দীর্ঘায়ু পাওয়া লোকের কাহিনী... আর
ক্রমান্বয়ে থাকবে, জাদুবিদ্যার উদ্ভব, আদি
ব্যবিলনিয়ান জাদুবিদ্যা থেকে শুরু করে আধুনিক
কাব্বালা (Kabbalah) ... ইহুদি-খ্রিস্টান-ইসলাম মতে
Angels vs Demons এর কাহিনী... সব...
ইনশাল্লাহ...
একটা কুরআনের আয়াতের ইংগিত, আমার একটা প্রিয়
ডায়ালগ, আর আলকেমির সাইকেল বলে পরিচিত
একটা ছবি দিয়ে দিয়ে শেষ করি
“প্রথম জাদুবিদ্যার শুরু হয়েছিলো ব্যবিলন
শহরে।” {সুরা বাকারা ২:১০২}
“History becomes Legend and Legend
becomes Myth.”


No comments

Note: Only a member of this blog may post a comment.

Powered by Blogger.