আসহাবে কাহাফ/ আরিফ আজাদ
সূরা কাহাফের 'আসহাবে কাহাফ' তথা 'গুহাবাসী যুবকদের' মতোই বিস্ময়কর ঘটনা হচ্ছে মূসা আলাইহিস সালামের সাথে খিযির আলাইহিস সালামের সাক্ষাৎ। কারো কারো মতে খিযির আলাইহিস সালাম সেই সময়ের একজন নেককার বান্দা ছিলেন। আবার, কারো কারো মতে তিনি একজন সম্মানিত নবী ছিলেন। যাহোক, আলাপের ব্যাপার সেটা নয়।
একদিন, একটি সভাস্থলে যখন মূসা আলাইহিস সালামকে একজন প্রশ্ন করলো, - 'সবচেয়ে জ্ঞানী কে?'
মূসা আলাইহিস সালাম উত্তর দিলেন, 'আমি'।
মূসা আলাইহিস সালাম উত্তর দিলেন, 'আমি'।
তাঁর এই উত্তর আল্লাহ সুবনাহু ওয়া'তায়ালা পছন্দ করেননি। তিনি মূসা আলাইহিস সালামকে বললেন, 'নাহ, তুমি নও। তোমার চেয়েও জ্ঞানী বান্দা আছে আমার'।
মূসা আলাইহিস সালাম যেমন একটু রাগী ছিলেন, তেমনি ছিলেন জ্ঞান অণ্বেষণে এক উৎসুক মানুষ। তিনি তখন তাঁর চেয়েও সেই বেশি জ্ঞানী লোকটার সাক্ষাত লাভের উপায় জানতে চাইলেন। আল্লাহ সুবনাহু ওয়া'তায়ালা তাঁকে উপায় বলে দিলেন। তাদের সাক্ষাৎ হলো।
এরপর, মূসা আলাইহিস সালাম খিযির আলাইহিস সালামকে বললেন, 'আপনি যা জানেন, তা আমাকে শিখান'।
উত্তরে খিযির আলাইহিস সালাম বললেন, 'আপনি ধৈর্য ধরে রাখতে পারবেন না'।
জবাবে মূসা আলাইহিস সালাম বললেন, 'আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন, ইন শা আল্লাহ। আপনার কোন আদেশই আমি অমান্য করবো না'।
উত্তরে খিযির আলাইহিস সালাম বললেন, 'আপনি ধৈর্য ধরে রাখতে পারবেন না'।
জবাবে মূসা আলাইহিস সালাম বললেন, 'আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন, ইন শা আল্লাহ। আপনার কোন আদেশই আমি অমান্য করবো না'।
দু'জনের এই আলাপ থেকে লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, মূসা আলাইহিস সালাম কিন্তু তখনও জানেন না যে খিযির আলাইহিস সালাম একজন নবী। একজন অপরিচিত লোকের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য, জ্ঞান লাভ করার জন্য তাঁর মধ্যে যে ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা এবং আগ্রহ- তা থেকে শেখার অনেককিছুই আছে। মূসা আলাইহিস সালাম কিন্তু খিযির আলাইহিস সালামকে বলতে পারতেন, 'আপনি কি আমাকে ধৈর্য ধারণ শেখাতে চান? আপনি জানেন আমি কে? আমি আল্লাহর নবী মূসা। আমার উপর তাওরাত নাযিল হয়েছে। আপনার উপর কি নাযিল হয়েছে বলেন তো?'
নাহ। মূসা আলাইহিস সালাম সেরকম কিছুই বলেননি। বরং, অপরিচিত খিযির আলাইহিস সালামের কাছ থেকে শেখার জন্য একটুখানি গরম মেজাজের মূসা আলাইহিস সালামের কন্ঠ থেকে যেন বিনয় ঝরে ঝরে পড়ছে। তিনি বললেন,- 'আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন, ইন শা আল্লাহ। আমি আপনার আদেশ অমান্য করবো না'।
এই যে বিনয়, নম্রতা, জ্ঞান লাভের আকুতি এবং সর্বোপরি শ্রদ্ধা- এটাই কিন্তু প্রকৃত জ্ঞানীর পরিচয়।
এই যে বিনয়, নম্রতা, জ্ঞান লাভের আকুতি এবং সর্বোপরি শ্রদ্ধা- এটাই কিন্তু প্রকৃত জ্ঞানীর পরিচয়।
এরপর, তিন তিনটে ঘটনায় মূসা আলাইহিস সালাম কিন্তু ঠিক ঠিকই ধৈর্য রাখতে পারেননি। খিযির আলাইহিস সালামকে প্রশ্ন করে বসতেন। খিযির আলাইহিস সালাম বলতেন, 'আমি তো বলেছিলাম আপনি আমার সাথে ধৈর্য ধরে রাখতে পারবেন না'।
খিযির আলাইহিস সালামের এমন কথায় মূসা আলাইহিস সালাম অনুতপ্ত হলেন। বললেন, 'আমাকে মাফ করবেন। ভুল হয়ে গেছে। আর এমনটি হবেনা'।
