ভাবুন একটু! / আরিফ আজাদ

(১)
১৯ শে মার্চ, ২০১৭।
বাংলাদেশের ঐতিহাসিক শততম টেষ্ট ম্যাচে জয়।
ক্রিকেটের বিভিন্ন ক্যাটাগরি আছে। T20 হলো যুবক ক্যাটাগরির। ODI হলো মধ্যবয়স্ক ক্যাটাগরির আর Test হলো মুরুব্বি ক্যাটাগরির।
খুব সহজে একটা দেশ টেষ্ট মর্যাদা পায়না। বাংলাদেশও পায়নি। অনেক কাঠখড় পুঁড়িয়ে বাংলাদেশকে অর্জন করতে হয়েছে এই মর্যাদা। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একসময়ের বুলবুল,বাশারদের ব্যাটিং-বোলিং নৈপুণ্য আমাদের এই মর্যাদা এনে দিয়েছিলো। সেই টেষ্ট মর্যাদা নিয়ে প্রতিবেশী কতোজনের কতো কানকথা, কটু কথাই যে আমাদের সহ্য করতে হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। কখনো আমাদের ক্রিকেটীয় জ্ঞান নিয়ে ব্যঙ্গ, কখনো আমাদের ক্রিকেটীয় শক্তি নিয়ে রসিকতা সহ অনেককিছুই হয়েছে। অনেকবার তারা দাবি তুলেছিলো আমাদের টেষ্ট মর্যাদা কেড়ে নেওয়ার। লাঞ্চনা, গঞ্জনা, অপমান পেরিয়ে, হাঁটি হাঁটি করে আমরা এসে পৌঁছেছি ১০০ এর ঘরে। আস্তে আস্তে আমরা শিখে গেছি প্রতিপক্ষকে কিভাবে ব্যাটে-বলে হাত উচানির বদলে চোখ রাঙানি দিতে হয়। আমরা তৈরি করেছি বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার। আমরা ধীরে ধীরে পরিণত হয়েছি। এখন আমরা স্রেফ খেলতে নামি না। আমরা এখন সমানে সমানে লড়াই করে জিততে নামি।
(২)
এইমাত্র OT থেকে বের হলেন হাসনাত সাহেব। একটা পেশান্ট ছিলো মারাত্মক রকমের ইঞ্জুরড। ট্রাকের সাথে ধাক্কা লেগে শরীরের একপাশ থেঁতলে গেছে। এরকম পেশান্টের অপারেশান তিনি এই প্রথম করলেন। ভয়ে বুক ধুঁকপুক করছিলো।
তবু, ভালোই ভালোই অপারেশান শেষ করলেন।
অপারেশান শেষ করে তিনি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হলেন। অন্যান্য সময় হলে তিনি এই মূহুর্তে বেশ কয়েক ঘণ্টা রেস্ট করতেন।ঘুম দিতেন। এরকম ভয়ানক অপারেশান করার পরে ডাক্তারের অবস্থাও রোগির মতো হয়ে যায়। তারউপর OT তে সেই ডাক্তারটা যদি নতুন হয় তাহলে তো কথাই নেই।
কিন্তু হাসনাত সাহেব ফ্রেশ হয়ে সোজা টিভি রুমে চলে এলেন। কারণ, আজ বাংলাদেশের খেলা আছে। শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে। আগ্রহটা আরো বেশি জায়গা দখল করে আছে, কারণ - এটি বাংলাদেশের শততম টেষ্ট ম্যাচ।
ক্রিকেট আমাদের একটা আবেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাঙালি হিসেবে, হাসনাত সাহেবও এর বাইরের নন। অন্য সবার মতোন বাংলাদেশের আজকের শততম টেষ্ট ম্যাচ নিয়ে উনার আশা- আকাঙ্ক্ষা তাই একটু বেশিই। তারউপর, দল যখন ভালো পজিশনে, তখন প্রত্যাশার পারদটা আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেছে।
হাসনাত সাহেব খুব মনোযোগ দিয়ে খেলা দেখছেন। শেষ দিনের খেলা আজ। তামিম যখনই লং অনে শট নিতে যায়, হাসনাত সাহেবের হার্টবিট যেন বন্ধ হয়ে যায়। ঠোঁটে ঠোঁট কামড়ে ধরে চোখ জোড়া বন্ধ করে থাকে। মনে হয় যেন- 'এই বুঝি সব শেষ।'...
সব শেষ হয়না। সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশ তাদের শততম টেষ্টে তুলে নেয় নবম জয়।
মানবজমিন পত্রিকা তৎক্ষণাৎ হেড লাইন করে- 'লঙ্কায় বাংলাকান্ড।'
হাসনাত সাহেব সোফা থেকে লাফ দিয়ে উঠে সোজা হাসপাতাল বারান্দার দিকে দৌঁড় দেন। আরো বেশকিছু রুম থেকে হাত তালি আর আনন্দোল্লাসের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।সবার মাঝেই মূহুর্তে নেমে এলো ঈদের আমেজ। হবেই তো। বাংলাদেশের 'লঙ্কা বিজয়' বলে কথা। তাও আবার তাদের মাটিতে।
হাসনাত সাহেব উনার ফেইসবুকে লগ ইন করলেন। উনি এই মূহুর্তে এতো পরিমাণ খুশি যে, OT'র ক্লান্তির লেশমাত্র আর শরীরে নেই। খুশির চোটে উনি কি লিখবেন ভেবেই পাচ্ছেন না। শুধু লিখলেন,- 'Proud Of you Team Bangladesh.... Congratulation.....'
