হিমাদ্রী মুখোপাধ্যায়ের......আরিফ আজাদ

আরিফ আজাদঃ 
[ হিমাদ্রী মুখোপাধ্যায়ের এই লেখাটা আমার অল-টাইম ফেভারিট। গত বছরের ন্যায় তাই আবারও শেয়ার দিলাম।]
- 'ঈশ্বর নাই।'
- 'কী করিয়া এই গূঢ়তত্ত্ব অবগত হইলে বাবা?'
- 'জীবনে বহুবিধ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছি। কোথাও ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয় নাই।সুতরাং সিদ্ধান্ত করিয়াছি, ঈশ্বর নাই।'
- 'ভালো করিয়াছো বাবা। আমিও জীবনে বহুবার ধুনি জ্বালিয়া তাহার সম্মুখে পদ্মাসনে বসিয়া,নিরন্তর নাম জপ করিয়া,তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রটি প্রমাণ করিবার চেষ্টা করিয়াছি। পারি নাই। তদবধি সিদ্ধান্ত করিয়াছি- এনট্রোপি বলিয়া কিছু থাকা আদৌ সম্ভবপর নহে।'
- 'ধুনি জ্বালিয়া তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র প্রমাণ করা যায় ইহা আপনাকে কে বলিয়াছেন?'
- 'ল্যাবরোটারিতে বুনসেন বার্নারের উপরে ঈশ্বর আসিয়া লেজ নাড়িতে থাকিবেন, এবং অ্যামমিটারে তাহার হাঁচি ধরা পড়িবে,এ-কথা তোমাকে যিনি বলিয়াছেন বাবা,সম্ভবত তিনি-ই বলিয়াছেন।'
- 'ঈশ্বর কি অদ্যাবধি কেহ দেখিয়াছেন?'
- 'উহা সম্ভবত বিগ বেন কিংবা স্ট্যাচু অব্ লিবার্টির মতো দ্রষ্টব্য বস্তু নহে। শুনিয়াছি চৈতন্যগভীরে তাঁহার অবর্ণনীয় সত্তার উপলব্ধি হইয়া থাকে। আচ্ছা বাবা,তুমি পরমাণু দেখিয়াছো?'
- 'আমি দেখি নাই তবে যাঁহারা প্লাটিনামের পরমাণু দেখিয়াছেন,তাঁহারা বলিয়াছেন, পরমাণু খালি চোখে দর্শন করা সম্ভব নহে। উহা দর্শন করিতে হইলে STEHM নামক মহার্ঘ মাইক্রোস্কোপ প্রয়োজন। উপযুক্ত পরিমাণ বিজ্ঞান-যোগ্যতা অর্জন করিলে আমার পক্ষেও তাহা দর্শন করা অসম্ভব নহে।'
- 'বুঝিয়াছি। যাঁহারা ঈশ্বর দেখিয়াছেন অথবা জানিয়াছেন, তাঁহারও বলিয়া থাকেন,ঈশ্বরও সাধারণ ৬/৬ দৃষ্টিশক্তির অধিগম্য নহে। তাঁহাকেও দর্শন করিতে হইলে প্রজ্ঞাদৃষ্টির প্রয়োজন। STEHM হাতে পাইতে হইলে, যেমন তোমার ভাষায় কিছু " বিজ্ঞান-যোগ্যতার" প্রয়োজন হয়, তেমনি ঈশ্বর পাইতে হইলেও কিঞ্চিৎ সাধন-যোগ্যতার আবশ্যক ঘটিয়া থাকে। দেশপ্রিয় পার্কে বসিয়া বাদাম চিবাইতে চিবাইতে তাঁহার দেখা নাও মিলিতে পারে। অধ্যাত্ম-জগতেও অধিকারী ভেদ বলিয়া একটি বস্তু আছে। ক্লাস ওয়ানের ছাত্র স্পেশাল থিওরি অব্ রিলেটিভিটি বুঝিতে চাহিলে বিড়ম্বনা ঘটাই সম্ভব।'
- 'ঈশ্বর একটি ঘোর অবৈজ্ঞানিক বিষয়, ইহা কি আপনি অস্বীকার করিতে পারেন?'
- 'অস্বীকার করিবো কেন? ঈশ্বর বিজ্ঞানশাস্ত্রের বিষয় নহে, এ-কথা দশ সহস্রবার বিশ্বাস করি। কিন্তু, অবৈজ্ঞানিক বিষয় অর্থেই যে তাহা অস্তিত্বহীন, এই কথা বিশ্বাস করি না।'
- 'বুঝাইয়া বলুন।'
