‘কোষের জগতে একদিন’/ আরিফ আজাদ

পাঠক, চলুন আমরা ভিন্ন একটা জগত থেকে ঘুরে আসি। উহু, এটা আমাদের নিত্যদিনকার আলোচ্য ইহলৌকিক বা পারলৌকিক জগত নয়। এই জগতের নাম কোষের জগত...
বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনা করে বা বিজ্ঞান সম্বন্ধে খোঁজখবর রাখে এমন ব্যক্তিমাত্রই ‘কোষ’ শব্দটার সাথে পরিচিত। তবে, যারা একদমই জানেন না কোষ কি, তাদের জন্য বলি- কোষ হচ্ছে জীবনের একেবারে গাঠনিক উপাদান। অর্থাৎ, যা না হলে একদম চলেই না। ইংরেজি ‘Cell’ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হলো কোষ। ‘Cell’ শব্দটা এসেছে লাতিন শব্দ ‘Cellula’ থেকে যার অর্থ ‘কক্ষ’। কোষের আবিষ্কারক বিজ্ঞানী রবার্ট হুক সর্বপ্রথম এই শব্দটা ব্যবহার করেছিলেন। তিনি ‘কোষ’ কে মূলত সাধু-সন্নাসীদের ‘ঘর’ বা কক্ষের সাথে তুলনা করে দেখিয়েছিলেন।
‘কক্ষ’ শব্দ থেকেই যখন ‘কোষ’ শব্দের নামকরণ, তখন নিশ্চয়ই এর কাজ সম্পর্কেও একটু ধারণা পাচ্ছেন, তাইনা? জ্বী। কোষ আসলেই একটা কক্ষ। জীবের জীবন পরিচালনার সমস্ত কাজ, সমস্ত প্রক্রিয়া সেই কক্ষ তথা কোষের মধ্যে সংঘটিত হয়।
কারো কারো মনে হয়তো এতোক্ষণে প্রশ্ন জেগে বসেছে,- ‘তা নাহয় বুঝলাম বাপু। কিন্তু কোষের আবার জগত কি?’
আসলেই তো। ইহজগত, পরজগত, মহাকাশজগতের মতো কতো জগতের নামই তো শুনেছি। কিন্তু কোষের জগত বলে তো কিছু শুনিনি। এটা আবার কি জিনিস?
ঠিক আছে। এবার তাহলে মূল আলোচনায় যাওয়া যাক। আমরা সরাসরি ঘুরে আসবো কোষের জগত থেকে। জেনে আসবো কোষের জগতের এমন কিছু রহস্য, যা আমাদের ভাবনার জগতে নতুন মাত্রা দিবে। খুলে দিবে জ্ঞানের নতুন দুয়ার...
প্রথমত, আপনাকে দিয়ে কল্পনা করুন। আপনার এই যে আস্ত শরীর, এটা কিভাবে এলো জানেন? আপনার শরীরের সূচনা হয়েছে মায়ের ডিম্বানু থেকে। ডিম্বানু কিন্তু একাই আপনার আস্ত শরীরের জন্য যথেষ্ট নয়। ডিম্বানু কোষ হিসেবে অপরিপূর্ণ। একটা পূর্ণাঙ্গ কোষে ঠিক যতোটা ক্রোমোজম থাকা চাই, ডিম্বানুতে থাকে তার অর্ধেক। তাহলে বাকি অর্ধেক কোত্থেকে? ডিম্বানুতে বাকি অর্ধেক ক্রোমোজমের যোগান দেয় শুক্রাণু। ডিম্বানু আর শুক্রাণু মিলে যখন একটি পূর্ণাঙ্গ কোষ গঠিত হয়, ঠিক তখনই শুরু হয় আপনার সূচনা পর্ব।
আস্তে, আপনি এখনো একটা কোষ মাত্র। ঘটনার অনেক কিছুই এখনো বাকি। একটি পূর্ণাঙ্গ মানব শরীরে একশো ট্রিলিয়নেরও বেশি কোষ থাকে। আপনার দৃশ্যমান মহাবিশ্বে যতোটা গ্রহ-নক্ষত্রের উপস্থিতি, ঠিক সেই পরিমাণ কোষ রয়েছে আপনার শরীরে। এই যে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন কোষ, এগুলো কোথা থেকে এসেছে জানেন? ওই যে, ডিম্বানু আর শুক্রাণু মিলে প্রথম যে কোষটা তৈরি হয়েছিলো, সেই একটা মাত্র কোষ থেকেই এত্তোগুলো কোষের জন্ম। অবাক লাগছে, তাইনা? একটি মাত্র কোষ থেকে এত্তোগুলো কোষ কিভাবে আসলো? জ্বী, সেই আদি কোষটা বিভাজন হতে হতে এত্তোগুলো কোষের জন্ম হয়েছে।
