একটি বাস্তব ঘটনা/ আরিফ আজাদ


আমার স্ত্রী যখন আমাদের প্রথম সন্তানের জন্ম দেয়, আমার বয়স তখন ত্রিশ এর কাছাকাছি। সেই রাতটির কথা আজো আমার মনে আছে।
প্রতিদিনের মতো ওই রাতটিও আমি বাইরে কাটিয়েছি আমার বন্ধুদের সাথে। আমার সময়গুলো কাটে গল্পে,আড্ডায় এবং লোকজনকে উপহাস করে। মানুষকে হাসাতে পারার এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিলো আমার। অন্যদের নিয়ে আমি উপহাস করতাম,ঠাট্টা-মশকারি করতাম। আমার বন্ধুরা এসব দেখে শুধুই হাসতো।

মানুষকে নকল করার এক অসাধারন ক্ষমতা ছিলো আমার। যেকারো স্বর নকল করে তাকে উত্যক্ত করতে পারতাম আমি। আমার এই ঠাট্টা - মশকারি থেকে আশপাশের কেউই যেন রেহাই পাচ্ছিলোনা। এমনকি আমার বন্ধুরাও না।
আমার ঠাট্টা থেকে বাঁচার জন্য তাদের কেউ কেউ তখন আমাকে এড়িয়ে চলা শুরু করে।
আমি এখনও মনে করতে পারি সেই বিভীষিকাময় রাতটির কথা। মার্কেটের রাস্তার পাশে বসে ভিক্ষা করতে থাকা এক বৃদ্ধের সাথে করা সেই ঠাট্টার কথা আমার আজও মনে পড়ে। সেটা ছিল খুব শোচনীয় রকমের বাড়াবাড়ি! অন্ধ ভিক্ষুকটা যখন অন্ধকার রাস্তা ধরে আসছিলো, আমি তখন মজা করে তার সামনে আমার পা বসিয়ে দিয়েছিলাম। আমার পায়ের সাথে লেগে ভিক্ষুকটি ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেলো এবং চারদিকে মাথা ঘুরিয়ে দেখছিলো কে তাকে ল্যাঙ মেরে মাটিতে ফেলে দিয়েছে। কিন্তু সে কিছুই বুঝতে পারলোনা।

আমি বাড়িতে ফিরলাম। সচরাচর যেরকম দেরি করে ফিরি। দেখলাম, আমার স্ত্রী আমার জন্য তখনও অপেক্ষা করছিলো। তার অবস্থা ছিলো ভয়াবহ রকম খারাপ।সে কাঁপা কাঁপা গলায় জানতে চাইলো,- 'রাশেদ, তুমি এতোক্ষন কোথায় ছিলে?'
- 'কোথায় আর থাকবো? মঙ্গলগ্রহে তো আর ছিলাম না। বন্ধুদের সাথেই ছিলাম'- আমি ব্যাঙ্গাত্বকভাবে উত্তর দিলাম।
তাকে খুব বিমর্ষ লাগছিলো।চেহারা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে যেন। সে কান্নাজড়িত গলায় বললো,- 'রাশেদ, আমি খুবই ক্লান্ত। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমার মনে হয় একটু পরেই আমাদের সন্তান পৃথিবীতে আসতে যাচ্ছে'।
কথাগুলো বলতেই এক ফোঁটা অশ্রু তার চোখ বেয়ে বুকে গড়িয়ে পড়ল।

