গল্পগুলো অন্যরকম-০৩’/ আরিফ আজাদ

পারস্য দেশের কথা। তখনও নব্যুয়াতের শেষ বার্তাবাহক হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর পৃথিবীতে আগমন ঘটেনি। পারস্য দেশের ইস্পাহান নগরীতে এক জমিদার বাস করতেন। ধন, সম্পদ, শৌর্য-বীর্য আর ঐশ্বর্যে তাঁর তখন জগৎজোড়া খ্যাতি। জমিদারের একমাত্র সন্তান। সন্তান তো নয় যেন একটুকরো চাঁদ।
সাত রাজার ধন বলে একটা প্রবাদ আছে। জমিদারের কাছে সেই সন্তান যেন ঠিক সাত রাজার ধনের মতো। কখনোই তিনি সন্তানকে চোখের আড়াল হতে দেন না। চোখে চোখে রাখেন। অতি যত্নে। পরম আদরে।
সন্তান বড় হলো প্রাসাদের মধ্যেই। জমিদার ছিলেন একজন অগ্নিপূজক। মাজূসি ধর্মের একজন একনিষ্ঠ সেবক। পিতা চেয়েছিলেন তারঁ সন্তান বড় হয়ে ধর্মের সেবা করুক। ধর্মকে বুঝুক, জানুক এবং পালন করুক। সন্তান হলোও তাই। পিতার মতো নিজেকে সে মাজূসি ধর্মের একজন একনিষ্ঠ খাদেম করে তোলে। তাঁর কাজ ছিলো- আগুনকে জ্বালিয়ে রাখা যাতে তা কোনভাবেই নিভে না যায়।
সন্তান তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব ঠিকঠাক মতোই পালন করে যাচ্ছে। একে তো পিতৃধর্ম। তাঁর উপর পিতার আদেশ শিরোধার্য। বলতে গেলে তাঁর কাছে এই অগ্নিপূজাই পৃথিবী। পৃথিবী মানেই অগ্নিপূজা। এর বাইরে জগত সম্পর্কে সে কোনকিছুই জানেনা। জানবে কিভাবে? সে তো বাইরের দুনিয়ার আলো-বাতাস থেকে বঞ্চিত। প্রাসাদের চার দেয়ালের মধ্যেই তাঁর বেড়ে উঠা।
জমিদার পিতা একদিন খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজে আটকা পড়লেন। তাকে যেতে হবে প্রাসাদের অন্যত্র। কিন্তু, সেই মূহুর্তে প্রাসাদেও তিনি খুব গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি কাজে ব্যস্ত। এমতাবস্থায় উনি না পারছেন বাইরে যেতে, না পারছেন প্রাসাদের ভিতরকার কাজটা বন্ধ রাখতে। এখন তাহলে কি করা যায়?
তিনি তাঁর ছেলেকে ডাকলেন। বললেন,- ‘পুত্র! প্রাসাদের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজে ব্যস্ত থাকায় আমার পক্ষে এখন অমুক জায়গায় যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু ওই জায়গায় যাওয়াটাও খুব জরুরি। এক কাজ করো, আমি প্রসাদের কাজটা দেখছি। তুমি গিয়ে অমুক জায়গার কাজটা একটু সেরে এসো। পারবে?’
ছেলে কোমল স্বরে উত্তর করলো,- ‘জ্বি, বাবা। পারবো’।
বাবা একটু স্বস্তি পেলেন। কিন্তু ছেলে তো আগে এরকম কাজ করেনি, তাই একটু উদ্বিগ্নতাও কাজ করছিলো হয়তো। বললেন,- ‘শোনো, ওখানে বেশি সময় নষ্ট করবেনা কিন্তু। তোমার ফেরার অপেক্ষায় থাকবো আমি। তোমার বিলম্ব আমাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে তুলবে। আমি কোন কাজই ঠিকমতো করতে পারবো না তোমার চিন্তায়। বুঝতে পেরেছো?’