আমরা আবার সেই আদি কোষে ফিরে যাই। প্রথম কোষ। সেই কোষে যে ডিএনএ ছিলো, তাতে কি পরিমাণ তথ্য ছিলো জানেন? তিন বিলিয়ন লেটার (বর্ণমালা) সম্বলিত তথ্য যা একহাজার ভলিউমের এনসাইক্লোপিডিয়ার সমান। সেই তথ্য যদি খাতায় লেখা হয়, তাহলে এক মিলিয়ন পরিমাণ কাগজের দরকার পড়বে। এখন, সেই আদি কোষ যখন বিভাজিত হয়ে নতুন আরেকটি কোষের জন্ম দিবে, সেই নতুন কোষে যে ডিএনএ থাকবে, তাতেও তো এই তথ্যগুলো সরবরাহ করা চাই, তাইনা? এই যে এতো বিশাল পরিমাণ তথ্য, তা হুবহু, একদম নির্ভুলভাবে নতুন কোষে সরবরাহ করতে প্রথম কোষটা কতো সময় নেয়, জানেন? বিশ মিনিট থেকে সর্বোচ্চ আধ ঘণ্টা। আশ্চর্য না? একহাজার ভলিউম এনসাইক্লোপিডিয়ার সমান তথ্য একটা কোষ থেকে অন্য একটা কোষে সরবরাহ হতে সময় নেয় মাত্র বিশ মিনিট। তাও একেবারে হুবহু, নির্ভুলভাবে। তবে, বাই চান্স, রেপ্লিকেশানে যদি কোন ভুল হয়, তাহলে সেটা সংশোধনের জন্যও রয়েছে আলাদা প্রক্রিয়া। ভাবতে পারেন কি এক আধুনিক প্রযুক্তি সেট করা আছে আপনার শরীরের অভ্যন্তরে? এই কাজ যে একবারই হয় তা নয়। প্রতি মিনিটে আপনার শরীরে তৈরি হয় লক্ষ লক্ষ কোষ। আর প্রতি মিনিটে লক্ষ লক্ষ বার ঠিক একই কাজ পুনঃ পুনঃ ঘটছে। এই কোষগুলোকে খালি চোখে দেখাও যায়না। অথচ, কতো সুনিপুনভাবেই না এরা কাজ সম্পাদন করে। এই যে কোষগুলো, এদের না ব্রেইন আছে, না আছে চোখ, কান, মুখ। তাহলে নতুন কোষে যে তথ্য সরবরাহ করতে হবে, এই জ্ঞান তাকে ঠিক কে দেয়? নিজেকে প্রশ্ন করুন।
এবার, মাতৃগর্ভে যখন টিস্যু তৈরি হয়ে যায়, তখন বিভিন্ন কোষ দ্বারা শরীরের বিভিন্ন অংশের গঠন তৈরি হতে থাকে। একটিমাত্র কোষ থেকে কোটি কোটি কোষ তৈরি হয়। কিন্তু, সব কোষ কিন্তু একই কাজ করেনা। কিছু কিছু কোষের কাজ চোখের গঠন তৈরি করা, কিছু কিছু কোষ মাথার গঠন তৈরির কাজ করে ইত্যাদি। কিন্তু, এতো কোটি কোটি কোষের মধ্যে, যারা চোখের কাজ করবে, তারা একসাথে একদিকে আলাদা হয়ে যায়। যারা করোটির কাজ করবে, তারা একদিকে আলাদা হয়ে যায়। যারা মুখমন্ডল গঠনের কাজ করবে, তারা একদিকে আলাদা হয়ে যায়। এই কাজটাও হয় খুব দ্রুত। কয়েক মিলি সেকেন্ডের মধ্যে। আচ্ছা, এই যে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন কোষ, এদের মধ্যে যারা চোখের কাজ করবে, তারা একে-অন্যকে এতো অল্প সময়ে সনাক্ত করে কিভাবে? যারা করোটির কাজ করবে, তারা কিভাবে স্বগোত্রীয়দের সনাক্ত করে? যারা মুখমন্ডলের কাজ করবে, তারা কিভাবে তার সহযোগীদের এতো দ্রুত খুঁজে পায়? কোষের তো চোখ নেই, ব্রেইন নেই, কথা বলা বা ডাকার ক্ষমতা নেই। তারা কিভাবে একত্রিত হয়? কে তাদের একত্রিত করায়? ভেবেছেন?