তার এরকম খারাপ অবস্থা দেখে আমারও মনটা খারাপ হয়ে গেলো। আমি বুঝতে পারলাম, আমি তাকে অবহেলা করছি।আমার উচিত ছিল তার যত্ন নেওয়া। অন্তত সে যতোদিন এই কঠিন মুহুর্তের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, ততোদিন তার প্রতি যত্নশীল হওয়াটা আমার উচিত ছিলো। এই দিনগুলো বাইরে নষ্ট করা আমার একদম ঠিক হয়নি।
তাকে আমি দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে এলাম। নিয়ে আসার সাথে সাথে কর্মরত কিছু নার্স এসে তাকে ডেলিভারি কক্ষে নিয়ে গেলো। যাওয়ার সময় আমি তার প্রচন্ডরকম চিৎকার শুনতে পেলাম। এরকম অবস্থায় তাকে কখনোই আমি দেখিনি। আমি বুঝতে পারছি তার খুব কষ্ট হচ্ছে।

আজকে আমাদের প্রথম সন্তান পৃথিবীর আলো দেখবে। আমি ভীষণ উদ্বিগ্নতা নিয়ে আমাদের অনাগত সন্তানের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিন্তু, আমার স্ত্রীর ডেলিভারি কেইসটা খুব সহজ ছিলোনা। অপেক্ষা করতে করতে একটা সময় আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ি। আমার শরীর যেন ভেঙে আসে। হাসপাতালের বারান্দায় অপেক্ষার প্রহর গুনা আমার পক্ষে আর কোনোভাবেই সম্ভব ছিলোনা। যেসব নার্স আমার স্ত্রীর সেবায় নিয়োজিত, তাদের একজনকে আমার ফোন নাম্বার দিয়ে আমি বাসায় চলে এলাম। বলে আসলাম আমার সন্তানের সুসংবাদ যেন আমাকে ফোনে জানিয়ে দেওয়া হয়।

এক ঘণ্টার মধ্যে আমি আমার সন্তান সালেমের জন্মের সুসংবাদ পাই। তারা ফোন দিয়ে আমাকে আমার পুত্র সন্তানের জন্য অভিবাদন জানালো। আমি তাড়াতাড়ি করে হাসপাতালে চলে এলাম। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাকে দেখামাত্র বললো, - 'আপনার স্ত্রীর ডেলিভারি কেইসে যিনি দায়িত্বরত ছিলেন, আগে তার সাথে দেখা করে আসুন'।
ডাক্তারের এমন গোয়ার্তুমি দেখে যেন আমার মাথায় রক্ত চড়ে বসলো। আরে বাবা, কই আমাকে আমার সন্তানকে দেখার সুযোগ দিবে, তা না। উল্টো বলছে আগে যেন ডাক্তারের পারমিশান নিয়ে আসি। হোয়্যাট দ্য নুইসেন্স!
ডাক্তারের কথাকে একরকম অবজ্ঞা করেই বললাম,- ' হোয়্যাট দ্য হেল ই্যজ দ্যাট? আমি এক্ষুনি আমার ছেলেকে দেখতে চাই।'

তারা শান্ত গলায় আবার বললো,- 'দেখুন, অধৈর্য হবেন না। আপনি অবশ্যই আপনার সন্তানকে দেখতে পাবেন। তবে তার আগে ডাক্তারের সাথে একটু কথা বলুন'।
লোকগুলোকে আরো কিছু অশ্রাব্য কথা শুনাতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু কি মনে করে যেন সবকিছুকে ভিতরে চাপা দিয়ে ডাক্তারের চেম্বারের উদ্দেশ্যের হাঁটা ধরলাম।

ডাক্তারের চেম্বারে এসে বসতেই উনি আমাকে বললেন, - 'আপনার স্ত্রীর ডেলিভারি কেইসটা ছিলো অত্যন্ত জটিল। এরকম কেইস আমরা আমাদের মেডিকেল ক্যারিয়ারে খুব কম দেখেছি। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া করুন এজন্যই যে, উনি সবকিছু ভালোভাবে শেষ করিয়েছেন। কিন্তু, একটা সমস্যা হয়েছে....'
হঠাৎ আমার বুকের ভেতরটা 'ধপ' করে উঠলো। মনে হলো কেউ যেন ভিতর থেকে জোরে ধাক্কা দিয়েছে। আমি জানতে চাইলাম, - 'কি সমস্যা?'

