'পানি রহস্য-০১'/ আরিফ আজাদ

আপনাকে যদি প্রশ্ন করি,- 'পৃথিবীর সবচেয়ে বিশুদ্ধ পানির উৎস কী?'
আপনি কয়েক সেকেন্ড ভাববেন। একটু মাথা চুলকাবেন। এরপর হয়তো অনেকটা আত্মবিশ্বাসের সাথেই বলবেন,- 'বৃষ্টির পানি...'
আপনার উত্তর যদি 'বৃষ্টির পানি' হয়, তাহলে আপনার উত্তরটা একেবারেই সঠিক...
আসলেই, পৃথিবীর সবচেয়ে বিশুদ্ধ পানির উৎসই হলো বৃষ্টির পানি।পানি নিয়ে গবেষণা করে এরকম একটি বিখ্যাত জার্নালে (IWA- The International Water Association) সেদিন বৃষ্টির পানি নিয়ে একটি আর্টিকেল পড়ছিলাম। একটা জায়গায় তারা লিখলো- 'The bottled water that we consider to be the purest form of water actually comes from rainwater'....
নদী-সমুদ্রের পানিকে বৃষ্টির পানি হিসেবে পেতে যে প্রসেসগুলো অতিক্রম করতে হয়, তা অত্যন্ত বিস্ময়কর! সূর্যের তাপে নদী এবং সমুদ্রের পানি জলীয় বাষ্প আকারে উপরে উঠে গিয়ে মেঘমালা আকারে জমা হয়। এরপর যখন ঘনত্ব একসময় বেড়ে যায়, আকাশ থেকে সেই মেঘমালা বৃষ্টি আকারে আবার পৃথিবীতে ফেরত আসে।
এই পানিতে নানান রকম উপাদান থাকে যা মানুষের জন্য অত্যন্ত উপকারী। শুধু উপকারীই না, জীবন রক্ষার সহায়ক। এজন্যই পানির অপর নাম জীবন....
এই পানিতে থাকে আয়রন, কপার, অ্যালুমিনিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম। থাকে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস এবং সল্ট।
কিন্তু, বৃষ্টি আকারে আকাশ থেকে নিচে পতিত হবার সময় তাতে সবরকম উপাদান মিশ্রিত থাকে না। বৃষ্টির পানি যখন নিচে পতিত হয়ে বিভিন্নভাবে নদী, মাটির অভ্যন্তরে পৌঁছায়, তখন তার সাথে বিভিন্ন উপাদান (আয়রন, কপার, সোডিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ইত্যাদি) মিশে যায়। সেই পানিকে তখন বলা হয় 'মিনারেল ওয়াটার'...
বলা বাহুল্য, বৃষ্টির পানি সবথেকে শুদ্ধতম পানি হলেও, তা অনেকটাই বিস্বাদ। অর্থাৎ, স্বাদহীন।
বৃষ্টির পানির সাথে পরে অন্যান্য উপাদান যোগ হবার পরে তা স্বাদযুক্ত পানিতে পরিণত হয়ে আমাদের জন্য পানযোগ্য হয়.....
এখান থেকে আমরা পানির দুটি ভিন্ন ভিন্ন অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারি।
১/ বৃষ্টির পানি হলো বিশুদ্ধ পানি কিন্তু তা স্বাদহীন (Tasteless)।
২/ বৃষ্টির পানি যখন পতিত হয়ে নদী, মাটির অভ্যন্তরে ইত্যাদিতে পৌঁছায়, তখন তার সাথে বিভিন্ন উপাদান মিশ্রণের ফলে তা হয়ে উঠে স্বাদযুক্ত পানি, যাকে আমরা মিনারেল ওয়াটার বলি এক কথায়........
এই দুই প্রকার পানির বাইরে আরো এক প্রকার পানি আছে, তা হলো- সাগরের লবণাক্ত পানি...
এটাকে তিন নাম্বার ক্যাটাগরিতে রাখলে যা দাঁড়ায়-
৩/ সাগরের পানি হলো এমন পানি- যা লবণাক্ত, বিস্বাদ, পানের অযোগ্য....
এই হলো মোটামুটি ৩ রকমের পানির অবস্থা। একটি বিশুদ্ধ, অথচ স্বাদহীন। একটি পুরোপুরিভাবে বিশুদ্ধ না হলেও (যেহেতু বিভিন্ন প্রসেসিংয়ের মাধ্যমে এই পানি আসে) স্বাদযুক্ত এবং পানযোগ্য, অন্যটি খুব বেশিই লবণাক্ত, পানের অযোগ্য.....
এবার আসুন। আল কোরআনের সূরা ফুরকানের ৪৮ নাম্বার আয়াতে বলা হচ্ছে-
'And We send down pure water from the sky'
[ 'এবং, আমি আকাশ থেকে বর্ষণ করি বিশুদ্ধ পানি']
শব্দচয়ন খেয়াল করে দেখুন, আল্লাহ সুবাহান ওয়া'তালা এই আয়াতে বৃষ্টির পানি বর্ষণের ব্যাপারে বলছেন। এবং, বৃষ্টির পানির গুণ বা মান বর্ণনার জন্য তিনি যে শব্দটা ব্যবহার করেছেন সেটা হলো- 'Tahura'। আরবি 'তাহির' শব্দ থেকেই থেকে 'তাহুরা' এসেছে। তাহুরা অর্থ বিশুদ্ধ, Pure.....
বৃষ্টির পানিকে আল্লাহ সুবাহান ওয়া'তালা বর্ণনা করেছেন- বিশুদ্ধ পানি হিসেবে যা এখন সাইন্টিফিকেলি প্রমাণিত।
বলতে পারেন, এর মধ্যে এমন কী আর জারিজুরি?
