'স্রষ্টা তত্ব' যদি সত্য হয়, তাহলে বিজ্ঞানীদের বেশিরভাগই কেনো নাস্তিক হয়? আরিফ আজাদ

'স্রষ্টা তত্ব' যদি সত্য হয়, তাহলে বিজ্ঞানীদের বেশিরভাগই কেনো নাস্তিক হয়?
খুব কমন এবং ইমপর্ট্যান্ট একটি প্রশ্ন। ইন্টারেস্টিংও বটে।
এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদের একটু ইন ডিটেইলস আলোচনা করতে হবে বেশকিছু ব্যাপারে।
প্রথমত, আমি সেই সময়ের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চায় যে সময়ে চার্চের পাদ্রীদের সাথে বিজ্ঞানের একটি বৈরি সম্পর্ক ছিলো। এক্ষেত্রে বিজ্ঞানী গ্যালিলিও'র সাথে ঘটা ঘটনাটা বেশ উল্লেখযোগ্য।
ইউরোপ-আমেরিকায় তখন ছিলো পাদ্রীদের যুগ। পাদ্রীদের যুগ বলছি এই কারণে যে, পাদ্রীরাই ছিলো তখন সমাজের সর্বেসর্বা। তারা যাই বলবে তাই 'ঠিক', তাদের বিপরীতে কেউ কিচ্ছু বললেই পেতে হতো ধিক্কার, লাঞ্চনা, গঞ্জনা এবং মৃত্যুদন্ডও। তারা যে কেবল সমাজে আধিপত্য বিস্তার করে বসে ছিলো, তা নয়। তারা সমানভাবে সে সময়ের বিজ্ঞানী মহলকেও নিয়ন্ত্রণ করতো। তো, বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে যখন পৃথিবীকেই সবকিছুর কেন্দ্র বলা হয়েছে, পাদ্রীদের কাছে সেটাই ছিলো ধ্রুব সত্যের মতোন। এমতাবস্থায়, গ্যালিলিও এসে যখন প্রচার করা শুরু করলো যে পৃথিবীই সবকিছুর কেন্দ্র নয়, আমাদের দৃশ্যমান সবকিছুর কেন্দ্র আসলে সূর্য, তখন খ্রিষ্টান পাদ্রী সমাজ গ্যালিলিওকে নিতে পারে নি। তারা গ্যালিলিওর উপরে নির্যাতন শুরু করে এবং তাকে তার মতবাদ প্রচার থেকে বিরত হতে বলে। কারণ, গ্যালিলিও যা প্রচার করছে সেটা সরাসরি বাইবেলের সাথে সাংঘর্ষিক।
মোটামুটি এরকমই ছিলো সেই পাদ্রী যুগের পরিবেশ। সেখানে যা কিছু অন্যরা বলতো, তা পাদ্রীদের মন রেখে বলতে হতো। পাদ্রীদের বিরোধিতা করে কেউ কিছু বলতে পারতো না। কেউ বললেই তাকে সমাজ থেকে বহিঃষ্কার করা হতো। নির্যাতন করা হতো।
মোটামুটি, পাদ্রীরা একপ্রকার স্বৈরাচারের ভূমিকায় ছিলো বলা যায়।
পাদ্রীরা এরকম করতো ২ টা কারণে।
এক- তারা যেহেতু সমাজে নিজেদের সর্বেসর্বা ভাবতো , তাই অন্যের মত যখন তাদের মতের উপরে প্রাধান্য পাবে, তখন সমাজ থেকে তাদের গ্রহণযোগ্যতা কমে যাবে।
দুই- তাদের একমাত্র জীবিকা নির্বাহ পদ্ধতিই ছিলো এটা। মানুষকে অন্ধ করর রেখে নিজেদের মতো করে আইন করে তারা ফায়দা লুটতো। এমতাবস্থায়, সত্য জানাজানি হয়ে গেলে মানুষ তাদের আর মান্য করবে না। ফলে, সমাজে তাদের ডোমিনেশান কমে যাবে। জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম বন্ধ হয়ে পড়বে ইত্যাদি।
আপনি হয়তো ভাবছেন, আমি এতোসব গল্প বলছি কেনো, তাই না?
