নাস্তিকিও ধাধা / আরিফ আজাদ

সেক্যুলারদের ইসলাম বিদ্বেষ এদেশে নতুন কিছু নয়। উঠতে বসতে, শু’তে আর জাগতে ইসলাম সম্পর্কে দু’চারটে কটু বাক্য ব্যয় না করলে তাদের প্রগতিজমে আবার জং ধরা শুরু করে। তাই আসাদ আর পুতিন মিলে সিরিয়ার নিষ্পাপ শিশু, মহিলা আর পুরুষদের উপরে বোমা ফেললে, তিউনিশিয়া, মিশর আর বসনিয়ায় মুসলিমদের জবাই করা হলেও এদেশের সেক্যুলারদের সিলেক্টিভ মানবতা জেগে উঠেনা। উনারা পারতপক্ষে এসব ইস্যু স্কিপ করে যান। যদি অনিচ্ছা সত্ত্বেও এসব ইস্যুতে দু’চার লাইন লিখতেও হয়, সেখানেও তারা ইসলাম ধর্মের উপরে আচ্ছামতো মনের ঝাল মিটিয়ে নেন।
সম্প্রতি একটা অনলাইন স্কুলে মাস্টারি করা এক ছেলে অপ্রাপ্তবয়স্ক নাস্তিক আর বামদের কাছে প্রচুর জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ছেলেটা ওই অনলাইন স্কুলে বাচ্চাদের বিবর্তনবাদের রূপকথা পড়াতো বলে জানি। সে যাহোক, তার মাস্টারি বা তার গল্প শিক্ষা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। আমার মাথাব্যথা হলো তার পাকনামি নিয়ে।
গতকাল সেই ছেলেটা একটা স্ট্যাটাস দিয়েছে। সেই স্ট্যাটাসে ইসলাম এবং মুসলিমদের উপরে তার সমস্ত ক্ষোভ, সমস্ত রাগ সে উগরে দিয়েছে। কয়েকজন আমাকে অনুরোধ করেছেন এটা নিয়ে কিছু বলতে। এজন্যই লিখলাম।
সে লিখেছে,- ‘বাংলাদেশ একটা মুসলিম রাষ্ট্র’ এই কথাটা বলা মোটামুটি অসাংবিধানিক। কারণ, বাংলাদেশের সংবিধানে বেশ বড় করেই বলা আছে,- ‘বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র’।
এই ছেলে হয়তো জানেনা যে, বাংলাদেশের সংবিধানেরে শুরুতে, ২ (ক) ধারায় বলা আছে,- ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’। সে সংবিধান ঘেঁটে সেক্যুলারিজম আবিষ্কার করতে গিয়ে এই জিনিসটা বেমালুম চেপে গেছে।
সে লিখেছে,- ‘আমাদের জাতীয় ফুল শাপলা, জাতীয় পাখি দোয়েল, কিন্তু আপনি কখনোই দাবি করতে পারবেন না যে আমাদের জাতীয় ধর্ম ইসলাম’।
মাস্টার সাহেব কোনদিন বাংলাদেশের সংবিধান খুলে দেখেছেন বলে মনে হয় না। সে ‘ইসলাম’ ধর্মকে জাতীয় ধর্ম দাবি না করলে কিছুই আসে যায় না। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধানের ২ (ক) ধারায় খুব স্পষ্ট করেই বলা আছে,- ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’। অর্থাৎ, আমাদের জাতীয় ধর্ম ইসলাম।
সে বলেছে,- ‘ধর্ম মানুষের অসম্ভব ব্যক্তিগত একটি ব্যাপার। একজন মুসলমান পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, হিন্দুরা পূজো দেন, খ্রিস্টানরা চার্চে যান। কিন্তু একটা রাষ্ট্র তো নিয়মিত মসজিদে যায় না’।
তার দাবি, মুসলিম রাষ্ট্র হতে হলে রাষ্ট্রকে নিয়ম করে মসজিদে যেতে হবে। তার কাছে প্রশ্ন,- জাতীয় পাখি দোয়েল, জাতীয় ফুল শাপলা আর জাতীয় মাছ ইলিশ দিয়ে রাষ্ট্র ঠিক কোন মহান কাজটা করে থাকে? এসব কি এমন ভ্যালু বাঙালিত্বে এড করে থাকে যে জাতীয় ফুল শাপলা হলে ইজ্জত রক্ষা পায় আর জাতীয় ধর্ম ইসলাম হলে ইজ্জত চলে যাবে? সেক্যুলারদের ইজ্জতগুলোর এতো বেহাল দশা কেনো ভাই?
