সূর্য কথায় সেজদা দেয় ? / আরিফ আজাদ

সহী বুখারীর একটি হাদীস নিয়ে আমাদের মুক্তমনা সমাজ প্রায়ই ধোঁয়াশা তৈরির চেষ্টা করে থাকে। তাদের দাবি হচ্ছে, এই হাদীসটি সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক। যেহেতু বুখারীর মতো প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থে এটির উল্লেখ পাওয়া যায়, আর হাদীস শাস্ত্রে বুখারীর মান যেহেতু সবার উর্ধ্বে, এবং মুসলিমরা যেহেতু এটাতে বিশ্বাস করে, তাই ইসলাম এবং মুসলিমদের একহাত নেওয়ার সুযোগ তারা ছাড়ে না।
পুরো ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনায় যাওয়ার আগে একটি বিষয় ক্লিয়ার করে নিই। সেটা হচ্ছে, বাংলাদেশের মুক্তোমনা নামধারী ইসলাম বিদ্বেষীদের কথাবার্তা আর লেখাযোখা পড়লে মনে হয় এরা একেকজন ইসলাম, কোরআন, হাদীসের উপরে পিএইচডি করে ফেলেছে। মনে হয়, কোরআন হাদীসের উপরে থিসিস করতে গিয়ে এরা বিরাট বিরাট ভুল ধরতে পেরেছে, যার ফলে তারা ইসলামের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে।
আদতে আসল ব্যাপার হলো, কোরআন-হাদীস নিয়ে এদের জ্ঞান একেবারে শূন্যের কোঠায়। বলা চলে, এদের শতকরা ৯৯ ভাগ আরবি পড়তেই জানেনা।
তাহলে এরা সমালোচনা কীভাবে করে, তাইনা? আসল ব্যাপার হচ্ছে, এরা যে প্রশ্নগুলো ইসলাম নিয়ে করে থাকে, সেগুলো সব খ্রিষ্টান মিশনারীদের কাছ থেকে ধার করা।
খ্রিষ্টান মিশনারীদের এরকম প্রচুর সাইট আছে যেখানে বাংলা মুক্তোমনা ব্লগের মতো সারাদিন ইসলাম বিদ্বেষীতা চলে। বাংলাদেশের আর্টসে পড়ুয়া নাস্তিকবাহিনী (মূলত নাস্তিক নয়। এদের বেশিরভাগ একটি বিশেষ ধর্মের) সেখান থেকে ধার করে এনে নিজেরা বড় বড় ‘হনু’ সাজে। সম্ভবত ঠিক এই কারণেই তারা নিজেদের ধর্মবিরোধি বলে পরিচয় দিলেও, কখনোই তারা খ্রিষ্টান ধর্মের বিরুদ্ধে ‘টু’ শব্দও উচ্চারণ করেনা। কৃতজ্ঞতার ব্যাপার-স্যাপার আছে কীনা, তাই হয়তো 
যাহোক, মূল আলোচনায় ফিরে আসি। আমরা প্রথমে হাদীসটা দেখে নিই। হাদীসটি আছে বুখারী শরীফের চতুর্থ খন্ডের ৫৪ নাম্বার অধ্যায়ে। হাদীস নাম্বার হচ্ছে ৪২১।
হজরত আবু যা’র (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,- “রাসূল (সাঃ) আমার কাছে জিজ্ঞেস করলেন,- তুমি কী জানো (সূর্যাস্তের সময়) সূর্য কোথায় যায়?”
আমি বললাম,- “আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল ভালো জানেন”। তখন তিনি বললেন,- ‘এটা (নির্দিষ্ট পথে চলতে চলতে) আল্লাহর আরশের নিচে এসে সিজদা করে এবং উদয় হবার জন্য অনুমতি চায় এবং এটাকে অনুমতি দেওয়া হয়। এমন একটা সময় আসবে যেদিন এটাকে আর অনুমতি দেওয়া হবেনা (পূর্বদিক থেকে উদিত হবার জন্য) এবং এটাকে যেদিক থেকে এসেছে সেদিকে ফিরে যেতে বলা হবে। সেদিন এটা (সূর্য) পশ্চিম দিক থেকে উদয় হবে”।
এখান থেকে যে প্রশ্নগুলো তারা করার চেষ্টা করে তা হলো নিম্নরূপঃ
১/ বলা হচ্ছে, সূর্য আল্লাহর আরশের নিচে যায়। আমরা জানি, সূর্য তার নিজ কক্ষপথেই থাকে, কোথাও যায় না। তাহলে এইটা কীভাবে সম্ভব যে, সূর্য আরশের নিচে যায়?
