‘কখনোই ভেঙে পড়ো না’/ আরিফ আজাদ

বেশ অনেকদিন হয় রাসূল (সাঃ) এর কাছে কোন ওহী আসেনা। একমাস, দু’মাস, তিন মাস... এভাবে একদম ছয়মাস ধরে ওহী আসা বন্ধ হয়ে গেলো। জিবরীল (আঃ) আগের মতো আল্লাহর প্রত্যাদেশ নিয়ে যখন-তখন হাজির হন না। যে জিবরীল (আঃ) কে দেখলে মুহাম্মদ (সাঃ) এর শরীরে কাঁপন ধরতো, আজ সেই জিবরীল (আঃ)-কে অনেকদিন না দেখতে পেয়ে মুহাম্মদ (সাঃ) যেন অস্থির হয়ে পড়লেন। সারাক্ষণ অধীর আগ্রহ নিয়ে পথ চেয়ে থাকেন। এই বুঝি জিবরীল (আঃ) এলো ওহী নিয়ে...
উহু, জিবরীল (আঃ) আসেন না। মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবনের প্রতিটা সেকেন্ড, প্রতিটা মিনিট, প্রতিটা ঘণ্টা হয়ে উঠলো উদ্বেগ, উৎকন্ঠার। নানানরকম চিন্তা তখন মাথায় ভর করতে লাগলো তাঁর। ভাবতে লাগলেন,- ‘তাহলে কি আমি কোন ভুল করে ফেললাম? আমি কি নবী হওয়ার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছি? আমার রব কি আমার উপর নাখোশ? তিনি কি আমাকে আর ভালোবাসেন না? যদি ভালোবাসেন, তাহলে আমার কাছে আর কেনো ওহী আসেনা? কেনো জিবরীল আগের মতো এসে আমাকে ‘ও মুহাম্মদ’ বলে ডাক দেয় না?’
চিন্তা আর পেরেশানিতে অস্থির মুহাম্মদ (সাঃ) অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বিছানায় কাতর অবস্থাতেও তিনি অপেক্ষা করতে থাকেন জিবরীলের জন্য।
ওদিকে, মুহাম্মদ (সাঃ) এর কাছে ওহী আসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার সংবাদ যখন চারদিকে চড়াও হলো, তখন মক্কার মুশরিকরা হাসাহাসি শুরু করলো আর বলতে লাগলো,- ‘হা...হা... মুহাম্মদের ভূত মুহাম্মদকে ছেড়ে পালিয়েছে...’।
একে তো আল্লাহর ওহী আসা বন্ধ দীর্ঘদিন, তারউপর মুশরিকদের নানান কটুকথা, কটুবাক্য শুনে রাসূল (সাঃ) আরো ব্যথিত, আরো অসুস্থ হয়ে পড়লেন।
অবশেষে, ঠিক ছ’মাস পরে জিবরীল (আঃ) এলেন। সাথে নিয়ে এলেন এতোদিনের শোক, অপেক্ষা, জ্বালা, অপমান, লাঞ্চনা-গঞ্জনার উপশম। জানেন কি সেটা? সেটা হলো সূরা আদ-দ্বোহা।
একদিকে ওহী বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অস্থিরতা, অন্যদিকে এই ঘটনায় মুশরিকদের আস্ফালন, সব মিলিয়ে রাসূল (সাঃ) এর জীবন যখন বিষিয়ে উঠলো, দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে পড়লো, ঠিক তখনি জিবরীল (আঃ) নিয়ে এলেন এই সূরাটি।
‘শপথ সুবহে সাদ্বিকের’
‘এবং শপথ রাতের যখন তা নিঝুম হয়’।
