'নিয়্যাত- আমল কবুলের শর্ত'/ আরিফ আজাদ

আবু হুরায়রা (রাঃ)-কে একবার জিজ্ঞেস করা হলো, 'আপনি আমাদের এমন একটি ব্যাপারে বলুন যেটা আপনি রাসূল (সাঃ) এর মুখ থেকে শুনেছেন'।
তিনি বললেন, 'আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেছেন, যুদ্ধে নিহত হয়েছে এমন ব্যক্তিকেই সর্বপ্রথম কিয়ামতের মাঠে হাজির করা হবে। তাকে যখন আনা হবে তখন আল্লাহ ওই ব্যক্তিকে তাঁর নিয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দিবেন। লোকটা আল্লাহর নিয়ামতের কথা মনে করে কৃতজ্ঞতা জানাবে। এরপর আল্লাহ তাকে জিজ্ঞেস করবেন, 'এগুলো (আল্লাহর নিয়ামত - যেমন হাত, পা এসব) দিয়ে তুমি কি করেছো?'
লোকটা বলবে, 'আমি শহীদ হওয়ার আগ পর্যন্ত আপনার সন্তুষ্টির জন্যই জিহাদ করেছি'।
আল্লাহ বলবেন, 'তুমি মিথ্যে বলছো। তুমি এজন্যই লড়াই করেছো যাতে লোকে তোমাকে সাহসী, বীর উপাধি দেয়। এবং তোমাকে দুনিয়ায় বীর উপাধিও দেওয়া হয়েছে।
তারপর ফেরেশতাদের আদেশ করা হবে তাকে টানতে টানতে জাহান্নামে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
এরপর, এমন লোককে ডাকা হবে, যে জ্ঞান অর্জন করেছে, জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছে এবং কোরআন পাঠ করেছে। এরপর তাকে আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ামত (যেমন- জ্ঞান) সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হলে সে এগুলোর শুকরিয়া জ্ঞাপন করবে।
তারপর তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, 'এই নিয়ামত তুমি কোন কাজে লাগিয়েছো?'
সে বলবে, 'আমি জ্ঞান অর্জন করেছি, জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছি এবং কোরআন পাঠ করেছি কেবল আপনার সন্তুষ্টির জন্যই'।
তখন আল্লাহ বলবেন, 'তুমি মিথ্যে বলছো। তুমি জ্ঞান অর্জন করেছো যাতে লোকে তোমাকে জ্ঞানী (শায়খ, স্কলার) বলে ডাকে। এবং দুনিয়ায় তোমাকে তা-ই ডাকা হয়েছে'।
এরপর ফেরেশতাদের আদেশ করা হবে তাকে টানতে টানতে জাহান্নামে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
এরপরে, আল্লাহ দুনিয়ায় প্রচুর প্রাচুর্য দিয়েছেন এমন ব্যক্তিকে ডাকা হবে। তাকে দেওয়া আল্লাহর নিয়ামত সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হলে সে শুকরিয়া জ্ঞাপন করবে। এরপর তাকে বলা হবে, 'তোমাকে দেওয়া সম্পদ তুমি কোন কাজে লাগিয়েছো?'