২/ সূর্য কীভাবে সিজদা করতে পারে? এই প্রশ্নের সাথে সম্পূরক প্রশ্ন হচ্ছে,- সিজদা করতে হলে সূর্যকে তার কাজ (ঘূর্ণন) থামাতে হবে। জোতির্বিজ্ঞান বলছে, সূর্য নিজ কক্ষপথে অবিরত ঘূর্ণন অবস্থায় থাকে। তাহলে সূর্য সিজদাটাই বা করে কখন আর অনুমতিটাই বা পায় কখন?
৩/ সূর্য পশ্চিম দিক থেকেই বা কীভাবে উদিত হবে? এটা কী বিজ্ঞানসম্মত কীনা?
প্রথমে এক নাম্বার প্রশ্নটা নিয়ে ভাবা যাক। এটার উত্তর জানার জন্য আমাদেরকে আগে জানতে হবে আল্লাহর আরশ কোথায়। আল কোরআন, সহী হাদীস এবং সালাফদের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, আল্লাহর আরশ হচ্ছে সবকিছুর উর্ধ্বে। অর্থাৎ, দৃশ্যমান-অদৃশ্যমান (পৃথিবী, আকাশ, গ্যালাক্সি, পদার্থ) এই মহাবিশ্বের সবকিছুর উপরে আল্লাহর আরশ অবস্থিত। এই “সবকিছুর” মধ্যে কিন্তু সূর্যও পড়ে। সুতরাং, “সূর্য আল্লাহর আরশের নিচে কিভাবে যায়” প্রশ্নটা অবান্তর। কারণ, সূর্য নিজেই আলটিমেটলি আল্লাহর আরশের নিচেই আছে। আল্লাহর আরশের নিচে যাওয়ার জন্য সূর্যকে আলাদাভাবে তার কক্ষপথ ছাড়তে হয়না। নিজ কক্ষপথে থেকেই সূর্য আল্লাহর আরশের নিচে অবস্থান করছে।
দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, সূর্য কীভাবে সিজদা করতে পারে?
এটা বোঝার আগে আমাদের বুঝতে হবে, সিজদা বলতে আমরা যা বুঝি, এখানেও এই অর্থ বোঝায় কীনা? সিজদা আমরা কীভাবে দিই? হাত-পা মাটিতে রেখে, মাথা-নাক-কপাল মাটিতে স্পর্শ করাই হলো আমাদের সিজদার পদ্ধতি।
সূর্যের কী হাত-পা আছে? নাক-কপাল আছে? যদি না থাকে, তাহলে সূর্য সিজদা কীভাবে দেয়?
নাস্তিক তথা ইসলাম বিদ্বেষীদের বড় সমস্যা হচ্ছে, তারা সবকিছুর আক্ষরিক অর্থ করে থাকে। কোরআন এবং হাদীসের কিছু কথা আছে সাহিত্যের মতো করে। রূপক, উপমা যেভাবে আমএয়া ব্যবহার করি।। এই কথাগুলোর অর্থ যদি আপনি আক্ষরিক ধরেন, তাহলে কিন্তু বিপদ। সাহিত্যে এই “মেটাফোর” নিয়ে গাদা গাদা বইপত্র আছে। বাংলা নাস্তিকরা আর যাইহোক, সাহিত্যটা কিন্তু ভালো পড়ে থাকে।
একটা এক্সাম্পল দিই। জীবনানন্দ দাশ উনার এক কবিতায় লিখেছেন,- “বিষণ্ন বিকেলে আমি পকেটে আকাশ নিয়ে ঘুরি”
এখন বলুন, পকেটে কী আকাশ নিয়ে ঘুরা যায়? এইটাকেই বলে মেটাফোর। এটা না বুঝলে আপনার কাছে জীবনানন্দ দাশকে স্রেফ একজন পাগল মনে হবে। কিন্তু এর গভীরতা বুঝলে, জীবনানন্দকে আপনার কাছে শেক্সপিয়ার কিংবা দস্তয়ভস্কির চাইতেও বেশি ভালো লাগবে।
এবার আসুন সূর্যের সিজদা নিয়ে। সিজদা মানে আমরা কী বুঝি? কারো কাছে বিনত হওয়া, অবনত হওয়া, অনুগত হওয়া। আরো অর্থ করা যায়, যেমন- রুলস মেনে চলা , নিয়মাধীন হওয়া ইত্যাদি।
সূর্যের সিজদাও কী আমাদের মতো হতে হবে? আচ্ছা বলুন তো, আপনার ‘বসা’ আর দইয়ের ‘বসা’ কী এক?