(৩)
মঈন সাহেব।দেশের একটি প্রথম সারির ব্যাংকের ম্যানেজার। খুব একটা যে খেলাধুলা দেখেন তা নয়। কিন্তু আজ বাংলাদেশ খেলছে তাদের শততম টেষ্ট। আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু এটাই।
তিনি একটু পর পরই খেলার আপডেট দেখছেন।
মোসাদ্দেক ছেলেটাকে তিনি তেমন চিনেন না।বললেন, 'আরে, নয়া পুলাডা তো জম্পেশ খেলে।'
দিনের শেষ মূহুর্তে মোসাদ্দেকরা যখন জিতে যায়, মঈন সাহেব টেবিলে হাত চাপড়িয়ে বলে উঠলেন, 'Yessssss! We've done it......'
আজ, লঙ্কায় মোসাদ্দেকরা একা নন। মঈন সাহেবরাও আজ বাংলাদেশ।
মঈন সাহেব অনেকদিন হয় ফেইসবুকে যান না। কাজের চাপে যাওয়া হয়না। আজ উনি ফেইসবুকে এলেন। এসে লিখলেন, 'মোসাদ্দেকরা জিতলে জিতে যায় বাংলাদেশ।'
(৪)
রোমান। তামিম ইকবালের পাগলা ফ্যান। তামিমকে কেউ কিছু বললেই তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে সে। তামিমের দূর্দান্ত ইনিংস এবং বাংলাদেশের শততম টেষ্টে জয় আজ তাকে দ্বিগুণ আনন্দ এনে দিলো। আহা!
সে আজ তামিম হেটারদের খোঁচায় নি। সব ভুলে আজ সেও আনন্দ মিছিলে শামিল।
(৫)
ফারিয়া। ফেইসবুকে সেলফি আপলোড করাই তার একমাত্র কাজ। বিভিন্ন অনুষ্ঠান, ভ্রমণ ইত্যাদিতে গিয়ে সেলফি তুলে তাতে ডজনখানেক বান্ধবিকে ট্যাগ করতে পারা পর্যন্তই তার ফেইসবুক লাইফ। যে মেয়ে ছবি আপলোড দেওয়া ছাড়া কিছুই জানেনা, সেও বাংলাদেশের জয়ের পরে ফেইসবুকে লিখলো- 'Yaaaahooo we won it....'
(৬)
নাজমুন আরা বেগম। একজন নারীবাদী। নারীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন নিয়েই থাকেন। মিছিল, মিটিং, সভা,সেমিনার- সবখানেই জ্বালাময়ী বক্তব্য দিয়ে সবাইকেই চাঙ্গা করে রাখতে পারেন।
বাংলাদেশের এই জয় আজ তিনিও খুব উপভোগ করেছেন। দুপুর থেকে সারাক্ষণ টিভির সামনে ঠাঁই বসে ছিলেন। পুরো সময়টা জুড়েই মোবাইল সাইলেন্ট করে রেখেছেন। ইতিহাসের সাক্ষী হতে যাওয়া এরকম সময়ে ফোন কলের উপদ্রব সহ্য করার মানে হয় না।
জয়ের পর এই ব্যস্ত মহিলা নেত্রীও উল্লাসে ফেঁটে পড়েন। ফেইসবুকে লিখেন, 'অভিনন্দন বাংলাদেশ।'
শুধু তাই নয়, বাংলাদেশী খেলোয়াড়েরা পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী থেকে ফোন কল। স্বনামধন্য সকল শীর্ষ পর্যায়ের সেলেব্রেটিরা বাংলাদেশ দলকে জানিয়েছে শুভেচ্ছা বার্তা। বিসিবি বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের ১ কোটি টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দিলো।
পত্রিকাগুলো ভাসিয়েছে প্রশংসার জোয়ারে। প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় খুশির বন্যা।
গত কয়েকদিন আগেও যে সাংবাদিক কোচ হাতুরে সিংহের চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করে ছেড়েছিলো, সেও আজ হাতুরে সিংহের জন্য শিরোনাম করলো- 'Hero, behind the screen'.....