অপেক্ষা করুন। একটু আগেই বলেছি, এই বৃষ্টির পানি যখন পতিত হয়, তখন বিভিন্ন খনিজ উপাদান তার সাথে মিশ্রিত হয়। ফলে, তাকে বলা হয় মিনারেল ওয়াটার, যা খাবার যোগ্য...
এই মিনারেল ওয়াটার সবসময় বিশুদ্ধ না। কারণ, প্রকৃতির মধ্যে বিভিন্ন উপায়ে পরিশোষিত হয়ে যাওয়ার ফলে তার সাথে যেমন দরকারি অনেক খনিজ মিশে, ঠিক তেমনি অদরকারি অনেক পদার্থও মিশে যায়। যেমন- Dust...
আয়রন, সালফার, সল্ট ইত্যাদি মিশে যাওয়ার ফলে এই পানি যখন সুস্বাদু হয়, তখনি আমরা সেটাকে পানযোগ্য পানি বলি। এই পানি গভীর নলকূপ দিয়ে মাটির অভ্যন্তর থেকে উঠানো যায়, এবং নদীতেও পাওয়া যায়। নদীর পানিও মিষ্টি....
তবে, বৃষ্টির পানি একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়ার ফলে তার 'Purity' ফর্মটা হারায়, কারণ, কিছু অদরকারি পদার্থ মিশে যাওয়ার ফলে তাকে আর 'Purest' বিশেষণে ফেলা যায় না। কিন্তু এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যাওয়ার ফলেই তা পানযোগ্য হয়, সুস্বাদু হয়।
এবার দেখুন, আল্লাহ তা'লা সূরা আল মুরসালা'তের ২৭ নাম্বার আয়াতে বলছেন-
'And (we) have given you to drink sweet water'
['এবং, পান করার জন্য আমি তোমাদের দিয়েছি সুমিষ্ট পানি']
খেয়াল করলে দেখবেন, পানির কথা বলতে গিয়ে আগের আয়াতে আল্লাহ তা'লা যে বিশেষণ ব্যবহার করেছিলেন, তা ছিলো- Tahura (Pure)
কিন্তু, এবারও আরেকটি জায়গায় পানির বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি কিন্তু আর আগের বিশেষণটি ব্যবহার করেন নি।
এবার তিনি ব্যবহার করেছেন- Fura't শব্দ, যার অর্থ- Sweet, সুস্বাদু। অর্থাৎ- পানযোগ্য।
বৃষ্টির পানিতে বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন উপাদান মিশে তা আমাদের জন্য পানযোগ্য হয়। এই কথা উল্লেখ করতে গিয়ে আল্লাহ সুবাহান ওয়া'তালা ঠিকঠাক বিশেষণটাই ব্যবহার করেছেন। পানযোগ্য পানির জন্য তিনি Tahura (Pure) শব্দ ব্যবহার না করে Fura't (Sweet) শব্দ ব্যবহার করেছেন।
এবার, সূরা আল-ফাতিরের ১২ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ বলছেন-
' And not alike are the two bodies of water. One is fresh and sweet, palatable for drinking, and one is salty and bitter'
['(পাশাপাশি) পানির দুটো অংশও এক রকম নয়। একটি (অংশ) সুমিষ্ট, সুস্বাদু, সুপেয়, অন্যটি লবণাক্ত, বিস্বাদ']
এখানে শেষের দিকে যে পানির কথা বলা হচ্ছে, তা হলো সমুদ্রের পানি। সমুদ্রের পানিতে লবণের ঘনত্ব এতোই বেশি যে, সেই পানি মুখেও নেওয়া যায় না সাধারণত।
সমুদ্রের পানির লবণাক্ততা বুঝাতে আয়াতটিতে দুটি বিশেষণ আছে। একটি হলো 'মিলহুন' (লোণা) অন্যটি হলো 'উজ্বাজ'....
সাধারণত, কোনকিছুর তীব্রতা বোঝাতে এই উজ্বাজ শব্দটা ব্যবহার করা হয়। এর আগের শব্দ, 'মিলহুন- লোণা' শব্দের পরে, লবণের পরিমাণের দিকে নির্দেশ করে আল্লাহ তা'লা এই শব্দ ব্যবহার করেছেন। কোনকিছুর অতিরিক্ততা বুঝাতেই এটি ব্যবহার করা হয়।
তাহলে, প্রশ্ন আসে, সমুদ্রের পানিকে 'মিলহুন' (লোণা) শব্দ দিয়ে বিশেষায়িত করার পরে 'উজ্বাজ' শব্দ দিয়ে জোর দেওয়ার কী কারণ?
কারণ হচ্ছে, নদীতে, বা মিনারেল ওয়াটার হিসেবে আমরা যে পানি পান করি, কম হলেও তাতে কিন্তু লবণ (সল্ট) থাকে। নাহলে, সেটা বিস্বাদ লাগতো। লিঙ্গুইস্টিক দিক থেকে, আমরা যে পানি পান করি, তাতেও যেহেতু লবণ থাকে, তাই সেই লবণের পরিমাণ থেকে সমুদ্রের পানির লবণের পরিমাণকে আলাদা করতেই আল্লাহ তা'লা একটি বাড়তি বিশেষণ লাগিয়ে জিনিসটাকে আরো সুন্দর,সুস্পষ্ট করেছেন, আলহামদুলিল্লাহ্‌।
এই কোরআনের প্রত্যেকটা শব্দ, প্রত্যেকটা অক্ষর চিন্তার দাবি রাখে।
This is a miracle. The miracle from our Lord.....
'পানি রহস্য-০১'/ আরিফ আজাদ

No comments

Note: Only a member of this blog may post a comment.

Powered by Blogger.