সে বলবে, 'আপনি সন্তুষ্ট হোন এমন সব কাজে আমি দান-সাদ্বাকা করেছি। আমি কেবল আপনার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই এসব করেছি'।
আল্লাহ বলবেন, 'তুমি মিথ্যে বলছো। তুমি এসব করেছো যাতে লোকে তোমাকে বলে- দেখো, লোকটা কতো উদার, কতো মহৎ। দুনিয়ায় কিন্তু তোমাকে তা-ই বলা হতো'।
এরপর আল্লাহ ফেরেশতাদের আদেশ করবেন তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করার জন্য।
[ সহীহ মুসলিম। ১৯০৫ নম্বর হাদীস]
এই হাদীসে লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, একজন জিহাদীকে, একজন স্কলার/শায়খকে, একজন ধার্মিক দানবীর ব্যক্তিকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করার কথা আছে। এখানে কিন্তু একজন মদখোর, যিনাখোর, একজন সুদখোরের কথা বলা হচ্ছে না।
একজন জিহাদী, যিনি জিহাদ করেছেন ঠিক, কিন্তু তার নিয়্যাত যদি সহী না থাকে, তার এই জিহাদ যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে না হয়ে নিজেকে অন্যের কাছে 'বীর', 'সাহসী' প্রমাণের জন্য হয়, তাহলে আখিরাতে তার জন্য রয়েছে আযাব।
আবার একজন শায়খ, একজন স্কলার, যিনি উঠতে-বসতে ফতোয়া দেন, মানুষকে দ্বীনি দিক-নির্দেশনা দেন, যিনি মানুষকে দ্বিনী জ্ঞানার্জনে উদ্বুব্ধ করেন, তাকেও জাহান্নামে নিক্ষেপ করার কথা আছে যদিনা তার নিয়্যাত সহী হয়।
তার সকল জ্ঞানার্জন, সকল স্কলারিক কাজ, কথাবার্তা যদি হয় মানুষের কাছ থেকে 'শায়খ' 'আল্লামা' 'স্যার' উপাধি পাওয়া, তাহলে দুনিয়ায় হয়তো সে এসব অর্জন করবে। দুনিয়ার মানুষ হয়তো তাকে উঠতে-বসতে শায়খ ডাকবে, আল্লামা উপাধিতে ভূষিত করবে। কিন্তু অন্তরের খবর তো জানেন আসমানের মালিক। তিনি সেদিন তার এই মিথ্যেটা প্রকাশ করে দিবেন, আর ফেরেশতাদের আদেশ করবেন সেই শায়খকে টেনে টেনে জাহান্নামে নিয়ে যেতে। সেদিন কিন্তু শায়খের ফ্যান-ফলোয়ার কোন কাজে আসবে না। সেদিন রাজত্ব কেবল আল্লাহরই।
এরপর, এমন ধার্মিক দানশীল, যিনি দু'হাত ভরে আল্লাহর রাস্তায় দান করে গেছেন সারাজীবন। কিন্তু হায়! তার দানের কানাকড়িও কবুল হবে না যদি না তার নিয়্যাত হয় লোকের কাছ থেকে বাহবা পাওয়া আর নিজেকে উদার প্রমাণ করা। এমন দানশীল ব্যক্তিকেও কিয়ামতের ময়দান থেকে টানতে টানতে জাহান্নামে নিয়ে যাওয়া হবে।
আমাদের বুঝতে হবে, আমাদের কর্মফল নির্ভর করে আমাদের নিয়্যাতের উপর। আমি কি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জ্ঞান অর্জন করি এবং জ্ঞান শিক্ষা দিই? নাকি মানুষ আমাকে বড় বলুক, জ্ঞানী বলুক, কথায় কথায় 'শায়খ', 'স্যার', 'হুজুর' বলার জন্যে জ্ঞান অর্জন করি?
আমি কি আল্লাহর রাস্তায় নিজেকে 'বীর' 'সাহসী' প্রমাণের জন্য জিহাদে যাই? নাকি, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে? আমি কি নিজেকে 'দানবীর' 'দানশীল' 'মহৎপ্রাণ ধার্মিক' প্রমাণের জন্য দান করি? নাকি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে?