(৭)
১৯ শে মার্চ, ২০১৭।
একইদিন। একইসময়। একই ক্ষণ।
ভারতীয় পত্রিকা The Times Of India একটি খবর ছাপিয়েছে। শিরোনাম- 'Gang-Rape: Minor Bangladeshi girl accuses 14 of rape'
ধর্ষণের সংবাদ। বিস্তারিত অংশে যা লেখা হলো তা এরকম, '১৪ বছর বয়সী এক বাংলাদেশী বালিকা আত্মীয়ের ফাঁদে পড়ে ভারতে পাচার হয়ে যায়। পাচারকারীদের মাধ্যমে সে আহমেদাবাদে পৌঁছে। সেখানে প্রথমে তাকে ৭ জন পুরুষ মিলে গণ ধর্ষণ করে।
এরপর তাকে পাঠানো হয় ম্যাঙ্গালোরে। সেখানে তাকে ধর্ষণ করে ১৪ জন পুরুষ। একসপ্তাহের মধ্যে এই ১৪ বছরের বালিকা মোট ২১ জনের হাতে গণ ধর্ষিত হয়। পরে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। জুনাগড়ে তাকে রাস্তায় কাঁদতে দেখে পুলিশ স্টেশনে পাঠানো হয়। ভাষাগত জটিলতায় তার সমস্যা বুঝা যাচ্ছিলো না। পরে, সেখানকার এক মহিলা আশ্রমে নিয়ে একজন দো-ভাষীর সহায়তায় তার কাছ থেকে বিস্তারিত জানা যায়।
দুটি ঘটনা একই দিনের। একটি বাংলাদেশের ক্রিকেটের ঐতিহাসিক জয় নিয়ে, অন্যটি একটি বাংলাদেশী বালিকার ধর্ষণের ঘটনা।
OT থেকে হন্তদন্ত হয়ে বের হওয়া হাসনাত সাহেব কি এই মেয়েটার ব্যাপারে জানেন? উনি কি এই ঘটনা শুনে রেগে ফেঁটে পড়েছেন? দু চার কলম লিখে মনের ঝাল মিটিয়েছেন?
ক্রিকেট নিয়ে তার যে উন্মাদনা, সেটা কি মেয়েটার ব্যাপারেও আছে?
ব্যাংক ম্যানেজার মঈন সাহেব। খুবই ব্যস্ত লোক। তবুও, ব্যস্ততার মাঝেও মোসাদ্দেকের ব্যাটিং আপডেট নিচ্ছিলেন, তামিমের শট দেখছিলেন। দেখছিলেন সাব্বিরের মারকাট ব্যাটিং পারফরমেন্স। আচ্ছা, একই দিনের ঘটনায় উনি ঠিক কতোবার ভারতে ধর্ষিত বাঙালি মেয়েটার খোঁজ নিয়েছেন? সাত দিনে একুশ জনের কাছে ধর্ষিত হওয়া সেই বালিকাটা কেমন আছে তার কোন আপডেট মঈন সাহেব নিয়েছেন? মেয়েটা এখন কোথায়, কি করছে এসবের খোঁজ খবর নেওয়ার প্রয়োজন, সময়, ইচ্ছে কি মঈন সাহেবের ছিলো?
তামিমের সেই পাগলা ফ্যান, যে আজ সব ভুলে বাংলাদেশের জয় উদযাপন করছে, তার কাছে এই খবর পৌঁছেছে কি? পৌঁছালে তার রি-একশান কি হবে?
ফারিয়া। ছবি আপলোড দেওয়া ছেড়ে যে আজ বাংলাদেশের জয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে একলাইন লিখেও ফেললো, সে কী জানে ঠিক তার মতোই,তারই দেশের এক মেয়ে, সাত দিনে ২১ জনের কাছে ধর্ষিত হয়েছে?
নারীবাদী নাজমুন আরা বেগম কি জানেন যে তিনি যে সময়ে বাংলাদেশের জয় উদযাপন করছেন, ঠিক সে সময় বাংলাদেশের একটি মেয়ে গণ ধর্ষিত হয়ে মূমুর্ষ অবস্থায় পড়ে আছে? তিনি কি এটা নিয়ে কোন বিক্ষোভ মিছিল করবেন? মাইকে গলা ফাঁটাবেন? এই মেয়েটার জন্য কি উনার জ্বালাময়ী শব্দগুলো আরেকবার গলা দিয়ে বেরুবে?
প্রধানমন্ত্রী জানেন এই সংবাদ? কোন দুঃখ প্রকাশ? কোন পদক্ষেপ?
কোন সেলেব্রেটির ক্ষোভ? কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠান কি মেয়েটার চিকিৎসার জন্য কোন অনুদান পাঠাবে?
বাংলাদেশের কোন টেলিভিশন, পত্রিকা এটা হেড লাইন করেছে?
নাহ! কেউ কিচ্ছু করেনি। করার দরকার মনে করেনি। কারণ, এরকম ১৪ বছরের বালিকা প্রতিদিনই গণ ধর্ষিত হচ্ছে, কিন্তু বাংলাদেশ তো আর প্রতিদিনই টেষ্ট জিতছে না। সাকিব প্রতিদিনই তো আর সেঞ্চুরি করেনা। মোসাদ্দেকরা কি আর প্রতিদিন জ্বলে উঠে? নাহ। আমাদের বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার আছে। আমাদের আছে এখন শক্তিশালী একটি দল। আমাদের ক্রিকেট আছে। আবেগ আছে। ধর্ষণ তো সে রোজ হয়, ১০০ তম টেষ্টে কী প্রতিদিন জয় পাওয়া যায়? যায় না।
So, let's celebrate cricket.....

No comments

Note: Only a member of this blog may post a comment.

Powered by Blogger.