পিতার এমন দরদমাখা কথা কে না বুঝে? ছেলেও বুঝেছে। সে বললো,- ‘জ্বি বাবা। আমি শীঘ্রই ফিরে আসবো’।
এই বলে ছেলে বেরিয়ে পড়লো বাবার দেওয়া কাজ সম্পন্ন করতে। পথ চলতে চলতে একটা জায়গায় এসে সে থামলো। একটু দূরেই একটা গীর্জা দৃষ্টিগোচর হলো তাঁর। সেখান থেকে কিছু শব্দও কানে আসতে লাগলো। সম্ভবত প্রার্থনার আওয়াজ। প্রাসাদের বাইরেও যে ধর্মচর্চা হয় ছেলেটা জানতো না। সে ভেবেছে সেখানেও বুঝি অগ্নি দেবতার পূজো করা হচ্ছে। কিন্তু হাবভাব দেখে তো ঠিক অগ্নিপূজোর মতো মনে হচ্ছেনা। ছেলেটা দাঁড়ালো। একজন পথিকের কাছে জিজ্ঞেস করলো,- ‘ভাই, ওখানে কি হচ্ছে?’
পথিক জবাব দিলো,- ‘প্রার্থনা হচ্ছে’।
- ‘এরকম প্রার্থনা করছে কেনো?’
- ‘এরা খ্রিস্টান। এরা এভাবেই প্রার্থনা করে’- পথিক উত্তর দিলো।
ছেলেটার আগ্রহ আরো বেড়ে গেলো। অগ্নিপূজো ছাড়া আর কোন প্রার্থনা আছে নাকি আবার? আর, খ্রিস্টান জিনিসটাই বা কি? কারা এরা? এরাও কী অগ্নি দেবতার পূজো আর্চনা করে?
ছেলেটার কৌতুহল আরো ঘনীভূত হলো। সে দেখার উদ্দেশ্যে গির্জার দিকে হাঁটতে থাকে। একপর্যায়ে, গির্জার ভিতরে প্রবেশ করে সে এক কোণায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের সব কীর্তি-কলাপ অবলোকন করতে লাগলো। তাদের ধর্মকর্ম, প্রার্থনার পদ্ধতি এবং অন্যান্য সবকিছু দেখে, জেনে ছেলেটার এতো ভালো লাগলো যে, তার মনে হলো, সে এতোদিন যে ধর্মের আর্চনা করে আসছে, যে জিনিসের পূজো করে আসছে, তার সবই মিথ্যা। সত্য কেবল এটাই যা সে এখন এই গির্জার মধ্যে দেখছে।
সেদিন আর ছেলেটার কাজে যাওয়া হলো না। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। ছেলের ফেরার কোন নাম নিশানাও নেই। ওইদিকে, ছেলের বাবা ছেলের চিন্তায় অস্থির। কি না কি হয়ে গেলো ছেলেটার! চতুর্দিকে লোক পাঠানো হলো। নিখোঁজ বার্তা পাঠানো হলো। জমিদারের প্রাণাধিক প্রিয় সন্তান নিখোঁজ। চারদিকে যেন শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
সন্ধ্যা নামার একটু পরে ছেলে প্রাসাদে ফিরে এলো। ছেলেকে পেয়ে বাবা তো মহা খুশি। যেন মৃত গাছে প্রাণ ফিরে এসেছে। তবুও পিতা বলে কথা। একটু শাসন তো করবেনই।
শাসনের সুরে বললেন,- ‘কোথায় ছিলে তুমি? তুমি জানো তোমার অনুপস্থিতি আমাকে কতোটা অস্থির করে রেখেছিলো? তোমাকে তো আমি একটা কাজে পাঠিয়েছিলাম। কাজ রেখে কোথায় গিয়েছিলে?’