তিনি বললেন,- 'আপনার সন্তানের চোখে সমস্যা আছে।সম্ভবত সে কখনোই চোখে দেখবেনা।'
আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। আমি একজন অন্ধ সন্তানের বাবা এটা যেন কোনোভাবেই আমি মেনে নিতে পারছিলাম না। কোনোরকম কান্না চেপে ধরে মাথা নিচু করে ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসলাম। হঠাৎ আমার গতরাতের সেই অন্ধ ভিক্ষুকটার কথা মনে পড়লো যাকে আমি রাস্তায় ল্যাং মেরে ফেলে দিয়েছিলাম মজা করার জন্য। সুবাহান-আল্লাহ! আপনি সত্যি তাই ফেরত পাবেন,যা আপনি অন্যদের সাথে করবেন।

অন্ধ সন্তানের বাবা আমি? আমার প্রথম সন্তানটাই অন্ধ হয়ে জন্মালো? হায়!!
হঠাৎ আমার স্ত্রী আর সদ্যজাত অন্ধ সন্তানটির কথা মনে পড়ল। ডাক্তারকে তার দয়ার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে আমি আমার স্ত্রী আর সন্তানকে দেখার জন্য তাদের বেডে আসলাম।

আমার স্ত্রীকে দেখে মোটেই বিষণ্ণ মনে হলোনা। সে যেন সবকিছুকে খুব সহজভাবে নিয়েছে। আল্লাহর উপর তার অগাধ বিশ্বাস ছিলো। সে কতোবারই না আমাকে বলতো,- 'মানুষকে নিয়ে ঠাট্টা-মশকারি করোনা।'
সে আমাকে বারবার এই কথা স্মরণ করিয়ে দিতো। বলতো, 'মানুষকে নিয়ে ঠাট্টা মশকরা করো না রাশেদ। আল্লাহ অসন্তুষ্ট হবেন। কিন্তু, কে শোনে কার কথা? তার কথায় আমি কোনোদিন কর্ণপাত করিনি। আমি সমানতালে মানুষকে নিয়ে হাসি-তামাশা, ঠাট্টা-মশকারি করেই যেতাম!
পুত্র সালেম সহ আমরা হাসপাতাল থেকে বাসায় চলে এলাম। বাস্তবে, আমি সালেমের প্রতি খুব উদাসীন ছিলাম। অন্ধ হয়ে জন্মানোতে মন থেকে আমি তাকে আমার ছেলে হিসেবেই মেনে নিতে পারিনি। মনে করতাম, সালেম আমাদের পরিবারেই থাকেনা। সে আমাদের কেউ হয়-ই না।

সালেম যখন জোরে জোরে কান্না করতো, তখন আমি ঘুমানোর জন্য অন্য রুমে চলে যেতাম। তার প্রতি আমার অনীহা ছিলো প্রচন্ডরকম। তাকে আদর করা, ভালোবাসার কথা কখনো আমার মনেই আসতো না। কিন্তু আমার স্ত্রী ছিলো ব্যতিক্রম। মায়েরা সম্ভবত অন্য ধাতুতে গড়া। সন্তান যেমনই হোক, তার জন্য তাদের হৃদয়ে যেন এক অসীম ভালোবাসার খনি মজুদ থাকে। সালেমকে আমার স্ত্রী খুব ভালোবাসতো। তার যত্ন করতো। আমার যে ভালোবাসা থেকে সালেম বঞ্চিত ছিলো, আমার স্ত্রী সেটা পুষিয়ে দেওয়ার যেন আপ্রাণ চেষ্টায় লিপ্ত।
সত্য বলতে, আমি সালেমকে ঘৃণা করতাম না। আবার, কেনো যেনো তাকে আমি ভালোও বাসতে পারতাম না। কি এক অস্পষ্ট দেয়াল যেন ছিলো তার আর আমার মধ্যে আমি জানিনা।

