শুনলাম আর মেনে নিলাম! / আরিফ আজাদ

আধুনিক যুগ। বিজ্ঞান চলে গেছে অনেক দূরে। সময়ের সাথে সাথে পাল্টাচ্ছে আমাদের সবকিছু। আমাদের বলতে এখানে আমি বেসিক্যালি মুসলিমদেরকেই বোঝানোর চেষ্টা করছি।
বিজ্ঞানের যুগে বসে আমরা এখন সবকিছুতে “বিজ্ঞান” থেকে সমাধান খুঁজি। ধর্মগ্রন্থ থেকে শুরু করে রাসূল (সাঃ) এর হাদীস- সবখানে বিজ্ঞান পেলেই যেন আমরা জয়ী হয়ে যাই।
মাঝে মাঝে অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করে,- “আরিফ ভাই, আল্লাহর রাসূল যে মি’রাজে গেছেন, এটাকে বৈজ্ঞানিকভাবে কীভাবে প্রুফ করবো?”
“আরিফ ভাই, বোরাকের মতো কোন জন্তুর পক্ষে কী আলোর চেয়ে বেশি বেগে ছুটা সম্ভব? যদি সম্ভব না হয়, তাহলে রাসূল (সাঃ) বোরাকের পিটে চড়ে কীভাবে মি’রাজে গেলেন? এটার কী বিজ্ঞানভিত্তিক কোন ব্যাখ্যা আপনার কাছে আছে?”
এই প্রশ্নগুলো আমার কাছে যারা করছে, সমস্যাটা তাদের নয়। আদতে, নাস্তিকদের কাছ থেকে তারা এই জাতীয় প্রশ্নাবলী শুনেই হতাশ হয় এবং এসবের একটা রিজনেইবল উত্তর খুঁজে। পেলে হয়তো ভাবে নাস্তিকদের তোঁথা মুখ ভোঁতা করে দেওয়া যাবে। এই জাতীয় প্রশ্ন কিন্তু নাস্তিকরাই যে প্রথম করছে, তা নয়। রাসূল (সাঃ) মি’রাজের সফর শেষ করে আসার পরে যখন এই ঘটনা বলতে লাগলেন, তখন মক্কার মুশরিক, কাফিররাও এটাতে বিশ্বাস করতে পারেনি।
আজ থেকে সাড়ে চৌদ্দ’শ বছর আগেও এরা ভাবতো, - “একটা মানুষের পক্ষে একটা জন্তুর পিঠে চড়ে সাত আসমান পরিভ্রমণ করে আসা কীভাবে সম্ভব? মুহাম্মদ নিশ্চই মিথ্যা বলছে”।
এই মুশরিক, কাফিররা তখন হজরত আবু বকর (রাঃ) এর কাছে গেলো। ব্যঙ্গভরে বললো,- “শুনছো, তোমাদের নবী দাবি করছে সে নাকি কী এক সাদা জন্তুর পিঠে চড়ে গতরাতে বায়তুল মুকাদ্দিস থেকে ঘুরে এসেছে”।
তাদের কথা শুনে হজরত আবু বকর (রাঃ) বললেন,- “যদি মুহাম্মদ (সাঃ) এরকম বলে থাকে, তাহলে সেটাই সত্য”।
হজরত আবু বকর (রাঃ) এর উত্তরটা খেয়াল করুন। তিনিও কিন্তু সাড়ে চৌদ্দ’শ বছর আগের সেইসব লোকদের মতোই, যাদের কাছে একটা জন্তুর পিঠে চড়ে আসমান (বায়তুল হারাম থেকে বায়তুল মুকাদ্দিস) ভ্রমণ করতে পারাটা অসম্ভব। কিন্তু, সেটা যখন মুহাম্মদ সাঃ ঘোষণা করেছেন, তিনি নির্বিঘ্নে সেটাতে বিশ্বাস করলেন। এটার নামই হচ্ছে ঈমান। এই ঈমান যাদের আছে, তাদের ব্যাপারেই আল কোরআনে বলা হয়েছে, এরা হচ্ছে এমন যারা বলে “আমরা শুনলাম এবং মেনে নিলাম”।
