বহুবিবাহ / আরিফ আজাদ


কোন আয়াত বা কোন সূরাকে বোঝার জন্য সবচেয়ে উত্তম পদ্ধতি হলো সেই আয়াত/সূরার শানে নুযূল জানা। যেমন ধরুন সূরা ফীলের কথা। আপনি যদি এই সূরার শানে নুযূল না জানেন, এর পেছনে যে এক বিশাল প্রেক্ষাপট, সুবিশাল ইতিহাস লুকায়িত আছে- সেটা আপনি কোনদিনও বুঝতে পারবেন না। শানে নুযূল না জেনে পড়লে আপনি কেবল হাতি আর পাখিদের গল্প পড়বেন, ব্যস!

আবার, আল কুরআনের সবচেয়ে বেশি মিসকৌট হওয়া সেই আয়াতটির কথাই চিন্তা করুন যেখানে বলা হচ্ছে ‘তোমরা মুশরিকদের যেখানেই পাও হত্যা করো’। এই আয়াতটি নিয়ে নাস্তিক-ইসলাম বিদ্বেষীরা সবচেয়ে বেশি জলঘোলা করার চেষ্টা করে। অথচ, এই আয়াতটি নাযিলের কারণ, এর পেছনের ইতিহাস, এর প্রেক্ষাপট এবং আয়াতটির আগের-পরের আয়াতগুলোর সাথে এই আয়াতের সিকোয়েন্স মিলালে যেকেউ বুঝতে পারবে যে যেটা বুঝাতে ইসলাম বিদ্বেষীরা এই আয়াত কৌট করে, এটা আসলে সেরকম আয়াত নয়। বরং, তার উল্টো। যাহোক, শানে নুযূল জানার গুরুত্বটা এখানেই।
সম্প্রতি অনলাইনে একটি বিষয় নিয়ে খুব কথা হচ্ছে। যারা কথা বলছে তারা মুসলিম, আবার যারা এতে নাখোশ হচ্ছে, প্রতিবাদ জানাচ্ছে তারাও মুসলিম। বিষয়টা হলো পুরুষদের জন্য কুরআনের বহু বিবাহের বিধান। আমার মনে হয়েছে, এই ইস্যুতে যারা কথা বলছে, তাদের এপ্রোচটা ভুল এবং বলার ধরণ অসম্পূর্ণ। ঠিক একইভাবে, যারা বিরোধিতা করছে তাদের এপ্রোচটাও ভুল। দু’পক্ষই যেন মুখোমুখি সম্মুখ সমরে নেমে পড়েছে, আর মাঝখান থেকে ফায়দা লুটছে শয়তান। ফলে হলোটা কি, ইসলামের একটা পবিত্র জিনিস নিয়ে কারো কারো মধ্যে বিদ্বেষ ঢুকে পড়ছে এবং কারো কারো কাছে তা হাস্যকর হয়ে উঠছে। পবিত্র রামাদান মাসে এরকম ভার্চুয়াল ফিতনা এর আগে সম্ভবত আর কখনোই দেখা লাগেনি।

প্রথমেই আমি কুরআনের সেই আয়াতের ব্যাপারে আসি, যেখানে পুরুষদের একাধিক বিবাহের ব্যাপারে বলা হচ্ছে-
/যদি তোমরা আশঙ্কা করো যে ইয়াতীম নারীদের প্রতি তোমরা সুবিচার করতে পারবেনা, তাহলে নারীদের মধ্য হতে নিজেদের পছন্দমতো বিবাহ করো দুই, তিন, চার.../- সূরা নিসা ০৩
এর আগের আয়াতে বলা হচ্ছে, /আর ইয়াতীমদেরকে তাদের ধন-সম্পদ প্রদান করো। ভালোর সাথে মন্দের বদল করোনা। নিজেদের সম্পদের সাথে তাদের সম্পদ মিশিয়ে গ্রাস করোনা। নিশ্চয়ই, এটা মহা পাপ’।/ - সূরা নিসা- ০২
এই আয়াত নাযিলের কারণ হচ্ছে, রাসুল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগের এক লোকের তত্ত্বাবধানে একটি ইয়াতীম মেয়ে ছিলো। সেই লোকের একটি বাগান ছিলো যাতে ইয়াতীম মেয়েটিরও অংশ ছিলো। লোকটা সেই ইয়াতীম মেয়েকে বিয়ে করে নিলো কোনোপ্রকার মোহর প্রদান ছাড়াই। এবং, ওই বাগানে মেয়েটির যে অংশ ছিলো, পরে লোকটা সে অংশটাও আত্মসাৎ করে নিলো। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই আয়াতদ্বয় নাযিল হয়।