ছেলেটা মাথা নিঁচু করে ফেললো। বাবা তাকিয়ে আছেন ছেলের মুখের দিকে। তাঁর মুখে আধো আদর, আধো শাসনের ছাপ। ছেলে মাথা তুললো। বললো,- ‘বাবা, আমাকে মাফ করবেন। আপনার দেওয়া কাজ আমি সমাপ্ত করে আসতে পারিনি’।
-‘সেটা জানি। কোথায় ছিলে এতোক্ষণ?’
ছেলেটা এই মূহুর্তে তার বাবাকে যা বলতে যাচ্ছে তা খুব ভয়ঙ্কর কথা। এই স্বীকারোক্তি তাকে সমাজচ্যুত করতে পারে। তাকে হয়তো হয়ে যেতে হবে ধর্মচ্যুতও। কিন্তু সত্য বলা থেকে নিজেকে কিভাবে সে আড়াল করবে? দূরে রাখবে? কীভাবে বাবাকে খুঁজে পাওয়া সত্যের ব্যাপারে বলবে তা ভাবতে ভাবতে সে বলেই ফেললো,- ‘বাবা, আমি আপনার দেওয়া দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যেই যাচ্ছিলাম। পথিমধ্যে, একটা প্রার্থনা গৃহ দেখতে পাই যেখান থেকে কিছু আওয়াজ আমার কানে আসতে থাকে। তাদের সেই আওয়াজ, সেই কথাগুলোর সাথে আমি পরিচিত ছিলাম না মোটেও। আমার কাছে মনে হলো তারা নতুন কিছু পাঠ করছে। এমন কিছু যা আমরা জানিনা। কখনো পাঠ করিনি। আমি আমার আগ্রহ মেটাতে তাদের প্রার্থনা ঘরে ঢুকলাম। আমি জানতে পারলাম, এরা আমাদের ধর্মের নয়। এদের বলা হয় খ্রিস্টান। প্রিয় বাবা! তাদের প্রার্থনা আমার কাছে এতোই ভালো লাগলো যে, আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাদের ধর্মকর্ম দেখতে লাগলাম। এক অদৃশ্য টানে আমি সেখান থেকে বেরুতে পারছিলাম না’।
ছেলেটার বাবা ছেলেটার কথা বুঝতে পারলেন খুব ভালো করে। ছেলের মতিভ্রম ঘটেছে। তিনি বললেন,- ‘পুত্র! কি বলছো তুমি এসব? অন্য একটা ধর্ম তোমাকে আকৃষ্ট করেছে? অথচ, তোমার ও তোমার পিতৃধর্ম তাদের ধর্মের চেয়ে উত্তম। হাজার গুনে ভালো’।
ছেলেটার কি হলো কে জানে। সে যেন তাঁর বাবার এই কথাটা মানতে পারলো না। তার ভিতরে ঝড় শুরু হলো। বাধ্য, অনুগত ছেলেটা মূহুর্তেই বিদ্রোহী হয়ে উঠলো। বললো,- ‘কক্ষনো না। শপথ স্রষ্টার! আমাদের ধর্ম কখনোই তাদের চেয়ে উত্তম নয়। আমি তাদের দেখেছি। তারা এমন এক সম্প্রদায়, যারা কেবল স্রষ্টার উপাসনা করে। আর আমরা কি করি? আগুনের পূজা করি। এই আগুন তো আমরা নিজ হাতেই জ্বালাই। আবার, আমরা যদি এই আগুনের দেখভাল না করি, এই আগুন নিজ থেকেই নিভে যায়। যে জিনিসের নিজ থেকে নিজেকে প্রজ্জ্বলিত করার, নিজেকে জ্বালিয়ে রাখার ক্ষমতা নেই, সে কীভাবে আমাদের আরাধ্য, উপাস্য হতে পারে?’
ছেলের কথা শুনে বাবা আতকে উঠলেন। হায়! তাঁর বাধ্য সন্তানের মুখে এসব কেমন কথা? সে কি পাগল হয়ে গেছে? উন্মাদের দলে নাম লিখিয়েছে? কেনো সে বিদ্রোহ করছে নিজের ধর্মের বিরুদ্ধে? নিজের পিতৃধর্মের বিরুদ্ধে হঠাৎ কেনোই বা তার এতো বিতৃষ্ণা? বাবা যেন ভেবে কূল পাচ্ছেন না...
