'তোমায় ভালোবাসি, হে আমার সহধর্মিণী'/ আরিফ আজাদ

বিবাহের আগে শেষ যেবার বাড়িতে গিয়েছিলাম, সেবার হাতে বেশকিছু দিন ছুটি ছিলো।
বাড়ি আসার আগে আম্মা বারবার ফোনে জিজ্ঞেস করতেন কতোদিনের জন্য আসছি। আমি বলতাম, - 'এই হবে সপ্তাহখানেক।'
আমার উত্তর শুনে ফোনের ও'পাশে আম্মা চেঁচিয়ে উঠতেন। বলতেন,- 'তোমাকে না বলেছি হাতে বেশি সময় নিয়ে আসতে? একসপ্তাহ দিয়ে কী হবে?'
এক সপ্তাহ। মানে, পুরোপুরি সাত সাতটা দিন।
সাত দিনে কী না করা যায়? আমেরিকা হিরোশিমার বুকে ইতিহাসের ভয়াবহ পারমাণবিক বোমাটা ছুঁড়ে মারতে সময় নিয়েছে কয়েক সেকেন্ড মাত্র। এতেই পৃথিবীর রূপ উলট-পালট হয়ে গেছে অনেকটাই। আর, আমার আম্মার কাছে সাতদিন একেবারেই নাকি কম।
যাহোক, আমি আম্মাকে বলতাম, - 'অফিসের নিয়মই এটাই। ৭ দিনের বেশি ছুটি কাটানো যায় না।'
আম্মা নাছোড়বান্দা! বলে,- 'অতশতো বুঝি না! একমাস নাহোক, পনের-বিশদিনের ছুটি নিয়ে হলেও আসো।'
গোটা পনের-দশেক ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। চাকরিজীবনে এরপূর্বে এতো দীর্ঘ ছুটি নিয়েছি বলেও মনে পড়ে না।
টানা চার বছর পরে বাড়ি ফিরছিলাম। মনে অদ্ভুত একটা প্রশান্তি কাজ করছিলো তখন। সারাদিন খোলা আকাশের নিচে খাবারের খোঁজে হন্যে হওয়া পাখিটা সন্ধ্যেবেলায় নীড়ে ফেরার সময় যেরকম সমস্ত ক্লান্তি, অবসাদ বাতাসেই বিলীন করে আসে, সেরকম আমিও সারাবছরের কাজের চাপ, মানসিক অশান্তি, চিন্তা- সবকিছুই যেন ইট আর পাথরের শহরে বন্ধক রেখে ফিরছি। নির্মল খুশিতে মাতোয়ারা আমার মন।
আমার শৈশবের মাঠ, নদী, দীঘি, বিল- সবকিছুই তখন আমাকে চুম্বকের মতোই টানছে। মায়ের ভালোবাসা আর বাবার আদরের পরমাত্মার এক অকৃত্রিম টান আমি খুব দূর থেকেও অনুভব করতে পারছি যেমনটা অনুভব করেছিলেন ইয়াকুব আলাইহিস সালাম ইউসুফ আলাইহিসসালামকে ফিরে পাওয়ার আগ মূহুর্তে।
বাড়িতে আসার পরেরদিন ছিলো আমার জন্য একটা চমক।
অপরিচিত কিছু লোক বাবার সাথে সোজা আমাদের অতিথি কক্ষে এসে বসলেন। এদের আগে কখনো দেখেছি বলে মনে পড়েনা আমার।
খুচরা আলাপ এবং আপ্যায়ন পর্ব শেষ হবার পরে বাবা আমাকে ডাক দিলেন বসার ঘর থেকে। আমি তখন জানালার পাশে, শুয়ে শুয়ে Jeffrey Archer এর 'Father's Last Sin' পড়ছিলাম। জানালার ও'পাশে, বাইরে হাসনাহেনা ফুল ফুটে সাদা হয়ে আছে। হাসনাহেনার গন্ধে পুরো রুম মৌঁ মৌঁ করছিলো।
বাবা আমায় ডাক দিয়ে ভিতরে যেতে বললেন।
আমি আড়মোড়া ভেঙে উঠে, কোনমতে শার্টটা গায়ে দিয়ে, চশমাটা চোখে লাগিয়েই হাঁটা দিলাম বসার ঘরের দিকে।
রুমে ঢুকেই সালাম দিলাম। বাবা বললেন, - 'বসো।'
আমি সোফার এক পাশটায় জড়োসড়ো হয়ে বসলাম। মাথার চুল উস্কোখুস্কো।
বাবা ব্যবসায়িক মানুষ। পড়াশুনা কম বলে হিসাবপত্রে প্রায়ই গণ্ডগোল পাকিয়ে বসেন।যখন বাড়িতে ছিলাম, তখন বাবার হিসাবপত্র আমিই দেখতাম। তখন এরকম ডিলাররা এসে বাসায় বসতেন। বাবা আমাকে ঠিক এভাবেই ডাক দিতেন। আমি ভোঁ দৌঁড়ে চলে আসতাম। বাবাকে খুব ভয় পেতাম কিনা, তাই।
বাবা বললেন, - 'এ হলো আমার ছেলে।'
উপস্থিত ভদ্রলোকগুলো আমার চেহারার দিকে ভারি অদ্ভুতভাবে তাকালেন। ডিটেক্টটিভরা যেরকম সন্দেহভাজন কারো দিকে তাকান, সেরকম। আমি কেমন ভ্যাঁবাচ্যাকা খেলাম। অস্বস্তি লাগছিলো। চৈত্রের তাবদাহে চারদিক তখন শুকিয়ে কাঠ হবার জোগাড়। আমার গলাও পানিবিহীন দিঘীর মতো শুকিয়ে গেলো সেই মূহুর্তে।
উপস্থিত লোকদের একজন বললো,- 'বাবা, তোমার নাম?'