এখানে আল্লাহ সুবাহান ওয়া’তালা শপথ করছেন সুবহে সাদ্বিক এবং নিঝুম রাতের। পুরো সূরার মর্মকথার সাথে এই দুটি উপমা খুব ভালোভাবে সম্পর্কযুক্ত। প্রথমত, সুবহে সাদ্বিক আর শুনসান নিঝুম রাত হচ্ছে আল্লাহর সৃষ্টির দুটি সুন্দরতম মূহুর্ত। দ্বিতীয়ত, সুবহে সাদ্বিক অর্থ- ঘোর অন্ধকার কেটে ভোরের আলো ফুটার মূহুর্ত। আর নিঝুম রাত হচ্ছে ঘুটঘুটে কালো অন্ধকারের প্রতীক। পুরো সূরাটি খেয়াল করলে দেখবেন এখানে যে দুটো বিষয়ে আলাপ করা হয়েছে তা হলো-
১। জীবনে কঠিন সময় থাকে। এসকল মূহুর্তে ভেঙে পড়লে চলবে না।
২। কঠিন সময়ের পরেই কিন্তু স্বস্তি আসে। দুঃখের পরেই আসে সুখ। অন্ধকার চিরস্থায়ী নয়। আলো ফুটবেই ফুটবে।
এই উপমা দুটির মধ্যে যখন নিঝুম রাতের শপথ করা হচ্ছে, তখন যেন জীবনের কঠিন বাস্তবতা, দুঃখ, কষ্টকেই মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আবার যখন সুবহে সাদ্বিকের শপথ করা হচ্ছে, তখন যেন জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে- এই দুঃখ-কষ্টগুলো সাময়িক। আপনার রবের উপরে ভরসা রাখুন। তাওয়াক্কুল করুন। তিনিই ঘুটঘুটে অন্ধকার সময়কে সুবহে সাদ্বিকের উজ্জ্বল আলো দিয়ে অপসারণ করাবেন।
এরপর আল্লাহ সুবাহান ওয়াতা’লা বলছেন,-
‘(ও মুহাম্মদ) আপনার রব আপনাকে পরিত্যাগ করেননি এবং তিনি আপনার উপর অসন্তুষ্টও নন’।
ওহী আসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মুহাম্মদ (সাঃ) এর মনের ভিতরে কি চলছিলো তা আল্লাহ তা’লা জানেন। তিনি ভাবছিলেন,- ‘আমি কি কোন ভুল করে ফেললাম? আমার উপর কি আমার রব অসন্তুষ্ট হলেন? আমি কি আমার দায়িত্বে গাফেল হয়ে পড়লাম যার ফলে আমার রব আমার কাছে আর ওহী পাঠাচ্ছেন না?’
এবং সাথে মক্কার কাফির-মুশরিকরা যখন বলাবলি করছিলো যে মুহাম্মদ (সাঃ)-কে তাঁর রব ছেড়ে চলে গেছে, তখন আল্লাহ সুবাহান ওয়া’তালা বলছেন,- ‘নাহ। আমি আপনাকে ছেড়ে যাইনি। এবং ভাববেন না যে আমি আপনার উপরে অসন্তুষ্ট। উহু, আমি মোটেও আপনার উপরে অসন্তুষ্ট নই’।
‘নিশ্চয়ই পরবর্তী সময় (আখিরাত) পূর্ববর্তী সময় (দুনিয়া) থেকে উত্তম’।
দেখবেন, আমরা যতোই বলি না কেনো ‘আমি সমালোচনায় কান দিইনা’, দিনশেষে সমালোচনা, নিজের সম্পর্কে কটুবাক্য শুনলে আমাদের অন্তর তবুও ব্যথিত হয়ে পড়ে। মুশরিকদের একের পর এক নির্যাতন, কটুবাক্যে জর্জরিত রাসূল (সাঃ) যখন মানসিকভাবে দূর্বল হয়ে পড়লেন, তখন আল্লাহ বলছেন,- ‘ওদের কথায় কান দিবেন না আপনি। দুনিয়ায় আপনাকে কে কি বললো তাতে আপনার কিচ্ছু যায় আসে না। দুনিয়ার চেয়ে আখিরাত আপনার জন্য উত্তম। সুতরাং, দুনিয়ায় কে আপনাকে গালমন্দ করলো, কে আপনাকে খারাপ বললো তা নিয়ে ব্যথিত হবার কোন প্রয়োজন নেই’।