নিজ ধর্মের প্রতি অনুগত পিতা। সবকিছু ত্যাগ করবেন, তবুও ধর্মকে ত্যাগ করতে রাজি নন। ধর্ম নাকি সন্তান- এমন দোটানার মধ্যে ধর্মই পিতার কাছে বেশি মূল্যবান।
বাবার মনে হলো, তার ছেলে বিগড়ে গেছে। কোন বাজে লোকের পাল্লায় পড়েছে হয়তোবা। তিনি আদেশ দিলেন ছেলেকে শিকল বন্দী করে কারাগারে পাঠাতে। সেখানে যদি তার শিক্ষা হয়।
ছেলেকে পায়ে শিকল পড়িয়ে কারাগারে বন্দী করে রাখা হলো।
কিছুদিন পর ছেলেটা কারারক্ষীদের একজনকে পাঠালো সেই গির্জায় যেখানে সে নতুন ধর্মের লোকদের দেখেছে। উদ্দেশ্য- নতুন ধর্মটা সম্পর্কে খবরাখবর নিয়ে আসা।
কারারক্ষী ফিরে এলো। জানালো- সেই নতুন ধর্মটার উৎপত্তি ঘটেছে শাম দেশে।
ছেলেটা আবার খবর পাঠালো শাম দেশ থেকে কেউ পারস্যে এলে যেন তাকে খবর দেওয়া হয়। এর কিছুদিন পর শাম দেশ থেকে কিছু লোক পারস্য দেশে এলো। তারা যখন পারস্য দেশ থেকে ব্যবসা করে শাম দেশে চলে যাচ্ছিলো, সেই মূহুর্তে ছেলেটাও নিজের পায়ের শিকল ছিঁড়ে কারাগার থেকে পালিয়ে শামদেশ গামী কাফেলার সাথে যোগ দিলো। কাফেলার সাথে যোগ দিয়ে ছেলেটা শাম দেশে চলে আসলো।
শাম দেশ। সবকিছুই তাঁর কাছে নতুন। এরইমধ্যে বয়সও বেড়েছে ঢের। শাম দেশে এসেই তিনি কাফেলার সাথীদের কাছে জিজ্ঞেস করলেন,- ‘আচ্ছা, এই ধর্মের সবচেয়ে সেরা ব্যক্তিটা কে?’
কাফেলার সাথীরা উত্তর দিলো,- ‘অমুক গির্জার বিশপ’।
তিনি সেই বিশপের কাছে আসলেন। বললেন,- ‘আমি আপনার কাছে থাকতে চাই। একমাত্র স্রষ্টার আরাধনা করতে চাই এবং দ্বীনের উপকারি জ্ঞান আহরণ করতে চাই। দয়া করে আমাকে সেই সুযোগ দিন’।
বিশপ উনাকে সেই সুযোগ দিলেন। এরপর তিনি সেই বিশপের কাছেই থাকতে লাগলেন। কিছুদিনের মধ্যে তিনি আবিষ্কার করলেন যে, এই বিশপ একটা দুষ্টলোক। খারাপ চরিত্রের। ধর্ম বিক্রি করে খায় সে। সে মানুষের আমানত গচ্ছিত রাখার নাম করে কব্জা করতো। কিন্তু, কিছুদিনের মধ্যেই সেই বিশপ মারা গেলো। যখন লোকজন বিশপকে দাফন করতে এলো, তিনি বললেন,- ‘আরে! তোমরা কাকে দাফন করছো? এই লোক একটা জঘন্য চরিত্রের। তিনি তোমাদের সম্পদ কব্জা করেছেন এতোদিন। আমি সাক্ষী’।
লোকজন বললো,- ‘তিনি আমাদের সম্পদ কব্জা করেছেন তার কি প্রমাণ আছে?’