'নিশ্চয়ই বান্দার সকল আমল তার নিয়্যাতের উপর নির্ভরশীল'।
বান্দা যা নিয়্যাত করবে, তা-ই সে পাবে। সে যদি দুনিয়া কামনা করে, তাকে তা-ই দেওয়া হবে। সে যদি আখিরাত কামনা করে, তাকে হয়তো দুনিয়া-আখিরাত দুটোই, অথবা আখিরাত দেওয়া হবে।
একই হাদীসের শেষাংশে বলা হচ্ছে- ' বান্দা যা নিয়্যাত করে, তাকে তা-ই দেওয়া হবে। সুতরাং, কেউ যদি দুনিয়া লাভের আশায় অথবা কোন মহিলাকে বিয়ে করার নিয়্যাতে হিজরত করে, তার হিজরত সেই কাজের জন্যই গৃহীত হবে'।
[ সহীহ বুখারী। হাদীস-০১]
আমাদের প্রতিদিনকার কর্মে আমরা কি নিয়্যাত করছি সেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহর সন্তুষ্টির নিয়্যাতে অল্প আমল হয়তো নাযাতের উসিলা হয়ে যাবে, কিন্তু নিয়্যাত যদি কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে না হয়, তাহলে আমার সাগর পরিমাণ জ্ঞান, আমার জিহাদ, আমার ভুড়ি ভুড়ি ধন-সম্পদ, দান-সাদ্বাকা কোনকিছুই আমার কাজে আসবে না।
কেউ প্রশ্ন করতে পারে,- ধরুন আমি কোন বিপদে পড়লাম বা অমুক জিনিস আমার দরকার। আমি আল্লাহর কাছে সেই বিপদ থেকে মুক্তি চাইলে বা অমুক জিনিসটা চাইলে আমার নিয়্যাত কি ওই বিপদ মুক্তি বা ওই জিনিসের জন্যে হয়ে যায়?
উত্তর হচ্ছে, - না।
আল্লাহর কাছে চাওয়ার জন্য তিনিই তো আমাদের শিখিয়ে দিচ্ছেন। আমরা প্রতি রাকাত সালাতে বলি-
'আমরা কেবল তোমারই ইবাদাত করি আর তোমার কাছেই সাহায্য চাই'
[ আল ফাতিহা। আয়াত-০৪]
আমাদের কোনকিছু দরকার হলে বা আমরা কোন বিপদে পড়লে আল্লাহর কাছে চাইবো, তাঁর কাছেই পানাহ চাইবো। তবে, আমাদের অন্তরে এই বিশ্বাস রাখতে হবে যে, আল্লাহর সন্তুষ্টিই আসল।
আল্লাহ সন্তুষ্ট হলে তিনিই আমার ইচ্ছা পূরণ করে দেবেন যদি তা আমার জন্য মঙ্গলজনক হয়। আমাদের এই বিশ্বাসও রাখতে হবে, আল্লাহ আমার জন্য যেটা মঙ্গলজনক, সেটাই করবেন। আমি যা চাইছি, সেটা যদি আমার জন্য অমঙ্গলজনক হয়, আল্লাহ তা আমাকে দিবেন না। আমার আপাতঃ মনে হতে পারে আল্লাহ আমাকে কেনো এটি দিলেন না? এটি তো আমি চাইলাম। কিন্তু সেটি কি আদৌ আমার জন্য উপকারী কিনা সেটা আমি জানি না, আল্লাহই জানেন। তাই তাঁর উপর সবসময় আমাদের আস্থা রাখতে হবে। বিশ্বাস রাখতে হবে।
কোরআনে বলা হচ্ছে,-
'আর তোমরা যা অপছন্দ করো হতে পারে তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর এবং যা পছন্দ করো হতে পারে তা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। বস্তুত, আল্লাহই সব কিছু জানেন, তোমরা জান না'।
[আল-বাকারা। আয়াত-২১৬]
সুতরাং, দিনশেষে আমাদের আমল হিসেব করা হবে নিয়্যাতের ভিত্তিতে। কার নিয়্যাত কিরকম। কার নিয়্যাত দুনিয়ার জন্য আর কার নিয়্যাত আল্লাহর জন্য- এটাই হবে বাটখারা।
'নিয়্যাত- আমল কবুলের শর্ত'/ আরিফ আজাদ

No comments

Note: Only a member of this blog may post a comment.

Powered by Blogger.