‘শীঘ্রই আপনার প্রতিপালক আপনাকে এতোই নিয়ামত দান করবেন যে আপনি সন্তুষ্ট হয়ে যাবেন’।
আল্লাহ বলছেন, ওরা আপনাকে অপমান করছে? করুক। আপনার র’বের কাছে আছে আপনার জন্য নির্ধারিত প্রতিদান। অতিশীঘ্রই তিনি আপনাকে নিয়ামতের ভান্ডার দিয়ে পুরস্কৃত করবেন। আপনি তো আল্লাহর উপরেই তাওয়াক্কুল করেছেন। সুতরাং, তাদেরকে তাদের কাজ করতে দিন। আমার কাছে রয়েছে আপনার জন্য অফুরন্ত নিয়ামত যা আমি শীঘ্রই আপনাকে দিয়ে সম্মানিত করবো’।
‘তিনি কি আপনাকে একজন এতীম হিসেবে পান নি? এরপর তিনি আপনাকে আশ্রয় দিয়েছেন’
এই বাক্যটা বুঝতে হলে একটা জিনিস বুঝতে হবে। ধরুন, আমার কাছে এমন একজন এলেন যিনি ম্যাথ একদমই পারেন না। আমি আমার তত্ত্ববধানে রেখে তাঁকে ম্যাথ শিখালাম। ম্যাথে তাঁকে এমন বিশেষজ্ঞ করে তুললাম যে, সে এখন যেকোন ম্যাথ অলিম্পিয়াডে গোল্ড মেডেল জেতার মতো দক্ষ। আমি যখন তার সাথে একান্ত আলাপে বসবো, পূর্বের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তখন তাকে কি বলবো? বলবো,- ‘ভাই, আপনি যখন আমার কাছে এসেছিলেন তখন আপনি ম্যাথের কিছুই বুঝতেন না। এরপর আমি আপনাকে ম্যাথে দক্ষ করে তুললাম’।
এখানেও, রাসূল (সাঃ)-কে আশা দেখাতে গিয়ে আল্লাহ তা’লা পূর্বের স্মৃতিচারণ করছেন। বললেন,- ‘হে রাসূল! খেয়াল করুন, খুব ছোটবেলায় আপনি পিতা-মাতা দু’জনকেই হারিয়েছিলেন। এরপর আমিই কি আপনার থাকার ব্যবস্থা করে দিইনি? দাদা আব্দুল মুত্তাবিলের মনে, চাচা আবু তালিবের হৃদয়ে আমিই তো আপনার জন্য মায়া আর ভালোবাসার সঞ্চার করেছি। তারা আপনাকে ভালোবেসেছে। আশ্রয় দিয়েছে। বড় করে তুলেছে। আপনার সেই কঠিন সময়ে আমি কি আপনাকে ছেড়ে গিয়েছিলাম? নাহ, যাইনি...’।
‘এবং তিনি (আল্লাহ) আপনাকে পেয়েছেন পথের দিশাহীন এরপর তিনিই আপনাকে পথ দেখালেন’।
আল্লাহ বলছেন, হে রাসূল! মক্কার জাহিলিয়াতের সময়ে যখন সবাই লাত-উযযা আর মানত দেব-দেবীদের পূজোয় মগ্ন, যখন তারা অহংকার আর গৌরবের বড়াই করতে গিয়ে গোত্রে গোত্রে লড়াই করছিলো, যখন তারা কন্যা সন্তানদেরকে নৃসংশভাবে জীবন্ত দাফন করছিলো, তখন আমি কি আপনাকে ওহী দিয়ে সম্মানিত করিনি? হেফাজত করিনি? আপনাকে রাসূল হিসেবে মনোনীত করিনি?
‘তিনি আপনাকে পেলেন নিঃস্ব হিসেবে এরপর তিনিই আপনাকে স্বচ্ছল করে তুললেন’।
‘হে রাসূল! অত্যন্ত দরিদ্র অবস্থায় কি আপনি ছিলেন না? নুন আনতে পান্তা পুরাতো আপনার সংসারে। আমিই কি আপনাকে স্বচ্ছল করিনি? আপনার সংসারে আমিই তো বারাকাহ দিয়েছি, তাই না?
