‘আমরা তো স্রেফ বন্ধু কেবল’/ আরিফ আজাদ

‘আমরা তো স্রেফ বন্ধু কেবল’/ আরিফ আজাদ
আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের একভাই একবার আমার কাছে তার মধুর প্রেমের গল্প করতে লাগলো। দু’জন দুই ডিপার্টমেন্টের। শাটল ট্রেনে তাদের পরিচয়। চোখাচোখি, আলাপ এবং বন্ধুত্ব। প্রথমদিকে তারা কেবল ‘বন্ধু’ ছিলো। বন্ধু মানে কি? একজন অন্যজনের খোঁজ-খবর রাখবে, সুখের-দুঃখের আলাপ করবে, শেয়ার আর কেয়ারে কাণায় কাণায় ভরে উঠবে বন্ধুত্বময় জীবন।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তো, বন্ধুত্ব থেকে প্রেম কিভাবে?’
সে বললো, ‘এটা আসলে হয়ে যায়’।
আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিভাবে হয়ে যায়?’
এরপর সে বললো, ‘প্রথম প্রথম দু’জনে দু’জনের খুব কেয়ার করতাম। একসাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা, নানান গল্প করা, ভালো লাগা মন্দ লাগা শেয়ার করা, বাড়িতে চলে যাওয়ার পরেও ফোনে কথা বলা ইত্যাদি...’।
- ‘তারপর?’
- ‘তারপর একটা সময়ে গিয়ে বুঝলাম, কাজগুলো আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সে বিশ্ববিদ্যালয়ে না আসলে আমারও যেতে মন চাইতো না, সে ক্লাস মিস করে বেরিয়ে এলে আমিও ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে পড়তাম। সে অসুস্থ হলে একটু পর পর ফোন দিয়ে তাকে খাওয়ার কথা, ঔষুধের কথা মনে করিয়ে দিতাম। তার মন খারাপ হলে আমারও মন খারাপ হয়ে যেতো’।
- ‘তারও কি ঠিক একইরকম অনুভূতি হতো?’
- ‘হ্যাঁ’।
- ‘এরপর?’
- ‘এরপর আর কি! আমাদের মধ্যে প্রেম হয়ে গেলো...’।
ঘটনার এখানেই সমাপ্তি টেনে দিই। তাদের সেই প্রেম সফল হয়েছিলো কিনা, তাদের বিয়ে হয়েছিলো না ব্রেকআপ- সেসব আমার আলোচ্য বিষয় নয়। আমার আলোচ্য বিষয় অন্যকিছু।
ছেলেটাকে মোটামুটি ধার্মিক বলে জানতাম। জিরো পয়েন্ট এলাকার মসজিদে একসাথে প্রায়ই যোহরের সালাত পড়তাম। মজার ব্যাপার হলো সে সালাতের মধ্যে দোয়া করতো যেন তাদের দু’জনের সম্পর্কটা টিকে থাকে। বেশ সৎ প্রেমিক ছিলো বলা যায়!
দুঃখের ব্যাপার হলো এই, বিশ্ববিদ্যালয়েজুড়ে এরকম হাজার হাজার মুসলিম ছেলেমেয়ে আছে যাদের কাছে পর্দার সঠিক জ্ঞানটা নেই। আমি দেখেছি এরা মোটামুটি ধর্ম মানে। অনিয়মিত হলেও সালাত পড়ে। কিন্তু, পাশাপাশি প্রেমও করে। ক্যাম্পাসজুড়ে এরকম অসংখ্য হিজাবী আপু (যদিও তাদের টাইট-ফিট বোরকাটাকে হিজাব বলতে আমার ঢের আপত্তি আছে) ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে যারা বোরকা পরে, নিক্বাব করে, আবার একইসাথে বয়ফ্রেন্ড মেনটেইন করে।
একজন মুসলিম ছেলে এবং মেয়ের অবশ্যই জানা উচিত যে, যে দ্বীনের উপর সে জন্মগ্রহণ করেছে, সেই দ্বীন তার জন্যে কিছু নিয়ম, কিছু রুলস, কিছু সুযোগ এবং কিছু সীমানা নির্ধারণ করে দিয়েছে। সে নিয়ম এবং রুলসগুলো মানতে বাধ্য। সুযোগগুলো সে অনায়েশে নিতে পারে, এবং সে কখনোই দ্বীন কর্তৃক নির্ধারিত সীমানার বাইরে যেতে পারবেনা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মুসলিম তরুণকে জিজ্ঞেস করুন সে কুরআনে বিশ্বাস করে কিনা? সে বলবে, ‘আলবৎ করি। আমি একজন মুসলিম। কুরআনে বিশ্বাস না করলে আমি কিভাবে মুসলিম হবো?’
তাকে আবার বলুন, ‘আচ্ছা, কুরআনে যা করতে বলা হয়েছে তা না করলে, বা তার উল্টো কিছু করলে কি হবে?’
সে বলবে, ‘গুনাহ হবে’।
আচ্ছা ঠিক আছে। এবার তাকে বলুন, ‘ভাই, আল্লাহ সুবনাহু ওয়া’তায়ালা কুরআনে বলছেন ‘মুমিন পুরুষদের বলে দিন তারা যেন দৃষ্টি সংযত করে চলে এবং তাদের গোপন অঙ্গের হেফাজত করে’। এখন, এই যে আপনি বেপর্দা একজন মহিলাকে ‘গার্লফ্রেন্ড’ নাম দিয়ে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, আপনি কি মনে করছেন না যে আপনি আল্লাহর হুকুমের বিরোধিতা করছেন? মহিলাটা আপনার জন্য মাহরাম নয়। তার সাথে ঘুরে বেড়ানো তো দূর, তার সাথে চোখ তুলে কথা বলার অনুমতিও তো শরীয়াহ আপনাকে দেয়না। সেখানে আপনি তাকে নিয়ে ঘুরছেন, খাচ্ছেন, খাইয়ে দিচ্ছেন, হাসাহাসি করছেন, ফোনে কথা বলছেন। এটা তো পুরোদাগে শারীয়াহ বহিঃভূত কাজ’।