আপনার যকৃত তথা লিভারের কথাই ধরুন। আমরা যে খাবার খাই, সেই খাবারগুলোকে শক্তিতে রূপান্তর করে শরীরের প্রয়োজন অনুযায়ী সাপ্লাই দেওয়াই যকৃতে থাকা কোষগুলোর কাজ। খাবার থেকে শক্তি সঞ্চয় করার জন্য যকৃতের প্রতিটি কোষে এক মিলি সেকেন্ডের মধ্যে পাঁচশো রকমের কাজ সম্পন্ন হয়। আমরা প্রতিদিন যে খাবার খাই, সেই খাবার থেকে আমাদের শরীরের জন্য যে পরিমাণ শক্তি দরকার, ঠিক সেই পরিমাণ শক্তিই এই কোষগুলো সঞ্চয় করে নেয়। যকৃতে থাকা কোটি কোটি কোষ প্রতিনিয়ত এই কাজগুলো করে যাচ্ছে বিরতিহীন।
কিছু কিছু কোষ আছে যারা একটা সময়ে এসে আত্মহত্যা করে বসে। খুব বিদঘুটে শোনাচ্ছে, তাইনা? কিন্তু সত্য এটাই যে, যখন শরীরের কিছু কোষের প্রোডাক্টিভ পাওয়ার ধ্বংস হয়ে যায় এবং তারা অকেজো হয়ে পড়ে, তখন তারা নিজেদের জায়গায় নতুন প্রোডাক্টিভ কোষগুলোকে জায়গা করে দিতে নিজেরাই নিজেদের মেরে ফেলে। খুব মজার একটা প্রক্রিয়া এটা। যখন কোন কোষ নিজের প্রোডাক্টিভিটি হারিয়ে ফেলে, তখন সেই কোষ নিজের ভিতরে থাকা একধরণের ‘কিলার প্রোটিন’ কে এক্টিভ করে দেয়। কিলার প্রোটিন এক্টিভ করার পর পাশে থাকা অন্য প্রোডাক্টিভ কোষের যাতে কোন ক্ষতি নাহয়, সেদিকেও থাকে এদের সজাগ দৃষ্টি। আত্মহত্যা করার আগে এরা দলছুট হয়ে পড়ে। এরপর নিজের ভিতরের কিলার প্রোটিন এক্টিভ করে দেয় যা তাদের মৃত্যু ঘটায়। যে কোষগুলো আত্মহত্যা করে, সেগুলোকে অন্য জীবিত কোষেরা সরিয়ে ফেলে। তবে, সব মৃত কোষকে যে সরিয়ে ফেলা হয়, তাও নয়। কিছু কিছু মৃত কোষকে সরানো হয়না। কারণ, মৃত্যুর পরও এদের কাজে লাগে। যেমন চামড়ার উপরিভাগ এবং নখ এরকম মৃত কোষ দ্বারা গঠিত। মজার ব্যাপার হচ্ছে, মৃত কোষগুলোকে যখন অন্য কোষগুলো সরিয়ে ফেলে, তখন জীবিত কোষগুলো ঠিক কিভাবে বুঝে যে কোন মৃত কোষগুলোকে রাখতে হবে আর কোন কোষগুলোকে সরাতে হবে? আশ্চর্যজনক না ব্যাপারটা?