সাড়ে চৌদ্দ’শ বছরকে আমরা অতিক্রম করে অনেকদূর চলে এসেছি। জ্ঞান-বিজ্ঞান এগিয়েছে অনেকদূর। সাড়ে চৌদ্দ’শ বছর আগে যাদের কাছে আকাশে উড়তে পারাটা ‘অসম্ভব’ ব্যাপার ছিলো, তারা অতীত হয়ে গেছে। আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের দেখিয়েছে, কেবল আকাশে উড়তে পারা নয়, আলোর গতির সাথে দ্রুততায় পাল্লা দেবার ক্ষমতাও মানুষ রাখে। মানুষ এরপর উড়োজাহাজ দেখলো, প্লেন দেখলো, রকেট দেখলো। কতো দ্রুতগামী আকাশযানের সাথেই সে পরিচিত হলো। সে বর্তমানে বসে নেই আর। সে এমন দ্রুত গতির যান তৈরিতে গবেষণাগারে খেটেখুটে হয়রান, যেটা তাকে অগ্রিম “ভবিষ্যৎ” এর দুনিয়ায় পৌঁছে দেবে। অর্থাৎ, যেটাকে এখন “টাইম ট্রাভেল” বলা হয়। এই যানের পিটে চড়ে মানুষ চষে বেড়াচ্ছে মঙ্গল থেকে নেপচুন। প্লুটোর পাশ দিয়ে ঘুরে এসে ক্যামেরায় ধারণ করে আসছে সে গ্রহের পরিবেশ। পাড়ি জমাচ্ছে মহাকাশের এ প্রান্ত থেকে ও’প্রান্ত। মানুষ যে আকাশে উড়তেও পারে, তা সম্ভব করে দেখিয়েছে বিজ্ঞান। আমরা দেখছি আজ ।
কিন্তু তবুও, সেই চৌদ্দ’শ বছর আগের সেই প্রশ্ন কী বন্ধ হয়ে গেছে? নাহ, হয়নি। সে প্রশ্ন এখনো জিইয়ে আছে। পৃথিবীর শেষদিন পর্যন্তই থাকবে।
বাহনের পিটে চড়ে আকাশেও যে উড়া যায় এই কনসেপ্ট এখন ক্লিয়ার। তবুও প্রশ্ন,- “ভাই, রাসূলের মি’রাজ গমনের কী কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে?”
না ভাই। এটার কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই। এটা একটা মিরাকল। সুপার ন্যাচারাল জিনিস।
আমি বা আপনি ল্যাবরেটরিতে বসে ক্যালকুলেশান করে রাসূল ঘণ্টায় কতো কিলোমিটার পাড়ি দিয়েছিলেন তা বের করতে পারবো না। কোন টেলিস্কোপে চোখ লাগিয়ে দিয়ে “বুরাক্ব” নামের সেই বাহনের অস্তিত্ব নির্ণয় করতে পারবো না। কারণ, এটা হলো একটা সুপার ন্যাচারাল ঘটনা। খাঁটি বাংলায় ‘অতি-প্রাকৃত’। এই ঘটনার কোন ন্যাচারাল ব্যাখ্যা হবে না। যদি হতো, তাহলে এটা তো আর মিরাকল হতো না। এটা রাসূলের জীবনে ঘটা অন্য দশ ঘটনার মতোই অহরহ ঘটতো। ঘটেছে কী অহরহ? না, ঘটেনি। ঘটেনি কারণ, এটা মিরাকল।
তাহলে আমাদের করণীয় কী? কোরআনের ভাষায়- “শুনলাম এবং মেনে নিলাম”।
বিজ্ঞানের ব্যাপার যখন এসেছে, তখন আরেকটু আলোচনা করি। বিজ্ঞানের ধর্ম হচ্ছে, বিজ্ঞান সদা পরিবর্তনশীল। বিজ্ঞান প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হয় বা হতে পারে। কিন্তু “বিশ্বাস” এর ধর্ম এমন যে, সেটা অপরিবর্তনীয়।
বিজ্ঞান কাজ করে কিছু প্রাপ্ত তথ্য, কিছু ধারণার উপর ভিত্তি করে। বিজ্ঞান দিয়ে এই কারণে ধর্ম বা ধর্ম গ্রন্থকে জাস্টিফাই করতে গেলে বিপদ।
বারো শতাব্দীর শুরুর দিকে, বিজ্ঞানীরা যখন পৃথিবীকে কেন্দ্র বলতো আর সূর্য পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে বলতো, বা তারও পরে, পনেরো শতাব্দীতে যখন বিজ্ঞানীরা সূর্যকে কেন্দ্র আর স্থির বলতো, বাকিসব সূর্য কেন্দ্রিক ঘোষণা করলো, তখনও কিন্তু কোরআন বলছিলো- ‘সূর্য ও চন্দ্র নিজ নিজ কক্ষপথে আবর্তনশীল’। তখনকার সময়ে বসে, আজ থেকে কয়েক শতাব্দী আগে কেউ যদি তখনকার বিজ্ঞান দিয়ে আল কোরআনকে জাস্টিফাই করতো এবং বিজ্ঞানের ফলাফলকে ‘ফাইনাল’ ধরে নিতো, তাহলে কী হতো?