তাহলে, এই ঘটনা এবং আয়াত থেকে ইয়াতীম নারীদের বিয়ে করার ব্যাপারে একটা সুক্ষ্ম নির্দেশ পাওয়া যাচ্ছে। এরপর বলা হচ্ছে, ‘যদি ইয়াতীম নারীদের সাথে সুবিচার করতে না পারো’- এই কথাটা খুবই সেন্সেটিভ কিন্তু। আমাদের সমাজে ইবাদাত বা ধর্ম পালন এখন অনেকটা লোক দেখানো কাজে পরিণত হয়েছে। আমরা যাকাত দিই ঢাকঢোল পিটিয়ে। হজ করি নামের আগে ‘আলহাজ্ব’ লাগানোর জন্য। নামাজ পড়ি সমাজে নিজেদের ‘আল্লাহওয়ালা’ প্রমাণ করতে। সবকিছুতে রিয়ার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এখন, আপনি যদি কোন ইয়াতীম নারীকে বিয়ে করেন, তাহলে মনে করতে পারবেন না যে আপনি তাকে দয়া করেছেন, বা তাকে বিয়ে করে তার জীবন-ইজ্জত-আব্রু উদ্ধার করেছেন। এমনটা ভাবলেই বিপদ! তখন সেটা আর তাদের প্রতি সুবিচার করা হবেনা। কিন্তু আমাদের সমাজের চিত্র ঠিক এর উল্টো।

এরপর, যদি ইয়াতীম নারীদের সাথে সুবিচার করতে না পারি, তাহলে কি করতে হবে? আল্লাহ বলছেন,- /তাহলে নারীদের মধ্য থেকে বিবাহ করো নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী- দুই, তিন, চার..’।
হুম, এতোটুকু পড়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার দরকার নেই। সাথে সাথেই বলা হচ্ছে,- /আর যদি আশংকা করো যে তাদের সাথে (একাধিক স্ত্রীদের মধ্যে) সুবিচার করতে পারবেনা, তাহলে বিবাহ করো একজনকেই’।/
ইসলামে বহু বিবাহ অনুমোদনের পেছনে হিকমা আছে। জিহাদ হচ্ছে ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান। এটা এমন একটা জিনিস, যার স্বাদ আস্বাদন করার স্বপ্ন প্রত্যেক মুসলমান বুকে ধারণ করে। জিহাদে পক্ষ-বিপক্ষের প্রচুর মানুষ মারা যায়। এমতাবস্থায়, যারা শহীদ হয়, তাদের অনেকেই স্ত্রী-সন্তান রেখে যায়। যদি ‘বহু বিবাহের’ বিধান না থাকে, তাহলে প্রচুর নারীদের নিঃসঙ্গ থাকার সম্ভাবনা রয়েই যায়। তখন সেখানে পাপাচার, অনাচার, ব্যভিচার মহামারি আকারে প্রবেশ করার সমূহ সম্ভাবনা। তখন সেই সমাজে এই ‘ধাক্কা’ সামলানোর একমাত্র উপায় বহু বিবাহ।
তবে, এই বহু বিবাহ অবশ্যই ফরজ নয়। আপনাকে যে একদম করতেই হবে তা নয়। বরং কুরআনে এটার পক্ষে যে পরিমাণ সম্মতি জ্ঞাপন করা হয়েছে, এটার বিপক্ষে সম্মতি জানানো হয়েছে তার দ্বিগুণ।

যেমন সূরা নিসার সেই আয়াতে আল্লাহ বলেই দিচ্ছেন, /যদি তোমরা তাদের সাথে সুবিচার করতে না পারার আশঙ্কা করো, তাহলে বিবাহ করবে একজনকে। এতেই পক্ষপাতিত্ব না করার সম্ভাবনা বেশি’/

খেয়াল করুনন, আল্লাহ সুবনাহু ওয়া’তায়ালা বলছেন,- ‘এতেই পক্ষপাতিত্ব না করার সম্ভাবনা বেশি’। কথাটা কিন্তু অনেক গুরুত্ববহ। আল্লাহ কিন্তু আমাদের সেইফ জোন কোনটা সেটা দেখিয়ে দিচ্ছেন। কোনটা? একজনকে নিয়েই সুখে থাকা। একের অধিক স্ত্রীর মধ্যে আমরা যে সুবিচার করতে পারবোনা, সেটা আল্লাহ সুবনাহু ওয়া’তায়ালা জানেন। তিনি সূরা নিসার একশতো ঊনত্রিশ নাম্বার আয়াতে বলছেন, - /আর, তোমরা যতোই ইচ্ছা করোনা কেনো, তোমাদের স্ত্রীদের সাথে সুবিচার তোমরা কখনোই করতে পারবেনা। তোমরা (নির্দিষ্ট) কোন একজনের প্রতি সম্পূর্ণভাবে ঝুঁকে পড়োনা এবং অন্যজনকে ঝুলানো অবস্থায় রেখো না’।/