আমরা যে বলি, দধি বসেছে বা দুধের উপর ছনা (আমাদের আঞ্চলিক ভাষায় ছানা বলি) বসেছে।
দুধের উপর ছানা কী আমাদের মতোই বসে? হাত পা গেঁড়ে? দুইটাই তো বসা। কিন্তু দুইটা বসাই কী এক? এক না।
তাহলে সূর্যের সিজদাকে কেনো আমাদের সিজদার মতোই হতে হবে?
তাহলে, বুঝা গেলো , সূর্যের সিজদা আর আমাদের সিজদা এক নয়।
এবার আসুন, সিজদা দেওয়ার জন্য কী সূর্যের থেমে যাওয়াটা জরুরি?
এই জিনিসটা বোঝার জন্য একটা জিনিসের অবতারণা করি। আগেই বলেছি, মেটাফোরিক্যাল জিনিসগুলোকে আমাদেরকে ঠিক সেভাবেই ভাবতে হবে। আক্ষরিক অর্থ করা যাবেনা।
স্কুল লাইফে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় মেয়েদের কমন একটা খেলা দেখতাম। খেলাটার নাম হলো- ‘চেয়ার খেলা’।
এই খেলার নিয়ম হচ্ছে- গোলাকারভাবে কিছু চেয়ারকে সারিবদ্ধভাবে সাজিয়ে রাখা হয়।
একটা মিউজিক প্লেয়ারের ব্যবস্থা থাকে। প্রতিযোগীরা সারিবদ্ধভাবে সাজিয়ে রাখা এই চেয়ারগুলোকে কেন্দ্র করে চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। যতোক্ষণ পর্যন্ত না মিউজিক অফ হচ্ছে, প্রতিযোগীরা এই চেয়ারগুলোকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকে। মিউজিক অফ হওয়া মাত্র টুপ করে বসে পড়ে।
চিন্তা করে দেখুন, প্রতিযোগীদের কাজ হচ্ছে চেয়ারগুলোকে কেন্দ্র করে চক্রাকারে ঘুরবে।
তারা কতক্ষণ ঘুরবে? যতক্ষণ পর্যন্ত না মিউজিক অফ হচ্ছে।
তারা কিন্তু নির্দিষ্ট একটা পয়েন্ট (নিজ নিজ চেয়ার) থেকে খেলাটা শুরু করে। এখন, একবার চক্রাকারে ঘুরে নিজ নিজ চেয়ারের কাছে এসে কোন প্রতিযোগী কি ‘গেম ডিরেক্টর’ কে বলে, “স্যার, আমি কী পরের চক্র ঘুরে আসবো?” বলে না।
বলেনা , কারণ- পরের চক্র দেওয়ার পারমিশানটা তার জন্য একটা চলমান (On Going) প্রক্রিয়া। তাকে চেয়ারের কাছে এসে থেমে স্যারের অনুমতি নিয়ে পরের চক্র দিতে হচ্ছেনা। নিজের চেয়ারের কাছে এসে না থেমেই সে দ্বিতীয় চক্কর দিতে পারবে, কারণ অনুমতিটা বলবৎ একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। কতক্ষণ সেই সময়? যতোক্ষণ না মিউজিক অফ হচ্ছে।