সালেম আস্তে আস্তে বড় হতে লাগলো। সে হামাগুড়ি দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো। যখন তার বয়স এক বছর, তখন আমরা বুঝতে পারলাম যে সালেম আসলে প্রতিবন্ধী। এটা জানার পরে আমি দ্বিতীয়বারের মতো শকড হলাম। খোদা! আমার কপালটাই না কি মন্দ! সালেমকে এমনিতেই আমি ভালোবাসতাম না। যখন জানলাম যে প্রতিবন্ধী, তখন থেকেই তাকে আমি বোঝা মনে করতে লাগলাম। একটা উঠকো ঝামেলার মতো।
সালেমের পর আমাদের কোলজুড়ে আরো দু'টো সন্তান আসে। উমার এবং খালেদ।
দিনগুলো এভাবেই পার হচ্ছিলো। সালেম বড় হচ্ছে। সাথে উমার এবং খালেদও। বাসায় থাকতে আমার একদম ভালো লাগতোনা। আমি আগের মতোই বেশিরভাগ সময় বন্ধুদের সাথে বাইরে বাইরে কাটাতাম।
আমার এরকম আচরন সত্ত্বেও আমার স্ত্রী কখনোই আমার উপর থেকে আশা ছেড়ে দেয়নি।

সে সবসময় আমার হিদায়াতের জন্য দো'য়া করতো। আমার এহেন আচরনে সে কখনোই রাগ করতোনা।কিন্তু সে মনে মনে খুব কষ্ট পেতো, যখন সে দেখতো আমি পুত্র সালেমকে অবহেলা করে অন্য দু'জনকে আদর করছি।
সালেম বড় হচ্ছিলো আর সাথে বাড়ছিলো আমার দুশ্চিন্তাও। এই প্রতিবন্ধীটাকে নিয়ে আমি কি করবো? আমার স্ত্রী যখন তাকে একটি ভাল প্রতিবন্ধী স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিতে বললো, আমি আপত্তি জানাইনি। যাক, অন্তত বোঝাটা অন্যের ঘাড়ে সওয়ার হোক।
এভাবে কতগুলো বছর যে চলে গেলো আমি বুঝতেই পারলাম না। আমার দিনগুলো ছিল আগের মতই।খাওয়া-কাজ-আড্ডা-ঘুম।এভাবেই।

এক শুক্রবার। আমি বেলা এগারোটায় ঘুম থেকে উঠলাম।বলা চলে,প্রতিদিনের তুলনায় সেদিন আমি অনেক ভোরেই জেগেছি।কারণ, আমার এক জায়গায় দাওয়াত ছিলো।আমি কাপড় পরে,গায়ে পারফিউম মেখে বের হতে যাচ্ছিলাম।
যখনই আমি আমাদের বেডরুম অতিক্রম করছিলাম, আমি দেখলাম, সালেম হুইল চেয়ারে বসে একা একা কাঁদছে।
তার জন্মের পর এই প্রথমবার নিজ চোখে তাকে আমি কাঁদতে দেখছি।দশ বছর কেটে গেলো, কিন্তু এই দশ বছরে একটিবারের জন্যও আমি তার প্রতি নজর দিইনি। একটু ভালোবাসার চোখে তাকাইনি। একটু ভরসার স্পর্শে তার হাত ধরিনি। আজকেও তাকে আমি এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু কেন যেন পারলাম না। আমি শুনলাম, সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছে আর তার মা'কে ডাকছে।

আমি এই প্রথমবারের মতো তার কাছে গেলাম এবং জিজ্ঞেস করলাম,- 'সালেম, তুমি কাঁদছো কেনো?'
আমার কন্ঠ শোনামাত্র সে কান্না থামিয়ে দিলো। আমাকে তার এতো আছে পেয়ে সে তার ছোট ছোট হাত দুটি হাতড়িয়ে আমাকে অনুভব করার চেষ্টা করতে লাগলো।সে তখনও বুঝতে পারছেনা তার সাথে কি হচ্ছে।
আমি খেয়াল করলাম, সে আমার থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। যেন সে ঘৃণাভরে আমাকে বলতে চাচ্ছে,- 'এতোদিনে আমাকে তোমার মনে পড়লো? এই দশ বছর কোথায় ছিলে তুমি?'