সে লিখেছে,- ‘যতবারই একটা রাষ্ট্রের সাথে ধর্মকে জড়ানো হয়, ততোবারই এর ফলাফল রক্তক্ষয়ী হয়। সেই ১৯৪৭ সালের ভারতভাগের সময় জিন্নাহ সাহেব ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ এর নাম করে ধর্মের উপর ভিত্তি করে দুটো দেশ বানালেন- হিন্দুস্থান আর পাকিস্থান’।
এই জায়গায় ছেলেটা ইতিহাস নিয়ে কারচুপি করলো। আসলে কারচুপি নয়, অজ্ঞতা। স্যারদের সাইন্স ফিকশন পড়ে যাদের শৈশব-কৈশোর কেটেছিলো, তারা সত্যের কাছাকাছি কতোটুকুই বা আর আসতে পারে?
দ্বিজাতি তত্ত্বের কারণ যতোটা না ধর্মীয়, তারচেয়ে বেশি ছিলো অর্থনৈতিক এবং সামাজিক। সকল ইতিহাসবেত্তা এ ব্যাপারে একমত। তৎকালীন হিন্দু জমিদারগন মুসলমানদের উপর যে নির্যাতন আর অত্যাচার শুরু করেছিলো, তাদের অধিকার নিয়ে যে তামাশা শুরু করেছিলো, তাতে দু’টি রাষ্ট্রের পৃথক হওয়াটা অনির্বায ছিলো। আপসোস! ছেলেটা এখানে কেবল জিন্নাহ’র মুসলমানিত্বটাই দেখলো, কলকাতাকেন্দ্রিক জমিদারবাবুদের দাদাগিরিকে সে কতো সুন্দরভাবেই না পাশ কাটিয়ে চলে গেলো।
এরপর সে তার ইসলাম বিদ্বেষীতার চরম মুখোশটা থেকে বেরিয়ে এসে লিখলো,- ‘তারপর ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলিম ভাইয়েরা পূর্ব পাকিস্তানের লাখ লাখ বোনের সম্ভ্রম রক্ষার (!) ঈমানী দায়িত্বটুকু পালন করলেন’।
ইসলাম এবং মুসলমানদের নিয়ে তার সমস্ত ক্ষোভ, সমস্ত বিদ্বেষ সে এই ক’টি লাইনেই উগরে দিয়েছে। দোষ আসলে তার নয়, সে যাদের বইপত্র পড়ে ‘চেতনা’ ফেরি করতে শিখেছে, তাদের। তার স্যারদের বইপত্রেই তো টুপি-দাঁড়িওয়ালা মানেই রাজাকার। পাঞ্জাবি পরা মানেই খারাপ, ধর্ষক বলে চিত্রায়িত করা হয়েছে। ছোটবেলা থেকে তোতাপাখির মতো সেসব গিলতে গিলতে তাদের মতো শিষ্যগুলোও এখন সবখানে মুসলমানের ভূত দেখে। ১৯৭১ সালের পশ্চিম পাকিস্তানীদের খুন, ধর্ষণের জন্য সে একচেটিয়াভাবে মুসলিমদের দোষারোপ করেছে। আমি তার কাছে জানতে চাই, পূর্ব বাংলা থেকে যে মুক্তি ফৌজ গঠিত হয়েছিলো, যারা রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছিলো, তাদের কতোজন হিন্দু, খ্রিস্টান আর কতোজন মুসলিম? বীরশ্রেষ্ঠ তালিকার সাতজনের মধ্যে কতোজন মুখার্জী, রায়, ভট্টাচার্য, ধর আর পাল রয়েছে? এই জায়গায় এসে এসব চেতনাবাজরা আটকে যায়। তাদের গুরুরা যে মুক্তিযুদ্ধের বয়ান তৈরি করেছে, তা এই জায়গায় এসে মারাত্মকভাবে ধ্বসে পড়ে। যদি পশ্চিম পাকিস্তানীদের অত্যাচার, ধর্ষণের পুরো দায় মুসলমানদের হয়, তাহলে পূর্ব বাংলার মুক্তি আন্দোলনের, স্বাধীণতা অর্জনের পুরো কৃতিত্বও মুসলিমদের। এখানে তাদের মতো চেতনাবাজ আর সুশীলরা কথা বলার কে?