- ‘হ্যাঁ, দেখাচ্ছি...’ – এই বলে তিনি সাতটি স্বর্ণ ও রৌপ্যের পাত্র বের করে দেখালেন বিশপের গোপন কক্ষ থেকে। লোকজন তাঁর কথার সত্যতা বুঝতে পারলো। তারা সিদ্ধান্ত নিলো যে এই অসৎ বিশপকে দাফন না করে বরং শূলে চড়াবে। হলোও তাই। বিশপকে দাফনের পরিবর্তে শূলে চড়ানো হলো।
বিশপের জায়গায় নতুন আরেকজনকে বসানো হলো। খাদেম হিসেবে পারস্য থেকে পালিয়ে আসা ব্যক্তি।
নতুন বিশপটা আগের বিশপের মতো নয়। তাঁর যেমন ভালো চরিত্র, তেমন তাঁর দ্বীনদ্বারিত্ব। কিন্তু কিছুদিন পরে সেও (নতুন বিশপ) মৃত্যুশয্যায় শায়িত হলেন। তখন তিনি মৃত্যুপথ যাত্রী বিশপের কাছে এলেন। বললেন,- ‘প্রিয়! আমি আপনাকে সৎ, সচ্ছরিত্র এবং তাকওয়াবান হিসেবে পেয়েছি। কিন্তু আপনি এখন মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। আপনার মৃত্যুর পরে আমি কার কাছে যাবো? কার কাছে সঠিক দ্বীন শিখবো?’
মৃত্যুর কোলে শায়িত বিশপ বললেন,- ‘বৎস! আমি কেবল একজনকেই চিনি যিনি আমার মতোই। তিনি মসূলে থাকেন। আমার মৃত্যুর পরে তুমি তাঁর কাছে চলে যেও...’
বিশপের মৃত্যুর পরে লোকটা মসূলে চলে এলেন। এসে বিশপের বলে দেওয়া লোকটাকে খুঁজে বের করলেন। বললেন,- ‘প্রিয়! আপনার কাছে আসার জন্য আমাকে অমুক ব্যক্তি বলে গিয়েছেন। তিনি আর জীবিত নেই। আমি আপনার কাছ থেকে দ্বীন শিখতে চাই...’
মসূলের সেই লোকটা বললেন,- ‘আচ্ছা, থাকো...’
মসূলের সেই লোকটাও ন্যায়পরায়ন এবং ধর্মপরায়ন ছিলেন। কিন্তু খুব অল্প সময়ের মধ্যে তিনিও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। লোকটা তাকেও জিজ্ঞেস করলেন,- ‘প্রিয়! আপনাকে আমি খুব ভালো মানুষ হিসেবে পেয়েছি। কিন্তু, আপনি তো এখন মৃত্যুশয্যায়। আপনার মৃত্যুর পরে আমি কার কাছে গিয়ে দ্বীন শিখবো বলতে পারেন?’
বিশপ বললেন,- ‘বৎস! আমার পরে আমি কেবল একজনকেই চিনি যিনি ন্যায়পরায়ন, সৎ এবং ধর্মপরায়ন। তিনি নাসীবাইণ অঞ্চলে থাকেন। আমার মৃত্যুর পরে তুমি তাঁর কাছে চলে যেও...’
লোকটা আগের বিশপের কথামতো নাসীবাইন অঞ্চলে চলে এলেন। এসে সেই ব্যক্তিকে খুঁজে বের করলেন যার কথা বিশপ বলেছেন। বললেন,- ‘প্রিয়! আপনার কথা আমাকে অমুক জানিয়েছে। তিনি আর বর্তমান নেই। আমি আপনার কাছে থেকে দ্বীন শিখতে চাই। আমাকে গ্রহণ করুন’।
লোকটা এবার নতুন বিশপের অধীনে থাকতে লাগলেন। কিন্তু কিছুদিন পর সেই বিশপও আগের বিশপদের মতো মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। লোকটা বললেন,- ‘প্রিয়! আমি তো আপনার অধীনে থেকেছি। কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি আপনার মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে। আপনার মৃত্যুর পরে আমি কোথায় যাবো আমাকে বলে দিন, দয়া করে’।
বিশপ বললেন,- ‘বৎস, আমাদের মতো আর কোন ব্যক্তি আছে কিনা আমার জানা নেই কেবল একজন ছাড়া। তিনি বাইজান্টাইন অঞ্চলের আম্মূরিয়্যা এলাকায় থাকেন। তুমি তাঁর কাছেই যেও...’