আমি খুবই নিঁচু স্বরে উত্তর দিলাম,- 'সাদিকুল ইসলাম সাবিত।'
তারা আর কিছুই জিজ্ঞেস করেনি। বাবা আমায় বললেন,- 'যাও।'
আমি বাধ্য ছেলের মতো উঠে এসে আবার Jeffrey Archer এর 'Father's Last Sin' এ ডুব দিলাম। জানালা দিয়ে তখনও ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ছে হাসনাহেনার মাতাল করা গন্ধ.......
সেদিন রাতে বুঝতে পারলাম যে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। পাত্রীপক্ষের আমাকে দেখে পছন্দ হয়েছে। আমার পরিবারও পাত্রীকে পছন্দ করেছে।
সবাই রাজি। আম্মা আমার মতামত জানতে চাইলেন। আমি বরাবরের মতোই নিশ্চুপ ছিলাম। নীরবতা সম্মতির লক্ষণ জেনে সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেছে।
ছোটবেলায় রবী ঠাকুরের 'হৈমন্তী' গল্পে অপুর কথা মনে আছে? তার বিয়ে ঠিক হবার পরে দূর সম্পর্কের কোন এক পিসির কাছেই সে হৈমন্তির একটি ফটোগ্রাফ দেখেছিলো কেবল।
আমিও যে এমন একটা সময়ে এসে অপুর ভূমিকা নিয়ে নেবো, সে কথা কে-ই বা জানতো!!
আমার ছোট বোনের কাছে পাত্রীর একটি ফটোগ্রাফ জমা ছিলো। যদিও সেটি হৈমন্তি গল্পের মতোন আনাড়ি কারো হাতে তোলা না। বেশ দক্ষ হাতের ছোঁয়া আছে বুঝা যায়।
ফটোগ্রাফটি আমি দেখেছিলাম। ঠিক সেই মূহুর্তে আমার মনের মধ্যে একটা শিহরণ জাগার কথা ছিলো। কিন্তু, আমি তখনও নির্বাক ছিলাম। এমন নয় যে, বাবা মার পছন্দ করা পাত্রী আমার পছন্দ হয়নি। ব্যাপার হলো- আমার যে বিয়ে হবে, এটাই তখনো আমার বিশ্বাস হচ্ছিলো না।
ঠিক এক সপ্তাহের মাথায় আমার বিয়ে হলো। মেয়েটার নাম ফাতিমা।
স্বভাবতই আমি খুবই লাজুক প্রকৃতির ছিলাম। ফাতিমা সামনে আসতেই আমি লজ্জায় জড়ো হয়ে পড়তাম। ব্যাপারটা যে কেবল আমার সাথেই ঘটতো, এমন না। খেয়াল করেছি, ঠিক একই ব্যাপার ফাতিমার সাথেও ঘটতো। সেও আমার সামনে এলে ভীষণরকম অস্বস্তিতে ভুগতো। যেন দৌঁড়ে পালাতে পারলেই বাঁচে।
দু'জন দু'জনকে বিয়ের আগে চিনতাম না। হঠাৎ একটা বন্ধন আমাদের দু'জনকে এক করে দিলো। এই হঠাৎ মেলবন্ধনের দূরত্বটা দু'জনের কেউ তখনো আমরা কাটিয়ে উঠতে পারিনি।
বিয়ের সাতদিন পরেই আমি চাকরিস্থলে ফিরে আসি। এই সাতদিনে ফাতিমার সাথে আমার খুব কমই কথা হয়েছে। আমি কথা বলার চেষ্টা করলেই সে কাঁচুমাচু শুরু করতো। মাঝে মাঝে হ্যাঁ, হু করতো, নয়তো মাথা নাড়তো।
আমি বুঝতে পারি, বিয়ের মাধ্যমে সম্পূর্ণ নতুন এক মানুষ, নতুন এক পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে আমাদের দু'জনেরই খুব সময় দরকার।
চাকরিস্থল থেকে আমি দিনে দু'বার করে আম্মাকে ফোন দিতাম। কথা বলার পরে আম্মা ফোনটা ফাতিমার হাতে দিয়ে সরে আসতেন। ফাতিমাকে আমি সালাম দিতাম। সে সালাম নিতো বুঝতে পারতাম। আমি জিজ্ঞেস করতাম,- 'কেমন আছেন?'