[ বিস্তারিত সূরা কাহাফ দ্রষ্টব্য ]
চিন্তা করুন কোন লেভেলের বিনয় এটা। তাও একবার, দু'বার নয়, তিন তিনবার মূসা আলাইহিস সালাম এমন পাল্টা প্রশ্ন করে অনুতপ্ত হয়েছিলেন খিযির আলাইহিস সালামের কাছে। এই যে বিনয়, এই যে ভদ্রতা- এগুলোই জ্ঞানের বহিঃপ্রকাশ। একজন আল্লাহর নবী জ্ঞান অন্বেষণের জন্য কিরকম উদগ্রীব, কিরকম বিনয়ী, বিনয়াবনত হতে পারে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এই ঘটনা।
আপনি হয়তো অনেক জানেন, অনেক বুঝেন, অনেক পড়েন। আপনি উসুল পড়েছেন, ফিকহ পড়েছেন। আপনি দশ বছর ধরে মানুষকে শিখিয়েও যাচ্ছেন। কিন্তু ভাই, কথা বলার সময় অন্যকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য আর জ্ঞানের বড়াই করাটা কিন্তু আপনাকে 'জ্ঞানী' বানায় না মোটেও। একজন লোক- যিনি কম জানেন। হতে পারে তিনি কিছুই জানেন না। তিনি দু'চারটে ইসলামিক বই অনুবাদ করেছেন। হ্যাঁ, তাঁর হয়তোবা আপনার মতো বিশাল অ্যাকাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড নেই। উনি আপনার মতো উসুল বুঝেন না, ফিকহ বুঝেন না। তাই বলে তার সাথে কথা বলার সময় কি আপনার জ্ঞানের ঝুঝু দেখাতে হবে? বলতে হবে- 'আপনি ফিকহ বুঝেন না। উসুল বুঝেন না। তাই আপনি আমার সাথে কথা বলতে আইসেন না' (?)
উনি ফিকহ জানেন না বলে কি আপনার ওয়ালে উনার কমেন্ট করা নিষেধ? উনি উসুল বুঝেন না বলে কি সাধারণ আদবের ব্যাপারটাও আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিতে পারবেনা?
আপনি উনাকে তাচ্ছিল্যভরে বলেন, - 'দু চারটে আরবি বইয়ের ইংরেজি ট্রান্সলেশনের বাংলা অনুবাদ করে আমাকে জ্ঞান দিতে আসবেন না'।
আপনি কি জানেন আপনি যে টোনে তাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছেন, সেই টোনটা ইবলিসের? ইবলিসও এরকম জ্ঞান আর গঠনের অহমিকা করেছিলো। মাটির তৈরি আদমের কাছে আগুনের তৈরি ইবলিস মাথা নত করতে রাজি হয়নি। আপনার ওই বলার ধরণটাও ইবলিসের, আদমের মতো নয়।
দু চারটে বই অনুবাদ করা সেই লোকের যেকোন একটা খেদমত যদি আল্লাহ কবুল করে নেন, আল্লাহর কাছে বিজয়ী হবার জন্য সেটাই কি যথেষ্ট নয়? তার কি উসুল, ফিকহ আর মোটা মোটা কিতাব পড়া থাকা লাগবে?
জ্ঞানের বড়াই করতে গিয়ে ইবলিশ অভিশপ্ত হয়েছে। অনেক ঢাউস ঢাউস ইসলামিক পন্ডিতও এরকম জ্ঞানের বড়াই করতে গিয়ে বিগড়ে বসেছিলো। ইতিহাস সাক্ষী। তাই, বড়াই করবেন না। নিজেকে আয়নায় দেখুন। 'নিজে অনেক জানেন' ব্যাপারটাকে একপাশে রেখে অন্যের কাছ থেকেও শিখুন। শেখার চেষ্টা করুন। এটাই জ্ঞানীদের বৈশিষ্ট্য। যে গাছে ফল বেশি ধরে, সে গাছ নিচের দিকে নুইয়ে পড়ে, আকাশের দিকে তেড়ে উঠেনা। যে লোক সত্যিকার জ্ঞানী, সে বিনয়ী হয়। জ্ঞানের আলাপে বিনয়াবনত হয়। নিজের জ্ঞান নিয়ে অহংকার করেনা। দশ বছর শিক্ষকতা করলেই কেউ ইমাম আবু হানিফা, ইমাম আহমদ ইবন হাম্বলদের মতো ফকীহ হয়ে যায়না। শেখার বয়স নাই। শিখতে থাকুন।
'অহংকারবশঃত মানুষকে অবজ্ঞা করো না এবং পৃথিবীতে গর্বভরে পদচারণ করো না। নিশ্চয় আল্লাহ কোন দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না।' [ সূরা লুকমান: ১৮]
No comments
Note: Only a member of this blog may post a comment.