সুরা তালাক ৬৫:৪ এর ভুল ব্যাখ্যার জবাব / এম ডি আলী
প্রশ্নঃ সুরা তালাকের ৬৫:৪ আয়াতে শিশু বিয়ের কথা বলা হয়েছে কারন এখানে সেই সকল নারীদের মাসিক শুরু হয়নি তাদের ইদ্দত কাল ৩ মাস বলা হয়েছে - এর মানে ইসলাম শিশু বিবাহকে জায়েজ করে ?
লিখেছেনঃ এম ডি আলী
উত্তরঃ আসুন প্রথমে কুরানের আয়াত সম্পূর্ণ জেনে নেইঃ
* সুরা আত - তালাক ৬৫:৪ = তোমাদের যেসব স্ত্রীদের মাসিক হবার আশা নেই, তাদের ইদ্দত সম্পর্কে তোমরা সন্দেহ করলে তাদের ইদ্দতকাল হবে তিন মাস এবং যাদের এখনো মাসিক হয়নি তাদেরও।আর গর্ভবতী নারীদের ইদ্দতকাল সন্তান প্রসব করা পর্যন্ত।আল্লাহকে যে ভয় করবে, তিনি তার সমস্যার সমাধান সহজ করে দেবেন।
তাফসীর এবং হাদিসের ব্যাখ্যাঃ
* তাফসীরে আহসানুল বায়ান, সুরা তালাক ৬৫:৪ তাফসীর, পৃষ্ঠাঃ ৯৯৪: এ হল সেই মহিলাদের ইদ্দত যাদের বার্ধক্যের কারনে মাসিক বন্ধ হয়ে গেছে অথবা যাদের এখনো মাসিক শুরু হয়নি। জ্ঞাতব্য যে, বিরল হলেও এমনও হয় যে মেয়ে সাবালিকা হয়ে যায় অথচ তার মাসিক আসে না ।
* তাফহিমুল কুরআন , সুরা তালাক ৬৫:৪ আয়াত তাফসীরঃ ঋতুস্রাব যদি অল্প বয়সের জন্য না হয়ে থাকে অথবা কিছু সংখ্যক মহিলাদের অনেক দেরিতে হয়ে থাকে না থাকে এবং বিরত কিছু এমনও হয়ে থাকে যে সারাজীবন কোন স্ত্রীলোকের ঋতুস্রাব হয় না এরুপ সর্বক্ষেত্রে এরকম স্ত্রীলোকের ইদ্দত ঋতুস্রাব বৃদ্ধা স্ত্রীলোকের মত । অর্থাৎ তাদের ইদ্দত তালাকের সময় থেকে তিন মাস।
* তাফসীর ফি যিলালিল কুরআন, ২০ খণ্ড , পৃষ্ঠা ২৫৫ এবং ২৫৬: আর এখানে এই মেয়াদ বর্ণনা করা হয়েছে যাদের ঋতুর চির অবসান হয়ে গেছে এবং যেসব অপ্রাপ্তবয়স্কা কিশোরীর জন্য , এখনো যাদের আদৌ রজস্রাব শুরুই হয়নি । বলা হয়েছে, তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে যারা আর ঋতুবতী হবার আশা করে না , তাদের ব্যাপারে তোমরা সন্দিহান হলে তাদের ইদ্দত তিনমাস ।
* তাফসীরে ওসমানী , ৭ খণ্ড , পৃষ্ঠা ১৮৯ , সুরা তালাক এর ৪ নং আয়াতের তাফসীরঃ যদি সন্দেহ হয় যে ঋতু হয় না , বা বয়স হবার কারনে তা মওকুফ হয়ে গেছে , তবে তার ইদ্দত কি হবে ? সে সম্পর্কে বলা হয়েছে এমন নারীর ইদ্দত হবে তিনমাস।
* তাফসীরে আনওয়ারুল কুরআন, ৬ খণ্ড, সুরা তালাক এর ৪ নং আয়াতের তাফসীরঃ যাদের এখনো ঋতুস্রাব শুরু হয়নি তাদের ক্ষেত্রে ইদ্দত হবে ৩ মাস ।
* তাফসীরে ইবনে আব্বাস, ৩ খণ্ড, পৃষ্ঠাঃ ৫১৬: তোমাদের যে সকল স্ত্রীদের ঋতুবতী হবার আশা নেই বার্ধক্যের প্রেক্ষিতে তোমরা সন্দেহ করলে তাদের ইদ্দত সম্পর্কে সম্পর্কে সংশয়ে পড়লে তাদের ইদ্দতকাল হবে তালাকের ক্ষেত্রে তিন মাস । অতপর এক লোক দাড়িয়ে নবী মুহাম্মদ (সা) কে জিজ্ঞাসা করল, অপ্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার কারনে যে সকল স্ত্রী ঋতুবতী নয় , তাদের ইদ্দত কি হবে ? তখন নাযিল হল এবং যারা এখনো রজ্জসিলা হয়নি ও কুমারিত্তের কারনে যারা ঋতুবতী হয়নি, তাদের ইদ্দতও হবে তিনমাস ।