লোকটা এবার ছুটলেন বাইজান্টাইন রাজ্যের দিকে। বাইজান্টাইনের আম্মূরিয়্যাতে এসে তিনি সেই ব্যক্তিকে খুঁজে পেলেন এবং তাঁর অধীনে থাকতে লাগলেন। এরইমধ্যে তিনি কিছু অর্থ-সম্পদেরও মালিক হন। কিন্তু, ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! কিছুদিন যেতে না যেতে সেই বিশপও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। লোকটা তাঁকে বললেন,- ‘প্রিয়! অমুক লোকের কথামতো আমি আপনার কাছে এসেছি এবং দ্বীন শিখেছি। কিন্তু, আমি দেখতে পাচ্ছি আপনার মৃত্যুক্ষণ আসন্ন। আপনি আমায় বলে দিন যে আপনার মৃত্যুর পর আমি কার কাছে যাবো?’
মৃত্যুপথ যাত্রী বিশপ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। বললেন,- ‘বৎস! পৃথিবীতে আর এমন কেউ অবশিষ্ট নেই যার কাছে তুমি নিশ্চিন্তে যেতে পারো। তবে শোনো, সময় কিন্তু খুব সন্নিকটে। শীঘ্রই আল হারাম (পবিত্র এলাকা) থেকে একজন নবী প্রেরণ করা হবে। তিনি যে এলাকায় হিজরত করবেন, সেই এলাকার মাটি কিছুটা লবণাক্ত, এবং অই অঞ্চলটা হবে খেঁজুর গাছবহুল। তাঁর দুই কাঁধের মধ্যে থাকবে নব্যুয়াতের সীলমোহর। তিনি উপহার গ্রহণ করবেন কিন্তু সাদাকাহ (যাকাত) গ্রহণ করবেন না। তোমার যদি সেই অঞ্চলে যাওয়ার সামর্থ্য থাকে, তাহলে চলে যাও। কেননা, তার আগমনের সময় অতি সন্নিকটে...’
বিশপ মারা গেলেন। তাকে দাফন করে লোকটা অপেক্ষা করতে লাগলেন সেই পবিত্র ভূমিতে কখন, কীভাবে যেতে পারবেন যেখানে শেষ নবি আসবেন হিজরত করে।
একদিন, কালব গোত্রের একটি কাফেলা যাচ্ছিলো তাঁর পাশ দিয়ে। তিনি তাদের অনুরোধ করলেন তাকেও তাদের সাথে নিয়ে নিতে যেন তিনি আরব দেশে পৌঁছাতে পারেন। বিনিময়ে তিনি তাদের তাঁর কাছে থাকা ভেড়া এবং গাভীর পাল দিয়ে দিতে রাজি। কালব গোত্রের সেই কাফেলা রাজি হলো। তাকে সাথে নিয়ে নিলো। কিন্তু মাঝপথে এসে তারা বেঈমানি করে বসলো। তারা এক ইহুদির কাছে তাঁকে দাস হিসেবে বিক্রি করে বসে। যে ইহুদির কাছে তারা তাঁকে বিক্রি করে, সে ইহুদি তাঁকে নিয়ে একটি অঞ্চলে আসে। সেই অঞ্চলে খেঁজুর গাছ দেখে তাঁর ভিতরটা প্রফুল্লতায় ভরে উঠে। এই বুঝি সেই অঞ্চল যার কথা শেষ বিশপ জানিয়েছিলো? যেখানে শেষ নবি হিজরত করে আসবেন?