ঠিক এভাবেই সূর্যের জন্য একটা নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া আছে। সেই সময় পর্যন্ত সে এভাবেই চক্রাকারে ঘুরতে থাকবে। এই ঘুরার মধ্যেই সে দুটি কাজ করবে। একটি হলো- নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সে ঘুরবে, অন্যটা হলো,- সে নির্দিষ্ট পয়েন্টে এসে (ধরা যাক সেটা আল্লাহর আরশের কেন্দ্র বরাবর) আল্লাহর কাছে পরেরবার ঘুরার (উদিত হওয়ার) জন্য অনুমতি চাইবে। কিন্তু এই অনুমতি নেওয়ার জন্য তাকে তার গতি স্তিমিত করতে হবেনা। থামতে হবে না। কারণ, খেলার প্রতিযোগীর মতোই তার জন্যও অনুমতিটা একটা চলমান (On Going) প্রক্রিয়া।
সুতরাং, অনুমতি নেওয়ার জন্য সূর্যের লুটে পড়ার বা থেমে যাবার কোন দরকার নেই। সূর্য তার On Going Process এর মধ্যেই সেটা সেরে নেয়।
(And after all, Allah knows best)
তৃতীয় প্রশ্ন- সূর্যের পশ্চিম দিক থেকে উদিত হওয়াটা কী বৈজ্ঞানিক?
এটা নিয়ে বেশি কথা বলতে চাই না, কারণ, অনেক বিজ্ঞানীই এটা প্রেডিক্ট করেছেন যে, সূর্য তার সমস্ত তাপ হারানোর প্রাক্কালে তার উদয়-অস্তের দিক চেইঞ্জ করে ফেলতে পারে। চেইঞ্জ হয়ে যেতে পারে পৃথিবীর দিকসমূহ। তারা নির্দিষ্ট করেই বলেছে, - সূর্য পশ্চিম দিক থেকে উদয় হতে পারে। ব্রিটেইনের লিডিং নিউজ পেপার “ডেইলি এক্সপ্রেস” শিরোনাম করেছে- “Sunrise in the west: North could be south as earth’s magnetic poles switch”
আই হোপ, বিজ্ঞানের ধোঁয়া তোলা আমাদের মুক্তোমনাগণ এটলিস্ট বিজ্ঞানীদের বাণীকে বিনাবাক্যে মেনে নিবে 
সংযুক্তি- একটি প্রশ্ন ক্লিয়ার করা হয়নি। সূর্য যদি আরশের নিচেই থাকে, তাহলে আলাদাভাবে আবার আরশের নিচে যেতে বলার কারণ কী?
সিম্পল। ধরুন, একটি পুরো জায়গাজুড়ে মসজিদ আছে। এখন,মসজিদের ঈমাম সাহেব যদি আপনাকে বলে, - 'মসজিদ থেকে আমার চশমাটা নিয়ে আসুন।'
আপনি কী মসজিদ বলতে কেবল মসজিদের প্রথম কক্ষটিকেই ধরে নিবেন? নাহ। মসজিদে অনেকগুলো স্থান আছে। মিম্বর আছে। সবগুলোই মসজিদের আওতাভুক্ত। এমতাবস্থায়, মিম্বরকে আলাদাভাবে উল্লেখ না করা মানে এই না, মিম্বর মসজিদের বাইরের কিছু।
সেরকম, সূর্য আরশের নিচেই আছে কিন্তু একটা পয়েন্ট নির্ধারিত আছে যেখানে এসে এটি অনুমতি নিবে, (চেয়ার খেলায় যেমন প্রত্যেকের নির্দিষ্ট একটা চেয়ার থাকে যেখান থেকে সে শুরু করে) যেরকম মসজিদের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় (মিম্বরে) এসে আপনি ঈমামের চশমাটা খুঁজে পাবেন।
এখন আপনি পাল্টা প্রশ্ন করতে পারেন না, - 'হুজুর আপনি মসজিদ বলেছেন, মিম্বর বলেন নি.... 

No comments

Note: Only a member of this blog may post a comment.

Powered by Blogger.