* তাফসীরে ইবনে কাসির, ১৭ খণ্ড, ৫৮৩ পৃষ্ঠাঃ যেসব নারীর বয়স বেশি হয়ে যাওয়ার কারনে মাসিক ঋতু বন্ধ হয়ে গেছে এখানে তাদের ইদ্দতের বর্ণনা দেয়া হচ্ছে যে, তাদের ইদ্দত হল তিনমাস, যেমন ঋতুমতি নারীদের ইদ্দত হবে তিন হায়েজ । একইভাবে যেসব অপ্রাপ্ত বয়স্কা মেয়েদের এখনো ঋতুস্রাব হয়নি তাদেরও ইদ্দত হবে তিন মাস । হযরত ইবাই ইবনে কাব (রা) বলেছিলেন, হে আল্লাহ্র রাসুল বহু স্ত্রীলোকের ইদ্দত এখনো বর্ণনা করা হয়নি । যেমন নাবালেগ মেয়ে, বৃদ্ধা এবং গর্ভবতী স্ত্রীলোকদের। তখন এই আয়াত নাযিল হয় ।
* তাফসীরে জালালাইন ৬ খণ্ড,পৃষ্ঠা ৫৮৮: হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা) রাসুলুল্লাহ (সা) কে জিজ্ঞাসা করেছেন , যে মহিলার হায়েজ হয় তার ইদ্দত সম্পর্কে তো জানলাম কিন্তু যাদের হায়েজ হয়না তাদের ইদ্দত কি রকম ? তখন এই (সুরা তালাক এর ৪ নং) আয়াত নাযিল হয়। (কাবির, কুরতুবি, ফাতহুল কাদির, রাওয়ায়ে)। এছাড়া উবাই ইবনে কাব (রা) বলেন হে রাসুলুল্লাহ কিছু মহিলা এমন রয়েছে যাদের ইদ্দত সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি, নবী মুহাম্মদ (সা) বলেছেন কোন কোন মহিলা সম্পর্কে ?তখন তিনি বললেন ছোট ও বড় (অর্থাৎ যাদের হায়েজ বন্ধ হয়ে গেছে) আর গর্ভবতী মহিলা । তখনই সুরা তালাক এর ৪ নং আয়াত নাযিল হয় । (কাবির, কুরতুবি, ফাতহুল কাবির) এছাড়া খালেদ ইবনে আন নোমান আনসারী (রা) বলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ যেসব মহিলাদের হায়েজ হয় না আর যাদের হায়েজ বন্ধ হয়ে গেছে এবং গর্ভবতী মহিলাদের ইদ্দত কি রকম ? তখন এই আয়াত তথা সুরা তালাকের ৪ নং আয়াত নাযিল হয় ।
* তাফসীরে তাওযিহুল কুরআন, ৩ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৬৭: যাদের বয়স বেশি হবার কারনে ঋতু আসা বন্ধ হয়ে গেছে তাদের ইদ্দত কি হবে ? এ আয়াতে তার জবাব দেয়া হয়েছে যে তাদের ইদ্দত হবে তিনমাস । এমনকি নাবালেগ মেয়ে যার এখনো ঋতু দেখা দেয়নি তার ইদ্দতও তিনমাস ।
একটি বাস্তবমুখী তথ্যভিত্তিক যৌক্তিক উদাহরণঃ
আমরা যদি প্রাচিন কালের দিকে দেখি বিবাহের ক্ষেত্রে তাহলে দেখতে পাব সেখানে মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দেয়া হত। এবং সেটা তখন একেবারেই নর্মাল একটি ব্যাপার ছিল । মজার ব্যাপার হল এই অল্প বয়সে বিয়ে শুদুমাত্র তখনকার সময়েই শুদু প্রচলিত ছিল না বরং বর্তমানেও, হ্যাঁ আমি আবারো বলছি বর্তমানেও এই অল্প বয়সে বিয়ে হয়, হবে , এখনো হচ্ছে। আরেকটি কথা হল আগের কালে অল্প বয়সে বিয়ে দেয়া হত আত্মীয়তার সম্পর্ক মজবুত করার জন্য - এর সাথে স্বামী স্ত্রীর সেক্স জড়িত না এখানে মুল বিষয় আত্মীয়তার বাধন ।
এরকমও হয় যে ১২ বছরের এক মেয়ে ৪০ বছরের এক পুরুষকে বিয়ে করেছে আবার এমনও হয় ৫৫ বছরের এক নারী ১৮ বছরের এক ছেলেকে বিয়ে করেছে । এখন আসল কথা তারা যদি তাদের এই সম্পর্ক নিয়ে খুশি থাকে এখানে আমি বা আপনি তাদের এই সম্পর্ক নিয়ে কথা বলার কে ? উত্তর হল আমরা কেউই না । কারন তারা তাদের সংসার নিয়ে খুশি আছে, তাদের পরিবার খুশি আছে এখানে কোন ক্ষতি হচ্ছে না, না মেয়ের না ছেলের, না ছেলের না মেয়ের ! ।
