ছোট বেলার ভাবনা.....আরিফ আজাদ
ছোট বেলার ভাবনাঃ
আরিফ আজাদ
ছোটবেলা থেকেই ‘মাফিয়া’ শব্দের প্রতি আমার একধরণের ঝোঁক কাজ করতো। কাদের মাফিয়া বলা হয়, এরা আসলে কি করে ইত্যাদি ইত্যাদি জানার জন্যে বুকের ভেতরটা আঁকুপাকু করতো। তাছাড়া, ডিটেক্টিভ সিরিজের বইপত্রে বুঁদ হয়ে থাকতাম বলেই বোধহয় এই শব্দটার প্রতি আলাদা একটা আগ্রহ জন্মেছিলো। বইতে পড়তাম, আমার প্রিয় চরিত্রটা কতো বুদ্ধি খাটিয়েই না মাফিয়াদের চক্র ভঙ্গ করে বেরিয়ে আসতো। কখনোবা ভেদ করতো মাফিয়াদের রহস্যজাল। সে যাহোক, বড় হতে হতে আমি বুঝতে পারলাম যে মাফিয়া তারাই যারা ক্ষমতা হাতে পেয়ে অন্ধ হয়ে যায়। নিজেকে ছাড়া আশপাশকে তারা থোড়াই কেয়ার করে।
ছোটবেলায় আমার সমবয়সীরা কল্পনায় সুপারম্যান, স্পাইডারম্যানদের ছবি আঁকতো, আর আমি আঁকতাম মাফিয়াদের ছবি। বোছা নাক। ঝাউ গাছের মতো খাড়া চুল। তিমি মাছের মতো শরীরওয়ালা মাফিয়াগুলোকে কল্পনায় আমি নাস্তানাবুদ করে ছাড়তাম।
যখন আমি ইউনিভার্সিটিতে উঠলাম, তখন দেখা পেলাম একদল সত্যিকার মাফিয়াদের। এরা আমার কল্পনায় আঁকা মাফিয়াদের মতো ছিলোনা। বোছা নাক ছিলোনা, ঝাউ গাছের মতো চুল কিংবা তিমির মতো বৃহদাকার শরীর কোনোটাই এদের ছিলোনা। এরা আমার মতোই। গায়ে ভদ্র পোশাক। কাঁধে ব্যাগ। কারো কারো চোখে চশমা। এরা হলো ক্যাম্পাসের মাফিয়া। ক্যাম্পাসজুড়ে এদের রাজত্ব। ক্যাম্পাসের ত্রাস। অবশ্য, এদের আবার ‘মাফিয়া’ নামে ডাকা যায়না। ক্যাম্পাসে এরা ‘বড় ভাই’ হিশেবে পরিচিত।
ইউনিভার্সিটিতে একটা নতুন ছাত্র যখন ভর্তি হয়, তাকে জিম্মা হতে হয় এরকম কোন না কোন ‘বড় ভাই’ নামক মাফিয়ার কবলে। সেই ‘বড় ভাই’ এর হাতেপায়ে ধরে হলে সিট পাওয়া লাগে। ‘বড় ভাই’ এর নির্দেশনা মেনে ক্যাম্পাসে হাঁটতে হয়, চলতে হয়। ক্যান্টিনে খেতে গেলে কোন বড় ভাই যদি এসে পড়ে, অমনি আধ-খাওয়া অবস্থা থেকেই উঠে গিয়ে সালাম দিতে হয়। নিজের জায়গা ছেড়ে বড় ভাইকে বসতে অনুরোধ করতে হয়। বড় ভাই ফিক করে হেসে দিয়ে সুদক্ষ রাজনীতিবিদের মতো হাত নেড়ে বলেন, ‘সব ভালো তো?’ অমনি, হাসি হাসি মুখ করে বলতে হয় ‘জি ভাইয়া’।
ডিপার্টমেন্টের বড় ভাইরা তো আরো কয়েক কাঠি সরেশ। তারা কমনরুমে এসে বসলে সে রুমে জুনিয়র কেউ সাধারণত থাকতে পারেনা। কমনরুমে কেউ শব্দ করে পড়লে তারা বেজায় বিরক্ত হোন বটে, কিন্তু নিজেরা নিজেদের প্রেমিকা নিয়ে কমনরুমে বসে মৌজ-মাস্তি করলে সেটা আপনাকে চুপ করে দেখে যেতে হবে।