জ্বী। এই গল্প বলার কারণ হলো, পাদ্রীদের সেই যুগ সময়ের বিবর্তনে শেষ হলেও, আমরা ঢুকে পড়েছি আরেকটি পাদ্রীদের যুগে। আগের যুগে পাদ্রীগণ ধর্মের দোহাই দিয়ে মানুষকে কব্জা করলেও, বর্তমানের পাদ্রীগণ মানুষকে বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে কব্জা করে রেখেছে।
আরেকটু ক্লিয়ার করি। আমাদের বর্তমান বিজ্ঞান জগতকে (আরো ক্লিয়ারলি, বিজ্ঞান এ্যাকাডেমিয়াকে) আষ্টেপৃষ্ঠে আছে বস্তুবাদীরা (Materialistics)।
বস্তুবাদ হচ্ছে নাস্তিক্যবাদের একটি প্রধানতম শাখা।
আগেকার সময়ে, সমাজ থেকে বিজ্ঞান মহল- সবকিছুতেই যেমন পাদ্রীরা ডোমিনেইট করতো, বর্তমানে সমাজ থেকে বিজ্ঞানমহল- সবকিছুতে ডোমিনেইট করে এইসব ভোগবাদী, বস্তুবাদীরা।
আমেরিকার 'ন্যাশনাল এ্যাকাডেমী অব সায়েন্স' এর মেম্বারদের মধ্যে ৯০% হচ্ছে এই বস্তুবাদীরা।
আপনি বলতে পারেন, এটার সাথে বিজ্ঞানীদের নাস্তিক হবার কি সম্পর্ক?
সম্পর্ক আছে। বস্তুবাদ তথা ভোগবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার স্পন্সর করা হয় প্রতিনিয়ত।
বস্তুবাদের সাথে ধর্মের বেসিক ডিফারেন্স হচ্ছে- ধর্ম আপনাকে এই জীবনটাই শেষ জীবন নয়। মৃত্যুর পরে আরেকটি জীবনের কথা বলে। সুতরাং, ধর্ম মেনে চলতে গেলে আপনাকে ধর্মের নির্দিষ্ট কিছু রুলস, কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়। ধর্ম মানলে আপনার জীবনে আপনার ইচ্ছাই শেষ ইচ্ছা হয় না। আপনাকে সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতে হয়।
এই প্রাধান্য দিতে গিয়ে, আপনি চাইলেই 'যেমন খুশি তেমন' ভাবে চলতে পারেন না। অবাধ, অবৈধ সেক্স করতে পারেন না, মদ খেতে পারেন না, অবাধ মেলামেশা করতে পারেন না ইত্যাদি।
কিন্তু বস্তুবাদ আপনাকে বলে- এই জীবনটাই শেষ জীবন। মৃত্যুর পরে আসলে কিচ্ছু নেই। সুতরাং, জীবনটাকে যেমন খুশি এনজয় করো।
এইজন্যে, নাস্তিকদের অন্যতম প্রধান গুরু Richard Dawkins বলেছেন,- 'There is no God. So enjoy your life'..