parental kidnapping in america: an historical and cultural analysis- by maureen dabbagh, page 128 এ উল্লেখ আছেঃ উনবিনশ শতাব্দীতে বেশিরভাগ অ্যামেরিকান রাজ্যে বিয়ের বয়সের সর্ব নিন্ম বয়স ছিল ১০ বছর এবং ডেলাওয়ারে বয়স ছিল মেয়েদের ৭ বছর । নিউইারক ১৮৮৫ সাল পর্যন্ত বিয়ের বয়স ছিল ১০ বছর । ১৮৮৫ সালের পর থেকে দেশের আইন "সম্মতি আইন" পরিবর্তন হয় ১৮৮৯ সালে । Newyork এ ১৬ বছর এবং ১৮৯৫ সালে হয় ১৮ বয়স । এই পরিবর্তনের আগে সম্মতির বয়স মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশির ভাগ স্থানে ১০ বা ১২ বছর ছিল বিয়ের বয়স । রেফারেন্স দেখুনঃ prostitution and sex work - by melissa hope ditmore, page: 21 {introduction}
অ্যামেরিকার সংবিধান তৈরিতে যেসব বইয়ের সাহায্য নেয়া হয়েছে তার মদ্ধে Spirit of laws বইটি অন্যতম । এই বইয়ের ১৬ খণ্ডে ২৬৪ পৃষ্ঠায় ফ্রেঞ্চ দার্শনিক Montesquew উল্লেখ করেন উষ্ণ অঞ্চলের মেয়েরা ৮,৯,১০ বছর বয়সেই বিয়ের জন্য উপযুক্ত হয়ে যায় আর ২০ বছর বয়সে তাদের বিয়ের জন্য বৃদ্ধ ভাবা হয় ।
এক কথায় উত্তরঃ
প্রশ্নঃ যদি অল্প বয়সে বিয়ে করার ফলে যদি একটি মেয়ের ক্ষতির আশংকা থাকে তাহলেও কি বিয়ে করা যাবে ?
উত্তরঃ না । ইসলাম কখনো মানুষের ক্ষতি চায় না ।
প্রশ্নঃ বাংলাদেশের আইনে ১৮ এর নিচে কোন মেয়ে বিয়ে করতে পারবে না , এই ব্যাপারে ইসলাম কি বলে ?
উত্তরঃ "আপনাকে ১৮ এর নিচে বিয়ে করতেই হবে নাইলে কবিরা গুনাহ অথবা জাহান্নামে যেতে হবে, অথবা "১৮ এর নিচে বিয়ে করা ফরজ" এই টাইপের কথা ইসলাম কখনো আপনাকে বলে না । বিয়ের আইনের বয়স একেক দেশে একে রকম , আমরা জানি নবী মুহাম্মদ (সা) একাধিক বিয়ে করেছিলেন আর তাঁর স্ত্রীদের বয়স যথাক্রমে ছিল ৪০,৬,৫০,২২,৩০,২৬ ইত্যাদি । সুতরাং এই বয়স গুলা থেকে এটা প্রমাণিত হচ্ছে যেহেতু একে দেশে একে রকম বিয়ের বয়স তাই বিয়ের ব্যাপারে বয়সের ক্ষেত্রে ভিন্নতা হতে পারে এটা স্বাভাবিক ।
উপরের সব তথ্য হাতে রেখে আমরা দাবী করছিঃ
১/ আয়াতে সেই সব নারীদের কথা হয়েছে যাদের বয়স বেশি হওয়ার জন্য হায়েজ বন্ধ হয়ে গেছে - এদের ইদ্দত সম্পর্কে ।
২/ যাদের অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছে তাদের হায়েজ এর ব্যাপারে সন্দেহ হলে - এদের ইদ্দত এর কথা হলা হয়েছে।
৩/ অনেক মেয়ে আছে যাদের বয়স ১৫ অথচ এদের হায়েজ হয় না আবার এমনও মেয়ে আছে যাদের বয়স ১২ তাদের হায়েজ শুরু হয়েছে । এখন এই ধরনের সংশয়ে পড়লে এদের ইদ্দত কি হবে সেই সম্পর্কেই আয়াতে বলা হচ্ছে ।
৪/ আয়াত অল্প বয়সের মেয়েদের বিয়ের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র উতসাহ দেয়া হয় নি উক্ত আয়াতে।
৫/ কিছু কিছু দেশে মেয়েদের বিয়ের বয়স কম আবার কিছু কিছু দেশে বেশি।
৬/ কেউ যদি তাদের সংসার নিয়ে সুখী হয় এখানে কারো কথা বলার অধিনার নাই ।
৭/ আরও মজার কথা হল যারা "ব্যাক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী" তারা সুরা তালাকের ৪ নং আয়াত নিয়ে আপত্তি করে মুলত স্বামী স্ত্রীর মধ্যকার ব্যাপারে হাত দিয়ে তারা মানবতা বিরোধী কাজ করছেন ।
No comments
Note: Only a member of this blog may post a comment.