ডিপার্টমেন্টে কোন অনুষ্ঠান হলেই এরা থাকে পরিচালকের চেয়ারে। জুনিয়রদের উপরে সকল দায়-দায়িত্ব বন্টন করে এরা শুধু হুকুম জারি করে যান। আর, বেচারা জুনিয়রদের তাদের কথায় ‘জি ভাইয়া’ ‘জি ভাইয়া’ করে যেতে হয়।
ডিপার্টমেন্টে কোন অনুষ্ঠান হলেই এরা থাকে পরিচালকের চেয়ারে। জুনিয়রদের উপরে সকল দায়-দায়িত্ব বন্টন করে এরা শুধু হুকুম জারি করে যান। আর, বেচারা জুনিয়রদের তাদের কথায় ‘জি ভাইয়া’ ‘জি ভাইয়া’ করে যেতে হয়।
ইউনিভার্সিটিগুলোতে এটা একটা চিরাচরিত নিয়ম। আজকে যে ছেলেটা জুনিয়র, অন্য কোন বড় ভাইয়ের অধীনে চলছে, আগামীকাল সে-ই হয়ে উঠছে বড় ভাই। এদের পরীক্ষার রেজাল্ট যতো রসগোল্লাই হোক না কেনো, ডিপার্টমেন্ট আর ক্যাম্পাসে এদের অমান্য করেছেন তো আপনার তেরোটা বাজিয়ে দেবে এই মাফিয়াগুলো। এসবকিছুর সাথে যদি যোগ হয় রাজনৈতিক ক্ষমতা, তাহলে তো আর কথাই নেই।
আমার বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা খবর পড়লাম আজ। এরকম মাফিয়াদের ঘটনা। নতুন ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসা এক পরীক্ষার্থী উঠেছিলো সোহরাওয়ার্দী হলের ১৪০ নম্বর রুমে। সেই রুমে যখন এরকম কিছু ‘বড় ভাই’ নামক মাফিয়া ঢুকলো, তখন নাকি ওই পরীক্ষার্থী তাদের উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দেয়নি। ‘কেনো উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিলো না’ এটার জন্যে ওই ছেলেটাকে এই বড় ভাইগুলো হলের ছাদে তুলে শার্ট খুলে আচ্ছামতো মার দিয়েছে। তাকে জিজ্ঞেস করেছে, ‘পরীক্ষা কেমন হলো?’ ছেলেটা বলেছে, ‘আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো’।
আলহামদুলিল্লাহ্ কেনো বললো সেটাও দোষ। আলহামদুলিল্লাহ্ বলায় ছেলেটা নাকি শিবির হয়ে গেছে। বললো, ‘অ্যাই, আলহামদুলিল্লাহ্ বললি ক্যানো? তুই তো শিবির করছ’।
কি একটা আইকিউ এই সমস্ত বড় ভাইদের! ‘আলহামদুলিল্লাহ্’ বললে কেউ নাকি শিবির হয়ে যায়। আরে ভাই, আলহামদুলিল্লাহ্ বলাতে ছেলেটা শিবির হয়ে থাকলে, ও সালাম না দেওয়ায় তোমরা যে ওরে পিটাইলা, তোমরা তো তাহলে কড়া জামাতী। ওর কাছ থেকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ আশা করবা, আবার সে ‘আলহামদুলিল্লাহ্’ বললে পিটুনি দিবা, এই আইকিউ দিয়া তোমাদের রাজনীতি করতে কে বলেছে?
এটাই হচ্ছে ক্যাম্পাসের মাফিয়াতন্ত্র। তুমি রাজনীতি করো, বিশ্ববিদ্যালয়ের থার্ড-ফোর্থ ইয়ারে পড়ো বইলাই কি তোমারে আমার উঠে দাড়াইয়া সালাম দেওয়া লাগবে? যদি না দিই, তুমি আমারে মারধর করবা? হাউ কিউট!