(সম্পূর্ণ নতুন একজনকে 'তুমি' করে বলার জন্য তখনও আমি প্রস্তুত ছিলাম না)।
ফাতিমা খুবই ছোট্ট স্বরে বলতো,- 'ভালো।'
আমি জানি সেও জানতে চায় আমি কেমন আছি। কিন্তু জিজ্ঞেস করতে পারে না। জড়তা কাজ করে।
একবার ফোন এলো বাড়ি থেকে। আম্মা জানালেন ফাতিমার খুব জ্বর।
ফাতিমার অসুস্থতার কথা শুনে আমার বুকের ভেতরটা ধপ করে উঠলো। একটা অদৃশ্য কষ্ট অনুভব হলো। এটা কীসের? এমন হলো কেনো?
তার সাথে তো অল্প কিছুদিন আগেই আমার বিয়ে হয়েছে। দু'জন দু'জনকে পুরোপুরি বুঝেও উঠতে পারিনি তখনো। তাহলে? এই কষ্ট লাগা কিসের?
আমি বাড়িতে ফোন করা বাড়িয়ে দিই। একটু পর পর ফাতিমার খোঁজখবর নেওয়া শুরু করি। সে কেমন আছে, খাচ্ছে কি না, ঘুমাচ্ছে কি না, ঔষুধ নিচ্ছে কি না ইত্যাদি....
আমি বুঝতে পারি একটা অদৃশ্য, অস্পর্শ টান তৈরি হয়েছে আমার তার প্রতি। আমার একটা অংশ হয়ে উঠছে সে দিনে দিনে....
একবার ঈদে বাড়ি ফিরছিলাম। হঠাৎ, দূর্ভাগ্যবশঃত আমাদের গাড়িটার অন্য একটা গাড়ির সাথে ধাক্কা লাগে। কারো কোন প্রাণের ক্ষতি না হলেও আমরা বেশ কয়েকজন মারাত্মক রকম ইঞ্জুরড হই। আমাকে হসপিটালে ভর্তি করানো হয়। আমি তখন দেখেছি, আমার মা, বাবা, বোনের পরে আরো একজন মেয়ে ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে আমার জন্য কাঁদছে। তারও চোখজোড়া জবা ফুলের মতো লাল। কতো রাত যে ঘুমায় নি কে জানে!
এই মেয়েটার নাম ফাতিমা। সম্প্রতিই আমাদের বিয়ে হয়েছে। সে লজ্জায় আমার সাথে কথাই বলতে পারে না। তাহলে? আমার জন্য সে কেনো কাঁদছে? সে কী বুঝতে শুরু করেছে আমাকে? সে কি বুঝতে শুরু করেছে আমাদের মধ্যকার আত্মিক টান? হয়তো.....
ফাতিমা যখন কনসিভ করে, তখন আমি আবারও লম্বা ছুটি নিয়ে চলে আসি বাড়িতে।
আমার মনে আছে, তার যখন ডেলিভারি হবে, তখন সে জোরে জোরে চিৎকার করে কাঁদছিলো প্রসব বেদনায়।
আমি দিগ্বিদিক ছুটছিলাম। তার কান্নার শব্দে আমার চোখ দিয়েও অঝোর ধারায় পানি ঝরছিলো। বারবার আল্লাহকে বলছিলাম তাকে শেফা দিতে। তার কান্নার শব্দ, স্বর আমার বুকে যেন তীরের মতোন বিঁধে যাচ্ছিলো। সেই সময়টুকু যেন আমার জীবনের এক মহাকালরাত্রি! খুব করে চাইছি কেটে যাক।
আমি আল্লাহকে বলছিলাম, - 'হে আল্লাহ! ফাতিমাকে ধৈর্য্য দাও! ধৈর্য্য দাও।'
আমি অনুভব করলাম, আমি ফাতিমাকে ভালোবাসি। সে আমার জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। তাকে ছাড়া আমার চলবে না। আমি আরো অনুভব করলাম, ফাতিমাও আমাকে ভালোবাসে। আমাকে ছাড়াও তার চলবে না। আমরা দু'জনে একে অন্যের পরিপূরক।
এই যে এই নারী, তাকে তো আমি চিনতাম না। তবে কেনো তার জন্য আমার এতো ভালোলাগা? এতো ভালোবাসা? এতো প্রেম? এতো দরদ? এতো মায়া?
আমি স্মরণ করি আল্লাহর সেই আয়াত-
'তাঁর নিদর্শনের মধ্যে হল এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য হতেই তোমাদের সঙ্গিণী সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমরা তার কাছে শান্তি লাভ করতে পার আর তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। এর মাঝে অবশ্যই বহু নিদর্শন আছে সেই সম্প্রদায়ের জন্য যারা চিন্তা করে।'- আর রূম, ২১
'তোমায় ভালোবাসি, হে আমার সহধর্মিণী'/ আরিফ আজাদ

No comments

Note: Only a member of this blog may post a comment.

Powered by Blogger.