সমস্যাটা হলো, তাদের কাছে ইসলামটা একটা ধর্মই থেকে গেলো, দ্বীন (জীবনব্যবস্থা) হয়ে উঠতে পারেনি। তাদের কাছে পর্দার ব্যাপারটা পরিষ্কার নয়। মাথায় একটা কাপড় পেছিয়ে এবং একটা টাইট বোরকা পরলেই কেবল ধর্মোদ্ধার হয়না। একজন পুরুষের সাথে অবাধ মেলামেশার ব্যাপারটাকে তারা এতো তুচ্ছভাবে দেখে, যেন এটা হাঁচি দেওয়ার পরে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলতে ভুলে যাওয়ার মতো খুব নগন্য কোন বিষয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ভাইটা বলেছিলো তারা প্রথমে বন্ধু হয়, এরপর বন্ধু থেকে জান, সোনা, ময়না,পাখি হাবিজাবি! আসলেই ঠিক। শয়তান তার পরিকল্পনাকে এভাবেই বাস্তবায়ন করে। আল্লাহর রাসূল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘একজন মহিলা এবং একজন পুরুষ যখন একাকী থাকে, তখন সেখানে তৃতীয় পক্ষ হিশেবে শয়তান উপস্থিত হয়’। [১]
এই শয়তান প্রথমে তাদের স্রেফ ‘বন্ধু’ বানায়। এরপর আস্তে আস্তে তাদের নিয়ে যায় ফিতনার দ্বারপ্রান্তে।
প্রশ্ন করা হয়, ‘বিবাহ বহিঃভূত প্রেম ভালোবাসা জায়েজ কিনা?’ ইসলামে যেখানে একজন নারীর জন্য তার খালাতো ভাই, মামাতো ভাই আর চাচাতো ভাইরা মাহরাম (যাদের সামনে যাওয়ার অনুমতি শারীয়াহ প্রদান করে) নয়, সেখানে ক্যাম্পাসের এক অপরিচিত ছেলের সাথে মেলামেশা করা, তার সাথে প্রেম ভালোবাসা জায়েজ হবার তো প্রশ্নই আসেনা।
যার অন্তরে আল্লাহ ভীতি আছে, যে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে যে সে আজ হোক বা আগামীকাল মারা যাবে, তাকে আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে হবে- সে কখনোই ফ্রি মিক্সিংয়ে বিশ্বাসী হতে পারেনা। সে কখনোই একজন নন মাহরামের সাথে অপ্রয়োজনে কথা বলতে পারেনা। সে কখনোই পর্দার লঙ্গন করতে পারেনা- হোক সেটা তার পরিবার অথবা শিক্ষাঙ্গনে।
একজন তাকওয়াবান পুরুষ কখনোই একজন নন মাহরাম মহিলার দিকে তাকাতে পারেনা। অসাবধানে দৃষ্টি চলে গেলেও সে তা নামিয়ে নেয়। সে নিজের ঈমানের হেফাজত করে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুবকদের সামর্থ্য থাকলে বিয়ে করতে বলেছেন, নতুবা রোজা রাখতে বলেছেন। প্রেম করতে বলেননি। অবাধ মেলামেশা করে সময় কাটাতে বলেননি।
একজন নারী, যে কাঠফাঁটা রোদের মধ্যেও পরিপূর্ণ হিজাব পরিধান করে, সে জানে তার এই সেক্রিফাইসের মধ্যে কি এক মজা লুকিয়ে আছে। সে জানে কিয়ামতের মাঠের সেই বিভীষিকাময় দাবদাহের চেয়ে দুনিয়ার এই তাপ কিছুই নয়। সে কিয়ামতের মাঠের সেই তাবদাহ থেকে বাঁচতে, দুনিয়ার তাপটুকু হাসিমুখে সয়ে নেয়। তার কাছে এই হিজাবই সম্মান।
একজন পুরুষ, যে তার সকল কামনা-বাসনাকে জমিয়ে রাখে কেবল আল্লাহর প্রতিশ্রুত সেই নারীর জন্য যেখানে বলা হচ্ছে ‘মুমিন নারী মুমিন পুরুষের জন্য’। [২]
সে জানে দুনিয়ার লিজা, লাকি, সাদিয়া আর সুমাইয়ারা- যারা তাদের শরীর প্রদর্শনে ব্যস্ত, তারা তার জন্যে নয়। তার জন্যে আল্লাহ তা’য়ালা একজন মুমীনাকে হেফাজত করছেন যার প্রতিশ্রুতি তাকে কুরআন দিচ্ছে। সে অপেক্ষা করে। দোয়া করে। সবর করে। সিয়াম রাখে।
‘বন্ধু’ তো সে, যে বিপদে পাশে থাকে, সাহায্যকারী হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে যে নারীকে আপনি আজ স্রেফ ‘বন্ধু’ বানাচ্ছেন, আগামীকাল সে আপনাকে জাহান্নামের জ্বালানী বানিয়ে দিবে না তো?
আজ যে ছেলেটাকে আপনি ‘বন্ধু’ বানিয়ে নিচ্ছেন, আগামীকাল সে আপনার জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবার কারণ হয়ে দাঁড়াবে না তো?
রেফারেন্সঃ
(১) Ahmad, Al-Tirmidhī & Al-Hākim
(২) Sura Aan-Nur

No comments

Note: Only a member of this blog may post a comment.

Powered by Blogger.