আলহামদুলিল্লাহ্ কেনো বললো সেটাও দোষ। আলহামদুলিল্লাহ্ বলায় ছেলেটা নাকি শিবির হয়ে গেছে। বললো, ‘অ্যাই, আলহামদুলিল্লাহ্ বললি ক্যানো? তুই তো শিবির করছ’।
কি একটা আইকিউ এই সমস্ত বড় ভাইদের! ‘আলহামদুলিল্লাহ্’ বললে কেউ নাকি শিবির হয়ে যায়। আরে ভাই, আলহামদুলিল্লাহ্ বলাতে ছেলেটা শিবির হয়ে থাকলে, ও সালাম না দেওয়ায় তোমরা যে ওরে পিটাইলা, তোমরা তো তাহলে কড়া জামাতী। ওর কাছ থেকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ আশা করবা, আবার সে ‘আলহামদুলিল্লাহ্’ বললে পিটুনি দিবা, এই আইকিউ দিয়া তোমাদের রাজনীতি করতে কে বলেছে?
এটাই হচ্ছে ক্যাম্পাসের মাফিয়াতন্ত্র। তুমি রাজনীতি করো, বিশ্ববিদ্যালয়ের থার্ড-ফোর্থ ইয়ারে পড়ো বইলাই কি তোমারে আমার উঠে দাড়াইয়া সালাম দেওয়া লাগবে? যদি না দিই, তুমি আমারে মারধর করবা? হাউ কিউট!
পরীক্ষা দিতে আসা একটা নতুন পরীক্ষার্থী যখন রেহায় পায় না এদের স্বৈরাচারীতা থেকে, তখন এদের নিয়ন্ত্রনে থাকা জুনিয়র ছেলেপিলেগুলোর অবস্থা চিন্তা করেন।
বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, ডিপার্টমেন্টের স্যারেরাও এসব গুন্ডাগুলোকে ভয় পায়। এদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে পারেনা। স্যারদের কেউ যদি প্রতিবাদ করে, তাহলে তার কপালে খুবই দুঃখ থাকে। হয় ক্যাম্পাসে স্টুডেন্টদের সামনে অপমানিত হতে হবে এই মাফিয়া দলের দ্বারা, নয়তো প্রশাসনকে বলে চাকরি খেয়ে দিবে।
বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, ডিপার্টমেন্টের স্যারেরাও এসব গুন্ডাগুলোকে ভয় পায়। এদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে পারেনা। স্যারদের কেউ যদি প্রতিবাদ করে, তাহলে তার কপালে খুবই দুঃখ থাকে। হয় ক্যাম্পাসে স্টুডেন্টদের সামনে অপমানিত হতে হবে এই মাফিয়া দলের দ্বারা, নয়তো প্রশাসনকে বলে চাকরি খেয়ে দিবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের চারপাশে যে নারী হয়রানি, চাঁদাবাজি, ছিনতাই-রাহাজানি হয় তার বেশিরভাগ করে থাকে এই ‘বড় ভাই’ নামক এই মাফিয়াগুলোই। সারাদিন মদ, গাঁজা আর ফেন্সিডিল সেবন করে বেড়ানো এই বড় ভাইগুলোর হাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন একপ্রকার জিম্মি বলা চলে।
ক্যাম্পাসটা যেন রাষ্ট্রের ভিতর আরেক টুকরো রাষ্ট্র। এখানে এই মাফিয়াদের জন্য আইন নেই। সরকার নেই। আদালত নেই। ক্যাম্পাসে ওরাই আইন বানায়। ওরাই সরকার এবং ওদেরই আদালত। এই বড় ভাই নামধারী মাফিয়াগুলোর কাছে জিম্মী হয়ে থাকে পুরো ক্যাম্পাস। ভুক্তভোগি সাধারণ শিক্ষার্থীরা। যে ছেলেটা পরীক্ষা দিতে এসে মার খেয়েছে, অপমানিত হয়েছে, পরীক্ষা দিতে পারেনি- তার ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোন ব্যবস্থা নিবে? কখনোই না। এভাবেই টিকে থাকে মাফিয়াতন্ত্র। ‘বড় ভাই’ নামক চেহারায় নিত্যনতুন ‘মাফিয়া’ দেখতে দেখতে একটা সময় আমরা ক্যাম্পাসের পাঠ চুকিয়ে চলে আসি। কিন্তু, বড় ভাইদের এই মাফিয়াতন্ত্র থামেনা। তৈরি হয় নতুন নতুন বড় ভাই। ঘটতে থাকে নতুন নতুন ঘটনা।
No comments
Note: Only a member of this blog may post a comment.