'কোরআন থেকে নেওয়া-০২' / আরিফ আজাদ

প্রান্তিক শ্রেণীর মানুষগুলোর সাথে আমরা খুব একটা ভালো আচরণ করতে পারিনা। যেমন ধরুন একজন রিক্সাওয়ালা। একজন রিক্সাওয়ালার সাথে আমরা কয়জন ভালো আচরণ করি?
বাবার বয়সী একজন রিক্সাওয়ালাকে যখন ডাক দিই তখন খুবই তাচ্ছিল্যের সাথে বলি,- 'এই খালি যাবা?'
পঞ্চাশোর্ধ্ব একজন বৃদ্ধকে খুব সহজেই 'তুমি' করে বলে ফেলি। কারণ উনি একজন রিক্সাওয়ালা। উনি কায়িক শ্রম দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। কারণ উনি প্যাডেল ঘুরিয়ে টাকা রোজগার করেন। আমি সহজেই উনাকে 'তুই' বা 'তুমি' সম্বোধন করে ফেলি কারণ- উনার সারা মাসের ইনকাম আমার তিন দিনের নাস্তার বিলের সমান। উনি আমার চোখে ছোট, কারণ- উনি কলেজের প্রফেসর নন। উনার পাঁচ-দশটা ডিগ্রী নেই। উনি কর্পোরেট দুনিয়ায় এসির নিচে বসে অফিস করেন না।
আমি চাইলেই উনার গায়ে হাত তুলতে পারি। সামান্য ভুলেই ধমকাতে পারি।
এরকম প্রান্তিক শ্রেণীর মানুষের সাথে আমরা কতোটা মিসবিহেইভ করি। অথচ, সূরা আবাসা পাঠ করতে গিয়ে আমি অনুধাবন করলাম যে, প্রান্তিক শ্রেণীর মানুষগুলো সম্পর্কে ইসলাম কতোটা দায়িত্বশীল।
সূরা আবাসা এমন একটি সূরা, যেটি বিখ্যাত সাহাবা ইবনে মাকতূম (রাঃ) এর একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে নাযিল হয়।
কোন কোন বর্ণনামতে, এই সূরা ইবনে মাকতূম (রাঃ) এর ইসলাম গ্রহণের পরে নাযিল হয়, আবার কিছু কছু বর্ণনামতে, ইবনে মাকতূম (রাঃ) এর ইসলাম গ্রহণের ঠিক পূর্বেই এই সূরা নাযিল হয়।
সে যাইহোক, এই সূরার শানে নুযূল এরকম-
রাসূল (সাঃ) তখন সবেমাত্র নব্যুয়াতের দাওয়াত প্রচার শুরু করেছেন। মক্কার মুশরিক দলপতিরা তখনও তার প্রতি অতোটা বিরূপ অবস্থানে চলে যায় নি। একদিন, রাসূল (সাঃ) মক্কার কুরাইশ দলপতিদের নিয়ে একটি মজলিশে তাওহীদের দাওয়াত দিচ্ছিলেন। এমতাবস্থায়, রাসূল (সাঃ) এর কাছে ইবনে মাকতূম (রাঃ) এলেন। তিনি ছিলেন অন্ধ। রাসূল (সাঃ) যখন মক্কার কুরাইশদের কাছে বক্তব্য পেশ করছিলেন, তখন ইবনে মাকতূম (রাঃ) এসেই রাসূল (সাঃ) এর বক্তৃতার মাঝখানে উনাকে প্রশ্ন করে বসলেন।
বক্তব্যের মাঝে এরকম প্রশ্ন করায় বক্তব্যে ব্যাঘাত ঘটে। রাসূল (সাঃ) তখন ইবনে মাকতূম (রাঃ) এর উপরে কিছুটা বিরক্ত হলেন। বিরক্তি থেকে উনি হালকা কপাল কুঁচকালেন। এরপর তিনি ইবনে মাকতূম (রাঃ) এর দিকে দৃষ্টি না দিয়ে আবার কুরাইশ দলপতিদের দিকে মনোযোগ দিলেন।
ইবনে মাকতূম (রাঃ) অন্ধ বলেই যে রাসূল (সাঃ) তাকে পাত্তা দেন নি, তা কিন্তু নয়। যেহেতু নব্যুয়াত লাভের প্রথম দিককার ঘটনা এবং তখন কেবলমাত্র ইসলামের সূচনাকাল, রাসূল (সাঃ) হয়তো ভাবলেন,- 'ইবনে মাকতূমকে আমি একটু পরে বুঝালেও সে হয়তো বুঝবে। কিন্তু এই মূহুর্তে আমি কুরাইশ দলপতিদের সামনে দাওয়াত দিচ্ছি। এরা এখন আমার কথা শুনছে। অন্য সময় হয়তো নাও শুনতে পারে। তাই এই সুযোগ মিস করা যাবে না। এদের একজনও যদি দাওয়াত কবুল করে তাহলে ইসলামের প্রসারে তা বিশাল ভূমিকা রাখবে।'
এমন চিন্তা থেকেই হয়তোবা রাসূল (সাঃ) সেদিন মজলিশে ইবনে মাকতূম (রাঃ) এর দিকে তখন দৃষ্টি দেন নি।