চিন্তা করুন, আপনার শরীরের অভ্যন্তরে স্বাভাবিক কর্ম পরিচালনা সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য কিছু কোষ নিজেকে আপনা থেকেই মেরে ফেলছে। কে তাদেরকে এই জ্ঞান প্রদান করে যে তারা নিজেরা নিজেদের আত্মহুতি দেয়? আর অন্য কোষগুলোই বা কিভাবে সনাক্ত করে যে কোন কোষগুলোকে রাখতে হবে আর কোন কোষগুলোকে সরিয়ে ফেলতে হবে? তাদের না চোখ আছে, না ব্রেইন আছে, না আছে নাক, মুখ বা সেন্স। ঠিক কিভাবে তারা এই কাজগুলো করে? কার নির্দেশে?
আমাদের নিত্যদিনকার কাজের মাধ্যমে আমাদের শরীরে বিভিন্ন ধরণের ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করে। এরমধ্যে কিছু ব্যাকটেরিয়া আছে আমাদের শরীরের জন্য উপকারি, কিছু আছে আমাদের শরীরের জন্য ক্ষতিকর। আমাদের শরীরের ভিতরে (বিশেষ করে যকৃতে) একধরণের কোষ আছে। এদেরকে বলা হয় ‘রক্ষী কোষ’। এই কোষগুলোর কাজই হলো শরীরে প্রবেশ করা ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াকে সাথে সাথে সনাক্ত করা এবং মেরে ফেলা। চিন্তা করুন, আপনার নিশ্বাঃসের সাথে, খাবারের সাথে সাথে কতো কোটি কোটি ব্যাকটেরিয়া রোজ আপনার শরীরে ঢুকছে। এই এতো এতো ব্যাকটেরিয়ার মধ্য থেকে ঠিক ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াটিকেই কিন্তু আপনার শরীরে থাকা ‘রক্ষী কোষ’ খুঁজে বের করে ফেলে এবং আপনার সুরক্ষার তাগিদে সেটাকে মেরে ফেলে। চিন্তা করতে পারেন আপনাকে প্রহরা দেওয়ার জন্য কতো সুনিপুণ সিস্টেম আপনার মধ্যে দেওয়া হয়েছে? যে কোষগুলোর চোখ নেই, কান নেই, সেন্স নেই, সেই কোষগুলো ঠিক কিভাবে চিনে কোন ব্যাকটেরিয়াটা উপকারি আর কোনটা ক্ষতিকর? কে তাদের এই জ্ঞান দান করেছে?
কোষের দুনিয়ায় রয়েছে এরকম আশ্চর্যরকম সব কাজকারবার, যা লিখতে গেলে পৃষ্টার পর পৃষ্টা লেখা যাবে। মানব শরীরের অভ্যন্তরে থাকা একটি ছোট্ট কোষ একটি মহাবিশ্বের সমান রহস্য ধারণ করে। আমাদের শরীরের এই যে সুনিপুণ গঠন, তার ভিতরে এতো কারুকার্যময়, এতো অত্যাধুনিক সব সিস্টেম- এসব কি প্রমাণ করেনা যে এর পেছনে একজন ডিজাইনার, একজন বুদ্ধিমান সত্ত্বার হাত রয়েছে? যারা নিজেদেরকে নফসের ধোঁকায় রেখেছে, তারা এর মাঝে কোন নির্দশন খুঁজে পাবেনা। কিন্তু যারা নফসকে নয়, আরশে সমাসীন প্রভুর দাসত্ব করে, তারা ঠিকই জানে- এর পেছনে একজনেরই ইশারা আছে। তিনি আমাদের মহান রব, রাব্বুল আলা’মীন।
“মানুষ, কিসে তোমাকে তোমার র’বের ব্যাপারে ধোঁকায় ফেলে দিয়েছে? তিনিই তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। তোমাকে (সুন্দর আকৃতিতে) সুঠাম করেছেন এবং তোমাকে করেছেন ভারসাম্যপূর্ণ’ [ আল ইনফিতার, ৭-৮]
‘কোষের জগতে একদিন’/ আরিফ আজাদ

No comments

Note: Only a member of this blog may post a comment.

Powered by Blogger.