এই আয়াতে আল্লাহ সুবনাহু ওয়া’তায়ালা পুরুষদের একটা সাইকোলজি নিয়ে কথা বলছেন। একটা বৈশিষ্ট্য নিয়ে। আল্লাহ বলছেন, আমরা যতোই চেষ্টা করিনা কেনো, একাধিক স্ত্রীর সাথে সমান ব্যবহার, সুবিচার আমরা কোনভাবেই করতে পারবোনা। এটা আমাদের মানবিক দূর্বলতা। ধরুন এক লোকের দু’জন স্ত্রী। দুই স্ত্রীর মধ্যে একজন খুবই রূপবতী আর গুণবতী। অন্যজন একটু কম সুন্দরী। স্বাভাবিকভাবেই লোকটা তার সুন্দরী স্ত্রীর প্রতিই ঝুঁকে পড়বে বেশি। তাকেই বেশি ভালোবাসবে। তার প্রতিই বেশি মনোযোগি হবে। কোথাও ঘুরতে গেলে তাকে নিয়েই যেতে চাইবে। মোদ্দাকথা, তার ওই স্ত্রী, যিনি একটু কম সুন্দর বা কম যোগ্যতাসম্পন্ন, তিনি হবেন উপেক্ষিত। অবশ্য, ভালোবাসার একটুখানি পক্ষপাতিত্ব দোষের না। তবে, এই উপেক্ষা একটা সময় স্ত্রীর মৌলিক হকগুলো (ভরণপোষণ, রাত্রিযাপন ইত্যাদি) আদায়ে ব্যাঘাত ঘটাবে। এটা হবে অন্য স্ত্রীর প্রতি যুলুম। আপনি যতোই চেষ্টা তদবির করুন, আপনি কোনোভাবেই এই পক্ষপাতিত্বের দায় থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারবেন না। এটা অটোম্যাটিক্যালি চলে আসে। সেজন্যেই আল্লাহ বলেছেন- /তোমরা যতোই ইচ্ছা করো, স্ত্রীদের সাথে সুবিচার করতে তোমরা পারবেনা’।/
ধরুন, নিজের উপর আপনার প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস। আপনি দাবি করছেন যে- আপনি অবশ্যই অবশ্যই দুই স্ত্রীর মধ্যে সুবিচার করতে পারবেন। এই প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস থেকে আপনি দ্বিতীয় বিয়ে করে ফেললেন। কিন্তু একটা পর্যায়ে গিয়ে আপনি দেখলেন যে আপনি আসলে অন্য দশজন পুরুষের চেয়ে মোটেও ব্যতিক্রম নন। নতুন স্ত্রী পেয়ে আপনি তাকে নিয়ে হানিমুনে ব্যস্ত। তাকে নিয়ে মধু চন্দ্রিমা করে বেড়াচ্ছেন, আর ঘরে প্রথম স্ত্রীর হক নষ্ট করে বেড়াচ্ছেন। তখন আপনার শাস্তি কি জানেন?

রাসুল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,- /যে ব্যক্তির দু’জন স্ত্রী রয়েছে, সে যদি ব্যবহারের ক্ষেত্রে তাদের সাথে পূর্ণ সমতা ও ইনসাফ করতে না পারে, তাহলে কিয়ামতের মাঠে সে এমনভাবে উঠবে যে- তার শরীরের এক অংশ অবশ হয়ে থাকবে’/ [ইবন মাজাহ, ১৯৬৯]
যা বলছিলাম, শুধু একাধিক বিয়ের আয়াত পড়ে গদগদ হয়ে আনন্দে ভাসার কোন যৌক্তিকতা নেই। একাধিক বিয়ের শর্ত, কারণ এবং অবস্থাগুলোও বুঝুন। আল্লাহ আপনার জন্য কোনটা ‘সেইফ জোন’ নির্ধারণ করেছেন, সেটাও ভাবুন। তারপর সিদ্ধান্ত নিন আপনি কি মাসনা, সুলাসা আর রুবায়া করার জন্য আদৌ প্রস্তুত কিনা।

দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে, আমরা আমাদের সমাজের মূল সমস্যার গভীরে যাইনা। আবেগ আর যজবা দিয়ে সবকিছুকে বিচার করি। বহু বিবাহের বিধান নিয়ে পুরুষ সমাজের উচ্ছ্বাস এবং নারী সমাজের বিরোধিতা দেখে বুঝলাম- আমাদের সমাজে ইসলামের মৌলিক শিক্ষাটা এখনো অতো গভীরে প্রোথিত হয়নি। আমাদের সমাজে যিনা-ব্যভিচার এখন কতো সহজলভ্য। বিয়েটাকে আমাদের সমাজে হিমালয় পর্বত ডিঙানোর মতো কঠিন করে ফেলা হয়েছে। যৌতুক ছড়িয়েছে মহামারির মতো। মেয়ের বাবারা যৌতুকের জন্য মেয়েদের ঠিক সময়ে বিয়ে দিতে পারছেনা। আবার, মেয়ের বাবাদের পাত্রের প্রতি অতি উচ্চাশা, অতি প্রত্যাশা ছেলেদের জন্যও বিয়েটাকে কঠিন করেছে। মেয়ের বাবারা সরকারি চাকুরি, ব্যাংক জব বা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি না থাকলে সে ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দিতেই চায় না। সবকিছু মিলিয়ে এক বেহাল দশা চারদিকে। ছেলেরা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। রাত জেগে খারাপ মুভি দেখছে। চরিত্রের অধঃপতন ঘটছে যুব সমাজের। এই অবিবাহিত ছেলেগুলোকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার উপায় হলো- বিয়ে। আমাদের তো উচিত ছিলো এই ছেলেগুলোকে বিয়ে দেওয়ার জন্য কথা বলা, সমাজে মেয়ের বাবাদের বোঝানো যে, রিযিক আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে। একজন ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দেওয়ার জন্য তার অর্থ সম্পদ বা চাকুরি প্রাধান্য পাবেনা, তার তাকওয়া, তার দ্বীন প্রাধান্য পাবে। ছেলের বাবাদের বোঝানো যে- যৌতুক একটি ঘৃণ্য প্রথা। এটা কুসংস্কার। যে জিনিসগুলো আমাদের সমাজে বিয়েটাকে কঠিন করে রেখেছে, যিনা-ব্যভিচারকে সহজলভ্য করে ফেলেছে, সেগুলো দূরীকরণে কতোটা কাজ আমরা করি বা করেছি? সেগুলোর বিরুদ্ধে কতোটা সোচ্চার আমরা? আমাদের উচিত ছিলো এগুলো নিয়ে কথা বলা। আওয়াজ তোলা। সোচ্চার হওয়া। যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া। এই সময়ে, এই সমাজে ‘মাসনা, সুলাসা, রুবায়া’ নিয়ে মাতামাতি করার কি বিশেষ কোন দরকার আছে?

প্রিয় বোনেরা! বহু বিবাহ আল্লাহর একটা বিধান। হালাল বিধান। যারা এটার ভুল ব্যাখ্যা, ভুল প্রয়োগ করে তাদের দিয়ে ইসলামকে বিচার করবেন না। হ্যাঁ, একজন নারী তার স্বামীকে কখনোই অন্য একজন নারীর সাথে দেখতে পছন্দ করেনা। কষ্ট পায়। কিন্তু, ইসলাম সমষ্টিগত কল্যাণকে ব্যক্তিগত কল্যাণের উপরে প্রাধান্য দেয়। এজন্যই, বহু বিবাহের বিধান রাখা হয়েছে। এতে করে যদি সমাজে ব্যভিচার প্রসার না হয়, যিনার প্রসার না হয়, সমাজ অসুস্থ না হয়, সেটা সামষ্টিক কল্যাণ। এজন্যই ইসলাম এই প্রথাকে তুলে নেয়নি। মুবাহ (গ্রহণযোগ্য) হিসেবে রেখেছে অনেকগুলো শর্তারোপ করে, আবার ফরজও করেনি। তাই, এই হালাল বিধানকে ঘৃণা করবেন না। যদি আল্লাহর বিধান নিয়ে মনের মধ্যে এতোটুকু পরিমাণও ঘৃণা থাকে, সাবধান হোন। তাওবা করুন। আল্লাহর কাছে বিতাড়িত শয়তানের কাছ থেকে পানাহ চান।

No comments

Note: Only a member of this blog may post a comment.

Powered by Blogger.