আপাতঃদৃষ্টিতে সামান্য এই ঘটনার উপরেই নাযিল হয় এই সূরা।
একজন অন্ধ লোক। এসেই রাসূল (সাঃ) কে বক্তব্যের মাঝখানে থামিয়ে প্রশ্ন করে বসলো। রাসূল (সঃ) হয়তো ভাবলেন,- 'প্রশ্নটা একটু পরে করলেও তো হতো.....'
এই বোধ থেকে তিনি কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করে কপাল কুঁচকালেন। সাথে সাথেই আল্লাহ সুবাহান ওয়া'তালা সূরা আবাসা নাযিলের মাধ্যমে উনাকে সতর্ক করে দিলেন।
সূরা আবাসা-
(০১-১১)
(০১) 'তিনি ভ্রূকুঞ্চিত করলেন এবং মুখ ফিরিয়ে নিলেন।'
(০২) 'কারণ, তাঁর কাছে এক অন্ধ আগমন করেছিলো।'
(০৩) 'আপনি কি জানেন, সে হয়তো পরিশুদ্ধ হত।'
(০৪) 'অথবা উপদেশ গ্রহণ করতো এবং উপদেশ তার উপকার হত।'
(০৫) 'পরন্তু যে বেপরোয়া।'
(০৬) 'আপনি তার চিন্তায় মশগুল।'
(০৭) 'সে শুদ্ধ না হলে আপনার কোন দোষ নেই।'
(০৮) 'যে আপনার কাছে দৌড়ে আসলো।'
(০৯) 'এমতাবস্থায় যে, সে ভয় করে।'
(১০) 'আপনি তাকে অবজ্ঞা করলেন।'
(১১) 'কখনও এরূপ করবেন না, এটা উপদেশবানী।'
ইবনে মাকতূম (রাঃ) রাসূল (সাঃ) এর কাছে এলেন। কিছু জানতে চাইলেন। রাসূল (সাঃ) ভ্রু কুঁচকালেন। কিছুটা বিরক্ত হলেন। তাঁর দিকে মনোযোগ দিলেন না - সকল ঘটনা জানিয়ে দিয়ে আয়াত নাযিল হয়ে গেলো।
এখান থেকে দুটি ব্যাপার শেখার আছে।
প্রথমতঃ
প্রান্তিক শ্রেণীর মানুষের সাথে আপনি রূঢ় আচরণ করতে পারেন না। একজন অন্ধের সাথে সামান্য বিরক্তি এবং ভ্রু কুঁচকানোর জন্যও আল্লাহ তা'লা রাসূল (সাঃ) কে সতর্ক করে দিয়ে বললেন,- 'আর কখনোই এরূপ করবেন না'।
সুতরাং, আমরা যারা প্রান্তিক লেভেলের মানুষের সাথে মিসবিহেইভ করি, ধমকাই, চড় দিই, বড় গলায় কথা বলি, তাদের জন্য এখানে বিরাট শিক্ষা রয়েছে।
দ্বিতীয়তঃ
সমাজের একশ্রেণীর লোক দাবি করে, কোরআন কোন ঐশ্বরিক গ্রন্থ নয়। এটি মুহাম্মদ (সাঃ) নিজে লিখে ঐশ্বরিক বলে চালিয়ে দিয়েছে।
এটা যদি মুহাম্মদ (সাঃ) নিজেই লিখতেন, তাহলে কী দরকার ছিলো এতো সিলি একটা ঘটনাকে এতো ঘটা করে প্রচার করার? কী দরকার ছিলো নিজেই নিজেকে ভৎসর্ণা দেওয়ার? কালের পরিক্রমায় এই ঘটনা তো বিলীন হয়ে যেতো। কে মনে রাখতো এই ছোট্ট ঘটনা? কেউই না।
তবুও যুগ যুগ ধরে এই ঘটনা তিনি কেনো জিইয়ে রাখবেন যেখানে তাকে শুধরে দেওয়া হচ্ছে?
এই ঘটনার বদলে তিনি তো মহৎ কোন গল্প ফাঁদতে পারতেন। সেটা তো তাকে আরো মহৎ, মহান করে তুলতো। নিজের লেখা কিতাবকে স্রষ্টার কিতাব বলে যে চালিয়ে দিতে পারে, তার জন্য এরকম মহৎ সাজার গল্প তৈরি করাই তো স্বাভাবিক ছিলো। কিন্তু তিনি তা করলেন না কেনো? কেনো এই সাময়িক ক্ষুদ্র ত্রুটির কথা জিইয়ে রাখলেন যুগের পর যুগ?
তিনি যদি নকল নবী হতেন, পয়গম্বর না হতেন, তাহলে তিনি এই ঘটনা অবশ্যই উল্লেখ করতেন না।
কিন্তু এই কিতাব আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা। তাই তাতে এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ঘটনাও ঠাঁই পেয়েছে।
যারা কোরআনকে মুহাম্মদ (সাঃ) এর রচনা মনে করে, তাদের জন্যও এখানে একটা শিক্ষা রয়েছে।
'কোরআন থেকে নেওয়া-০২' / আরিফ আজাদ

No comments

Note: Only a member of this blog may post a comment.

Powered by Blogger.