কিছুদিন পর, আক কুরা উপত্যকায় বসবাসরত একদল ইহুদি, যারা বনু কোরাইযা গোত্রের ছিলো, তাদের একজন এসে আগের ইহুদির কাছ থেকে লোকটাকে পুনঃরায় ক্রয় করে নিলো। এরপর, সেই ইহুদির সাথে লোকটা মদীনায় চলে এলো। এই শহরটাকে দেখা মাত্রই তিনি চিনতে পারলেন। বললেন,- ‘আরে! আরে! এই তো সেই দেশ!’
মক্কায় তখন রাসূল (সাঃ) এর আবির্ভাব ঘটে গেছে। সে খবর পৌঁছ গেছে প্রান্তর থেকে প্রান্তরে। দেশ-বিদেশে। কিন্তু দাস হিসেবে নিযুক্ত থাকায় শেষ নবি আগমনের কোন খবর পারস্য দেশের সেই সত্য সন্ধানী লোকটার কান অবধি তখনও পৌঁছায়নি।
এরইমধ্যে, রাসূল (সাঃ) হিজরত করে মদীনায় আসলেন। তখন মদীনার যারা যারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে, তারা রাসূল (সাঃ) এর চারপাশে জটলা বেঁধে বসতো। দ্বীন সম্পর্কে জানতো, শিখতো।
একদিন লোকটা মনিবের খেঁজুর গাছে কাজ করছিলেন। এমতাবস্থায়, মনিবের এক চাচাতো ভাই চেঁচাতে চেঁচাতে এসে বলতে লাগলেন,- ‘বনু কাইলা গোষ্ঠীর জন্য অভিসম্পাত! মক্কা থেকে কোন এক লোক এসেছে আর তারা দলবেঁধে তার চারপাশ ঘিরে আছে। তাদের ধারণা ওই লোক নাকি নবি’।
বলা বাহুল্য, বনু কাইলা গোষ্ঠীর যারা যারা তখন ইসলাম গ্রহণ করেছে, তাদের সকলে তখন রাসূল (সাঃ) কে ঘিরে বসে থাকতো। এই দৃশ্য দেখেই ওয়ি ওই ইহুদির চাচাতো ভাই রাগে গিজগিজ করতে করতে তাদের অভিশাপ দিচ্ছিলো।
খেঁজুর গাছে থাকাবস্থায় এই কথা শুনে লোকটার গায়ে কাঁপুনি শুরু হলো। তার মানে শেষ নবির এই অঞ্চলে আগমন হয়েছে? লোকটার মনের মধ্যে অস্থিরতা শুরু হলো। অবস্থা এমন, গাছ থেকে উনি মনিবের গায়ে পড়বেন। উনি কোনরকমে গাছ থেকে নেমে এলেন। বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন,- ‘কী সংবাদ? কী সংবাদ? কে উনি? তুমি কার কথা বলছো?’
লোকটার এরকম কান্ড দেখে মনিব কাছে এসে তাঁকে দিলো এক থাপ্পড়। থাপ্পড় দিয়ে বললো,- ‘কে এসেছে সেই সংবাদ দিয়ে তোমার কাজ কী? যাও, কাজে যাও...’।
লোকটার কাছে কিছু খেঁজুর ছিলো খাবার মতো। কাজ শেষ করে সন্ধ্যেবেলা তিনি তিনি খেঁজুরগুলো নিয়ে রাসূল (সাঃ) এর মজলিসে হাজির হলেন। এসে রাসূল (সাঃ) এর দিকে খেঁজুরগুলো বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,- ‘শুনলাম, আপনি এখানে নতুন। আপনার সাথে আপনার কিছু সাথীও আছে নাকি। আমার কাছে কিছু সাদাকা’র (যাকাতের) খেঁজুর আছে। এগুলো আমি আপনাকে দিতে চাই। দয়া করে আমার সাদাকাহ গ্রহণ করুন’।
রাসূল (সাঃ) তার সাদাকাহ নিলেন না। সাহাবীদের উদ্দেশ্য করে বললেন,- ‘তোমরা এই খেঁজুরগুলো খাও...’