- 'মনে করো- কবিতা। ইহা কীভাবে লিখিত হয় বিজ্ঞানে তাহার কোনো উত্তর নাই। ভ্যান গগ আঁকিলে স্টারি নাইট হইয়া থাকে, আর আমি আঁকিলে কেন তাহা টিউব লাইট হইয়া যায়, তাহারও কোনো ব্যাখ্যা কোনোরূপ বিজ্ঞান-তত্ত্বেই নাই। থাকিবার কোনো প্রয়োজনও নাই কেননা ইহা শিল্প-তত্ত্বের বিষয়। কিন্তু বৈজ্ঞানিক বিষয় নয় বলিয়াই শেক্সপীয়রের সনেট হইতে বতিচেল্লির ভেনাস-কোনোটারই পশ্চাতে প্রতিভা নামক একটি অনির্ণেয় রহস্য নাই, এইরূপ বলা কি ঘোরতর অবৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত হইবে না?'
- 'কিন্তু এমন বহু ব্যক্তিকে আমি জানি,যাঁহারা অনেকদিন সাধন-ভজন করিয়াও ঈশ্বর পান নাই।'
- 'আমি আরো বহুতর ব্যক্তিকে জানি বাবা, যাঁহারা আরো অনেকদিন চেষ্টা করিয়াও আই আইটি এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাশ করিতে পারেন নাই।'
- 'তাহার দ্বারা কী প্রমাণিত হয়?'
- 'এইটুকুই প্রমাণিত হয় যে, মালা জপিলেই ঈশ্বর মিলিবে এবং পাথফাইন্ডারে পড়িলেই আই আইটি পাইবে, এইরূপ কোনো চুক্তি ঈশ্বর এবং আই আইটি কর্তৃপক্ষ কাহারো সহিত অন্তত এখনো পর্যন্ত করেন নাই।'
- 'যোগ্য কোনো শিক্ষক, যিনি নিজে আই আইটি পাইয়াছেন, তাঁহার তত্ত্বাবধানে কোনো বুদ্ধিমান ছাত্র নিরন্তর পড়াশুনো করিলে আই আাইটি প্রাপ্তি অসম্ভব নহে।'
- 'যোগ্যতর কোনো শিক্ষক,যাঁহার ঈশ্বরোপলব্ধি ঘটিয়াছে,তাঁহার নির্দেশিত পথে ,কোনো নিষ্ঠাবান ভক্ত যদি নিরন্তর সাধনা করিয়া চলে,তাঁহারও ঈশ্বরোপলব্ধি না-ঘটিবার কোনো কারণ আছে বলিয়া আমি বিশ্বাস করি না।'
- 'কিন্তু এই উপলব্ধি যে তাঁহার সত্যই ঘটিলো, তাহা কি বৈজ্ঞানিক উপায়ে প্রমাণ করা সম্ভব?'
- 'না বাবা,উপলব্ধি বিষয়টি ভাবজগতে অবস্থিত,বস্তুজগতে নহে। সুতরাং,কোনো পরীক্ষাগারেই ইহার কোনোরূপ প্রমাণ মিলিবে না।'
- 'এইরূপ উদ্ভট আধ্যাত্মিকজগৎ লইয়া বিজ্ঞানীকূল তাহা হইলে কী করিবেন?'
- 'কিছুই করিবেন না।অনধিকারচর্চা করিয়া তাঁহার লাভই বা কী? তাঁহার করিবার এবং ভাবিবার মতো বিষয় জগৎ-সংসারে অনেক আছে। ঈশ্বর তাঁহার সাবজেক্ট নহে।'
- 'অনধিকারচর্চা?'
-- 'অবশ্যই।বিজ্ঞানী ল্যাপলাসকে
একবার সম্রাট নেপোলিয়ান প্রশ্ন করিয়াছিলেন যে- এত পৃষ্ঠার বই যে তিনি লিখিলেন 'সেলেসটাল মেকানিকস্' লইয়া ,তাহাতে একবারও ঈশ্বরের কথা উচ্চারিত হয় নাই কেন? ল্যাপলাস উত্তর দিয়াছিলেন যে তাঁহার প্রতিপাদ্য বিষয়টির জন্য ঈশ্বরের কোনো প্রয়োজন হয় নাই। আমিও তাহাই বলিতেছি বাবা। ঈশ্বর নামক অবস্তুটি লইয়া কাজকর্ম করিবার জন্য জগতে শাস্ত্র ও দর্শনগ্রন্থের কোনো অভাব নাই। বিজ্ঞানের এই বিষয়টি লইয়া মাথা না ঘামাইলেও চলিবে।'

No comments

Note: Only a member of this blog may post a comment.

Powered by Blogger.