এটাই হচ্ছে বিজ্ঞান এবং বিশ্বাসের মধ্যকার বেসিক ডিফারেন্স। বিজ্ঞানের এখনো অনেকদূর যাওয়ার বাকী আছে। ২০১১ সালে ‘ডার্ক ম্যাটার এবং কসমিক একসিলারেশান’ লোকেইট করতে পারার জন্য পদার্থবিজ্ঞানে একদল বিজ্ঞানীদের নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। সেই বিজ্ঞানীদলের একজনের ইন্টার্ভিউতে পড়েছিলাম, তিনি দাবি করেছেন, - এই মহাবিশ্ব নিয়ে বিজ্ঞানীদের জ্ঞান এখনো মাত্র ৪%। অর্থাৎ, আজকের সময়ে বসেও, বিজ্ঞান এখনো পুরো মহাবিশ্বের মাত্র ৪% জানে, বাকি ৯৬% এখনো অজানা। এই হচ্ছে এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানের অগ্রগতি।
এই বিজ্ঞান জ্বীনে বিশ্বাস করেনা বা করতে চায় না, কিন্তু ‘এলিয়েন’ খোঁজার জন্য প্রতিবছর কোটি কোটি ডলার খরচ করে।
যাহোক, বিজ্ঞান যতো আগাবে, আমরাও ততো আগাবো। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বিজ্ঞান যেন আমাদের বিশ্বাসের মাপকাঠি না হয়।
শেষ করার আগে বিজ্ঞানের আরেকটি টুইস্ট দিয়ে শেষ করি। রাসূল সাঃ এর একটি হাদীস আছে ‘বদনজর’ বা ‘কু-নজর’ নিয়ে। আবুদাঊদ শরীফে এটার উল্লেখ পাওয়া যায়। ইংরেজিতে বলা হয় ‘Evil Eye”…
রাসূল সাঃ বলেছিলেন,- ‘বদনজর সত্য’।
যেহেতু রাসূল সাঃ বলেছেন তাই এটাতে আমরা বিশ্বাস করি। বিজ্ঞান এটাকে কীভাবে, কোন পারস্পেকটিভ থেকে দেখে সেটা আমাদের বিবেচ্য নয়।
পশ্চিমা দেশেও এই ‘বদ নজর’ বা ‘Evil Eye’ কে স্রেফ কুসংস্কার ভাবা হতো। আমাদের কিছু মডারেট মুসলিমরাও এটাকে কুসংস্কার মনে করে।
কিন্তু মজার ব্যাপার, ২০১০ সালে Collins A. Ross নামের এক রিসার্চার এই ‘Evil Eye’ বা বদ নজরের উপর গবেষণা চালিয়ে দেখেছেন, এই বদ নজর কোন কুসংস্কার নয়। এটার সাইন্টিফিক ব্যাখ্যা আছে। তিনি “Electrophysiological basis for the Evil Eye belief” শিরোনামের একটি গবেষণা পত্রও তৈরি করেন উনার রিসার্চের উপর। উনার সেই পেপার পাবলিশড হয় “Anthropology Of Consciousness” নামক জার্নালে। ভদ্রলোক এটার উপর ব্যাপক কথাবার্তা , তথ্য প্রমাণ দাখিলের চেষ্টা করেছেন।
এটা নিয়ে পশ্চিমা বিজ্ঞান দুনিয়ায় এখন রিসার্চ হচ্ছে। রিসার্চ হোক।
কিন্তু, আমাদের কথা হলো, ভদ্রলোক এই রিসার্চ না করলে কী আমরা রাসূলের হাদীসে বিশ্বাস করতাম না? অবশ্যই করতাম। উনার রিসার্চ ভুল হলে কী আমরা রাসূলের কথাকে অস্বীকার করবো? নাহ, করবো না। কারণ, - “আমরা শুনলাম, এবং মেনে নিলাম”।

No comments

Note: Only a member of this blog may post a comment.

Powered by Blogger.