সাদাকাহ গ্রহণ না করায় লোকটার চোখমুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। একটা চিহ্ন পাওয়া গেছে। বিশপ বলেছিলেন- সেই প্রেরিত নবি কখনোই সাদাকাহ গ্রহণ করবেন না’।
লোকটা ফিরে গেলো। এরপর, কিছু খাবার সংগ্রহ করে আবার ফিরে এলো। ফিরে এসে রাসূল (সাঃ) এর দিকে খাবারগুলো বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,- ‘একটু আগে খেয়াল করলাম আপনি সাদাকা’র জিনিস নেন না। এই নিন, এগুলো সাদাকাহ নয়, উপহার’।
এবার রাসূল (সাঃ) খাবারগুলো হাত বাড়িয়ে নিলেন এবং সাহাবীদের নিয়ে ভাগ করে খেলেন। এই দৃশ্য দেখে লোকটার চোখে পানি চলে এলো। দ্বিতীয় চিহ্ন পাওয়া গেলো। বিশপ বলেছিলেন তিনি উপহারের বস্তু গ্রহণ করবেন’।
এরপর, লোকটা সারাক্ষণ রাসূল (সাঃ) কে অনুসরণ করতে লাগলো। একদিন রাসূল (সাঃ) একটি লাশের পেছন পেছন যাচ্ছিলেন। চারপাশে সাহাবাগন। লোকটা রাসূল (সাঃ) এর চারপাশে চক্কর দিতে লাগলেন যাতে উনার কাঁধে নব্যুয়াতের কোন সিলমোহরের দেখা পান কিনা যেটার কথা বিশপ বলেছিলেন। লোকটাকে এভাবে কয়েকবার খেয়াল করে রাসূল (সাঃ) আসল কাহিনী বুঝতে পারলেন। তিনি থামলেন। এরপর গা থেকে চাদর নামিয়ে রাখলেন। চাদর নামাতেই রাসূল (সাঃ) এর কাঁধের সেই সিলমোহর দৃষ্টিগোচর হলো। এটা দেখে লোকটা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। কান্নায় ভেঙে পড়লো। দৌঁড়ে এসে রাসূল (সাঃ) কে জড়িয়ে ধরে সেই সিলমোহরাঙ্কিত অংশে চুমু খেতে লাগলেন।
তিনি সত্যের দেখা পেয়ে গেছেন। দীর্ঘ ত্যাগ, তিতিক্ষা আর সাধনার পর আল্লাহ সুবাহান ওয়া’তালা তাঁকে ঈমান আনার তাওফিক্ব দান করলেন এবং তিনি সাথে সাথেই ইসলাম গ্রহণ করলেন।
জানেন সেই লোকের নাম কি? তাঁর নাম হলো সালমান ফারসি (রাঃ)। রাসূল (সাঃ) এর একজন অন্যতম সম্মানিত সাহাবি। সেই সালমান ফারসির পরামর্শ এবং বুদ্ধিতেই কিন্তু খন্দক যুদ্ধে পরিখা খননের মাধ্যমে মুসলিমরা শত্রুপক্ষকে পরাজিত করে। কতোই না দীর্ঘ সংগ্রামের পর তিনি ঈমানের স্বাদ পেয়েছেন, আহা!
তথ্যসূত্রঃ
১। আল-মুসনাদ, পঞ্চম খন্ড, হাদীস ৪৪১-৪৪৪
২। ইবনে হিশাম, ১ম খন্ড, ২২৮-২৩৫ পৃষ্টা।
‘গল্পগুলো অন্যরকম-০৩’/ আরিফ আজাদ
(নতুন বইয়ের জন্য লেখা হচ্ছে। ইনশাআল্লাহ, খুব শীঘ্রই শেষ করতে পারবো বলে আশা করছি)

No comments

Note: Only a member of this blog may post a comment.

Powered by Blogger.