এরপর বাংলাদেশ শিক্ষাবোর্ডে কেনো ‘মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড’ নামে আলাদা বোর্ড আছে সেটা নিয়ে বেচারা খুব হতাশ। অবস্থা এমন, মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার সব ব্যয়ভার যেন তার মহামতি পিতার পকেট থেকে যায়।
ছেলেটা তার ল্যাব এক্সপেরিমেন্টে ব্যর্থ হলে নাকি ‘Fix You’ নামের কোন গান শুনতে শুনতে বাসায় ফেরে। এইটা নিয়ে নাকি একবার স্ট্যাটাস দিয়েছিলো। সেই স্ট্যাটাসে তার এক মেয়ে ফলোয়ার নাকি তাকে বলেছিলো,- ‘ভাঈয়া, গান শোনা হারাম’।
মেয়েটার এহেন সাহস দেখে সে খুব অবাক হয়। অবাক হয়ে ফতোয়া ঝাড়ে, - ‘যারা এরকম একটা সামান্য ব্যাপার নিয়ে হালাল হারামের প্রশ্ন তুলে, তারা বিশেষ বিপদের সময় না জানি ধর্মের নামে কি করে বসবে’।
আসলে, মেয়েটা হয়তো ওকে চিনতে ভুল করেছে। হতে পারে তার নাম দেখে সে বিভ্রান্ত হয়েছে। মেয়েটা কি আর জানতো সে আগাগোড়া সেক্যুলার ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে আছে? তার কাছে গান শোনা, মদ খাওয়া, ড্যান্স করা এর সবই প্রগতিশীলতার বৈশিষ্ট্য। এসব ব্যাপারে ধর্মে কি বলা আছে সেটা শোনার ওর টাইম আছে নাকি? বেচারি! উলুবনে মুক্তো ছড়াতে গিয়েছিলো।
এরপর বেচারা ইসলামকে কেনো একমাত্র সত্য আর বাকিসব ধর্মকে মিথ্যা বলা হয় সেই আলাপে চলে গেলো। বললো,- ‘আপনি আপনার ধর্মকে ভালোবাসবেন- এইটা আপনার অধিকার। কিন্তু আপনি যখন একজন হিন্দুকে বলবেন যে তার ধর্ম মিথ্যা, তখন সেইটা অবশ্যই অপরাধ। আপনার নিজের ধর্মকে ভালোবাসার অধিকার আছে, কিন্তু অন্যের ধর্মকে আঘাত করার অধিকার নেই’।
ওরে বাবা! এই লাইনগুলো পড়ে রীতিমতো যেন চমকে গেলাম। ভাবতে লাগলাম, ভিন্ন মতের প্রতি এই সেক্যুলার পোলাপাইন এত্তো শ্রদ্ধাশীল কবে থেকে? এরাই তো তারা, যারা ডারউইনিজমে বিশ্বাসী। ডারউইনিজমকে ধ্যান জ্ঞান মনে করে। আর যারা ডারউইনিজমের বিপক্ষে ‘ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন’ তত্ত্বের কথা বলতে চায়, সেসব বিজ্ঞানীদের এসব পোলাপাইন তো দু চক্ষেও দেখতে পারেনা। আর তাদের গুরু ডকিন্স, হ্যারিসদের কথা কি বলবো! মেইনস্ট্রীম বিজ্ঞান একাডেমিতে তো ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনার প্রবক্তাদের একপ্রকার নিষিদ্ধই করে রাখা হয়েছে। এরকম ‘গোঁড়া’ শ্রেণীর লোকদের মুখে যখন ‘শ্রদ্ধাশীলতা’র বয়ান শোনা যায়, তখন সেটাকে ‘মাছের মায়ের পুত্রশোক’ বলে মনে হয়।
শেষের দিকে বললো ওয়াজ মাহফিলের কথা। তার দুঃখ, কেনো মালিবাগ এলাকায় ওয়াজ হলে খিলগাঁও পর্যন্ত মাইক লাগানো হবে? কেনো মালিবাগের একজন হিন্দু ব্যক্তি ওয়াজের আওয়াজে ঘুমাতে পারবে না?
আরে বাবা! একটু আগেই তো সকলের সহাবস্থান, সকলে মিলিত হয়ে ‘ধর্ম নিরপেক্ষ’ রাষ্ট্রের বুলি আওড়ালো। তাহলে, ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র মানেই কি কেবল কালী দেবির পূজোয় মন্ডপের বাদ্য বাজনা আর মাইকের উচ্চস্বরে মন্ত্রপাঠ?
ধর্মনিরপেক্ষ মানেই কি ভ্যালেন্টাইন ডে তে আমার বাসার পাশে মাইক লাগিয়ে ‘খিচ মেরা ফটো’ হিন্দি গানের আসর? ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে বিভিন্ন দিবসে মাইকে উচ্চস্বরে গান বাজানো যাবে কিন্তু মুসলমানের বাচ্চারা ওয়াজে মাইক ব্যবহার করলেই আঁতে লাগবে? পাশের হিন্দু লোকটা ঘুমাতে না পারার কাফফারা দিতে হবে? এ কি আজব সেক্যুলারিজম রে বাবা!!!
এসকল চেতনাবাজরা যখন নিরপেক্ষতার কথা বলে, সহাবস্থানের কথা বলে, তখন ধরে নিতে হবে যে এদের নিশ্চিত কোন এজেন্ডা আছে। এদের দুনিয়ার কোন ধর্মে, কোন সংস্কৃতি নিয়ে আপত্তি নেই। এদের একমাত্র চুলকানির জায়গা হলো ইসলাম। কারণ, ইসলাম তাদের ‘খাও দাও ফূর্তি করো’ লাইফের সার্টিফিকেট দেয় না। সমস্যা এটাই।

No comments

Note: Only a member of this blog may post a comment.

Powered by Blogger.