মূলত, বস্তুবাদ প্রচারের অন্যতম কারণ হচ্ছে ব্যবসায়িক। বিশাল একটি অংশ যখন স্রষ্টা আছে জেনে ধর্ম পালন শুরু করবে, তখন তাদের ব্যবসায়িক বিরাট লস হবে।
আপনি যখন স্রষ্টার ভয়ে মদ খাবেন না, ফ্রি সেক্স করবেন না, সুদ খাবেন না, ঘুষ নিবেন না, দূর্নীতি ইত্যাদি করবেন না- তখন বস্তুবাদীদের ব্যবসায়ে লাল বাতি জ্বলবে। সুতরাং, বস্তুবাদ প্রতিষ্টার অন্যতম কারণ হচ্ছে- ব্যবসায়িক।
এখন, বর্তমান বিজ্ঞান জগত হচ্ছে এই বস্তুবাদীদের দখলে।
সুতরাং, চালকের আসনে যখন বস্তুবাদীরা, তখন বর্তমান বিজ্ঞান জগত আর বিজ্ঞানীদের কাজই হলো যেভাবে হোক, নাস্তিক্যবাদ তথা বস্তুবাদ প্রতিষ্ঠা করে ধর্মের কবর রচনা করা। এরজন্য যা যা করা দরকার, তার সবটাই এই বস্তুবাদীরা করবে।ঠিক পাদ্রী সম্প্রদায়ের মতোন।
বর্তমান বিজ্ঞান এ্যাকাডেমির আন্ডারে যারা কাজ করে, যারা রিসার্চ করে- তারা যদি স্রষ্টায় বিশ্বাসী হয়েও থাকে, তবুও তারা তা মুখ ফুটে কখনোই বলতে পারে না।
কারণ, যদি তারা স্বীকার করে আর প্রচার করে, তাহলে বস্তুবাদীদের নিয়ন্ত্রিত এ্যাকাডেমিয়া থেকে সেই বিজ্ঞানীকে ঘাঁড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবে।
অন্তত, রুটি-রুজি, সম্মান, প্রফেশন রক্ষার তাগিদে হলেও তাদেরকে বস্তুবাদীদের মন জুগিয়ে চলতে হয়। তাদের কথামতো কাজ করতে হয়।
দু একটি উদাহরণ দিই। বস্তুবাদ, নাস্তিক্যবাদ তথা বিবর্তনবাদ যদি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, তাহলে সমাজে ন্যায় - অন্যায়ের মধ্যে কোন ফারাক থাকবে না। ধর্ষণ, খুন, হত্যা ইত্যাদি আর অপরাধ বলে বিবেচিত হবে না। এগুলোকে সময়ের বিবর্তনে, বিবর্তনের ধারায় জাস্ট 'Adaptive' হিসেবে ধরা হবে। বেশকিছুদিন আগে এইসব বিবর্তনবাদীরা মানব শরীরে 'Crime Gene' টাইপ কিছু একটার অস্তিত্ব নির্ণয়েরও চেষ্টা চালিয়েছে।
Crime Gene হচ্ছে এমন একপ্রকার জীন, যা আমাদের ক্রাইম (অন্যায়) করতে উদ্বুদ্ধ করে থাকে। অর্থাৎ, মানুষ যে খুন, রাহাজানি, ধর্ষণ করে, সেসব সে নিজের ইচ্ছাতে করে না। তার মধ্যে এই জীন থাকলেই সে এসব করে। যেহেতু এটা জেনেটিক্যালি হয়, সেহেতু এটা কোন অপরাধ নয়।
ভাবতে পারছেন এদের দূরভিসন্ধী? যদি এই Crime Gene তত্ত্ব সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে দেওয়া যায়, তাহলে পৃথিবীতে আর কোনকালেই ধর্ষণকে অন্যায় বলা যাবে না, খুন কে অন্যায় বলা যাবে না। মোদ্দাকথা, যা ইচ্ছা করো- সমস্যা নাই।
এমন একটা পৃথিবী যদি হয় তা কেমন হবে ভাবুন।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, পাদ্রীরা শক্তির বলে একসময় এসব করে বেড়াতো, আর বস্তুবাদীরা এখন বিজ্ঞানমহল দখল করে, বিজ্ঞানের নাম দিয়ে এসব করে বেড়ায়।
এই ব্যাপারে বিস্তারিত জানার জন্য বিবর্তনবাদী রন্ডি থর্নহিল এবং ক্রেইগ পালমানের বই 'Natural History Of Rape' বইটা পড়া যায় যেখানে ধর্ষণকে অপরাধ না বলে, বিবর্তনের ধারায় Adaptive বলে চালানো হয়েছে।
শুধু এটা নয়। সমকামিতাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যও এরা মানবশরীরে Homo Gene নামের একধরনের জীনের অস্তিত্ব নির্ণয়েরও খুব প্রচেষ্টা চালিয়েছে এবং এখনো চালাচ্ছে। অর্থাৎ, সমকামিতাও যে অপরাধ নয় এবং এটাও যে একটা জেনেটিক্যাল ব্যাপার- সেটা প্রতিষ্ঠা করা।
সমস্যা হচ্ছে, কিছু সৎ বিজ্ঞানী এবং সৎ দার্শনিকদের জন্য তারা এগুলো গেলাতে পারে না মানুষকে।
বিজ্ঞান মহলকে বস্তুবাদীরা এতোটাই চেপে ধরে আছে যে, যখনই তারা কোন Creationist Scientist এর নাম শুনে, তখন নাক সিটকিয়ে বলে- উহু, Creationist কিভাবে আবার সাইন্টিস্ট হয়?'