‘সুতরাং, আপনি ইয়াতীমদের সাথে কঠোর হবেন না’।
প্রথমে শান্তনা বাক্য শুনিয়ে এবার আল্লাহ তা’লা আদেশ করে বসলেন। বললেন,- ‘খবরদার! ইয়াতীমদের প্রতি কখনোই কঠোর হবেন না। মনে রাখবেন, আপনিও এতীম ছিলেন। আপনাকে আমিই অনুগ্রহ করেছি, সম্মানিত করেছি। আপনিও কোন এতীমের সাথে রূঢ় আচরণ করবেন না। আপনাকে যেমন আমি এতীম অবস্থায় আশ্রয় দিয়েছি, কারো না কারো দ্বারা তাদেরকেও আমি আশ্রয় দান করবো। আমি তাদের প্রতি দয়াপরবশ। সুতরাং, যেখানে আমিই তাদের প্রতি দয়া করছি, সেখানে আপনি অবশ্যই তাদের প্রতি কঠোর হবেন না’।
‘এবং কোন ভিক্ষুককে আপনি ধমক দিবেন না’।
হে রাসূল! ভিক্ষুকরা নিতান্ত অসহায়, দারিদ্রতা থেকেই আপনার নিকট আসে। সুতরাং, তাদের সাথে নম্র আচরণ করুন। ধমকের সুরে, মনিবের সুরে বা করুণার সুরে তাদের সাথে কথা বলবেন না’।
‘এবং, আপনার র’বের প্রদত্ত নিয়ামতের প্রশংসা করুন’।
একদম শেষে এসে আল্লাহ তা’লা বললেন,- ‘হে রাসূল! আপনার র’বের প্রশংসা বর্ণনা করুন। তিনিই তো আপনাকে কঠিন সময় থেকে পার করে এনেছেন। তিনিই আপনাকে লালন-পালন করেছেন। আহার যুগিয়েছেন, আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছেন। তিনিই আপনাকে সম্মানিত করেছেন। সুতরাং, কৃতজ্ঞ হতে ভুলবেন না। আপনার র’বের নিয়ামতের প্রশংসা বর্ণনা করুন’।
এই সূরাটি থেকে আমাদের শেখার মতো অনেক কিছুই আছে। যখন জীবন নিয়ে খুব হতাশ হয়ে পড়ি, পাপ করতে করতে যখন পাপের সাগরে তলিয়ে যাই, যখন দুঃখ, কষ্ট আর ভোগান্তিতে চারদিকে অন্ধকার দেখি, তখন ভাবি,- ‘নাহ, আমি হতাশ হবো না। বিশ্বাসীরা হতাশ হয় না। নিশ্চয়ই আমার র’ব আছেন। তিনিই আমাকে পথ দেখাবেন। যখন পাপে নিমজ্জিত হই এবং বুঝতে পারি যে ভুল করেছি, আমি তখন এই ভেবে আশ্বস্ত হই যে, আমার র’ব ক্ষমাশীল, অত্যন্ত দয়ালু। আজকে আমার কষ্ট হচ্ছে, কঠিন সময় যাচ্ছে তো কি হয়েছে, এর বিনিময়ে অবশ্যই আমার র’ব আমার জন্য ভালো কিছু রেখেছেন।
আমি মাথানত করি, সিজিদাবনত হই তাঁর দরবারে। তিনি আমাকে কাজ করার জন্য দু’টি হাত দিয়েছেন, হাঁটার জন্য দু’টি পা দিয়েছেন, শোনার জন্য দু’টি কান দিয়েছেন, দেখার জন্য দু”টি চোখ দিয়েছেন। হায়! আমি তো অন্ধ হয়েও জন্মাতে পারতাম, কিংবা খোঁড়া পা নিয়ে। একসিডেন্টে আমার শরীর অবশ হয়ে যেতে পারতো যেকোন সময়। কিন্তু আমি তো দিব্যি আছি। আমি কি শুকরিয়া জ্ঞাপন করেছি বা আদৌ করি? আমি কি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি? হায়! আমি কি তাহলে অকৃতজ্ঞদের দলে? আমি ভাবি আর আমার স্রষ্টার নিকটবর্তী হই। আমি বুঝতে পারি আমার আসলে অহংকার করার কিছুই নেই। এবং, হতাশ হবারও কিছু নেই। আমার র’ব আছেন। নিশ্চয়ই আমার কঠিন সময় কেটে যাবে। ঘুটঘুটে অন্ধকার ভেদ করে উজ্জ্বল হয়ে ফুটবে সুবহে সাদ্বিকের আলো। নিশ্চয়ই আমার র’ব আমার ব্যাপারে ওয়াকিবহাল। তিনি অবশ্যই মুমিনদের নিরাশ করেন না। পথ দেখান।
‘কখনোই ভেঙে পড়ো না’/ আরিফ আজাদ

No comments

Note: Only a member of this blog may post a comment.

Powered by Blogger.