(আমাদের বাঙলা নাস্তিকরা যেমন বলে- 'আরে! মোল্লা আবার বিজ্ঞানের কি বুঝে,হুহ?')
বিবর্তিনবাদীদের একসময়ের নেতা, Jullian Huxley কে এক টক শো তে Merv Griffin জিজ্ঞেস করলেন, 'Why do people believe in evolution?'
তিনি উত্তরে বলেছিলেন,- “The reason we accepted Darwinism even without proof, is because we didn’t want God to interfere with our sexual mores”
উনি বললেন, - 'প্রমাণাদি ছাড়াই বিবর্তনবাদকে আমরা মেনে নিয়েছি কারণ- আমরা আমরা চাই না যে স্রষ্টা আমাদের সেক্সুয়াল ম্যাটারগুলোতে নাক গলাক'
আগেই বলেছিলাম, বিবর্তনবাদ তথা নাস্তিকতা প্রতিষ্ঠা মানেই- অবাধ যৌনাচারের সার্টিফিকেট।
একসময়ের তুখোঁড় নাস্তিক Lee Strobel তার 'Case For Faith' বইতে লিখেছেন, - “I was more than happy to latch onto Darwinism as an excuse to jettison the idea of God so I could unabashedly pursue my own agenda in life without moral constraints.”
অর্থাৎ, বিবর্তনবাদ মেনে নিয়ে স্রষ্টাকে জীবন থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দেওয়ার নেপথ্য কারণ ছিলো- মোরাল ভ্যালু যেন তার জীবনে বাঁধা হয়ে না দাঁড়াতে পারে (অর্থাৎ, বস্তুবাদ মেনে নিলে আপনি যেমন খুশি তেমন জীবন উপভোগ করতে পারবেন)।
শেষ কথা হলো, বিজ্ঞানীদের অধিকাংশেরই এ্যাকাডেমিয়াতে তাদের নিজের মত প্রকাশের স্বাধীণতা নেই। তাদেরকে উপরের মহল থেকে সবসময় একটা চাপে রাখা হয়। তাই, চাইলেও তারা চাকরি, সম্মান, পদ মর্যাদা ধরে রাখতে বলতে পারেনা- I do believe in God...
এটি কি শুধু বিজ্ঞান এ্যাকাডেমিয়ার দৃশ্য? নাহ। এটি পুরো পৃথিবীর দৃশ্য। জোর যার, মুল্লুক তার।
একটি মজার ঘটনা উল্লেখ করি। ঘটানাটাকে কেউ পলিটিক্যালি নিবেন না, অনুরোধ রইলো।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাবস্থায় দেখেছি- সেখানে ছাত্রশিবিরের একটা দাপট ছিলো একসময়। হল থেকে শুরু করে ক্যাম্পাস- সবখানে।
একটা সময় পরে, ছাত্রলীগ এসে ছাত্রশিবিরের কাছ থেকে কর্তৃত্ব নিয়ে নেয়।
এরপরে, যে ছেলেগুলো শিবির করতো, তাদের অধিকাংশকেই আবার ছাত্রলীগের মিটিং-মিছিলে যেতে দেখা গেলো।
কেনো এমন হলো? Yes, Just to survive...
থাকতে হলে আপনাকে করতেই হচ্ছে। নো ওয়ে।
ঠিক এভাবেই, বর্তমান বিজ্ঞানী মহলে 'বিজ্ঞানী' হিসেবে টিকতে হলে আপনাকে নাস্তিক হতেই হচ্ছে। মন থেকে না হোক, অন্তত, মুখ থেকে নাস্তিক না হলে বিজ্ঞান এ্যাকাডেমিয়াতে আপনার দুই পয়সারও মূল্য নেই।
(পিয়ার রিভিউ জার্নাল বলে বাঙলা নাস্তিকরা সবসময় মুখে ফেনা তুলে। এরপর লিখবো পিয়ার রিভিউ জার্নাল নিয়ে আদতে সাইন্স এ্যাকাডেমিয়াতে কী হয়)

No comments

Note: Only a member of this blog may post a comment.

Powered by Blogger.