আমি তাকে অনুসরন করলাম।দেখলাম, সে হুইল চেয়ারে ভর করে সাবধানে তার রুমের দিকে চলে গেলো। আবার জানতে চাইলাম কেনো সে কাঁদছে। প্রথমে সে তার কান্নার কারন আমাকে বলতে চায়নি। আমি তার সাথে শান্তভাবে কথা বলতে লাগলাম।এরপর সে আমাকে তার কান্নার কারণ বললো। সে যখন আমাকে তার কান্নার কারণ বলছিলো, আমি তা মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম আর কাঁপছিলাম।
বলতে পারেন কি ছিলো সেই কারণ?
তার ছোট ভাই উমার, যে তাকে ধরে ধরে প্রতিদিন মসজিদে নিয়ে যায়, সে এখনও তাকে মসজিদে নিতে আসেনি। সালেমের ভয় হচ্ছিলো, না জানি আবার মসজিদে যেতে দেরি হয়ে যায় আর সে মসজিদের সামনের কাতারে বসার জায়গা না পায়। তাই সে উমার আর তার মা'কে চিৎকার করে ডাকছিল। কিন্ত তারা কেউই সাড়া দিচ্ছেনা দেখে সে কাঁদতে শুরু করলো।

সালেমের কাছে কথাগুলো শুনে আমি তার পায়ের কাছে বসে গেলাম।দেখলাম,তখনও সালেমের চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।
তার পরের কথাগুলো আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না।আমি আমার হাত দিয়ে তার চোখের জল মুছে দিতে দিতে বললাম,- 'এইজন্যেই কি তুমি কাঁদছিলে,সালেম?'
- 'জ্বি' - সে বললো।
মুহূর্তেই আমি আমার বন্ধুদের কথা ভুলে গেলাম, দাওয়াতের কথা ভুলে গেলাম।
আমি বললাম,- 'সালেম, কেঁদোনা। তুমি কি জানো আজ কে তোমাকে মসজিদে নিয়ে যাচ্ছে?'
সালেম বললো,- 'উমারই নিয়ে যাবে। কিন্তু সে সবসময় দেরি করে আসে'।
-'না সালেম। উমার নয়, আজ আমিই তোমাকে মসজিদে নিয়ে যাবো।'- আমি বললাম।
আমার কথায় সালেম যেন খুব অবাক হলো।সে কিছুতেই আমার কথা বিশ্বাস করতে পারছিলোনা। সে ভেবেছে, আমি তার সাথে ঠাট্টা করছি। সে আবার কাঁদতে লাগলো।
আমি হাত দিয়ে তার চোখের জল মুছে দিলাম। আমার হাত তার হাতের উপর রাখলাম। আমি তাকে আমার গাড়িতে করে মসজিদে নিয়ে যেতে চাইলাম, কিন্ত সে আপত্তি জানালো। সে গাড়িতে করে যেতে চাইলো না। বললো,- 'মসজিদ খুব কাছেই।আমাকে ধরে ধরে নিয়ে যান'।

শেষ কবে যে আমি মসজিদে ঢুকেছিলাম আমার মনে নেই। কিন্ত এতোবছর ধরে যা পাপ আমি করেছি, তার জন্যে এই প্রথম আমার মনের ভেতর একটা চাপা ভয় এবং অনুতাপ অনুভব করলাম।
পুরো মসজিদ মুসল্লিতে ভরপুর ছিল। কিন্তু তবুও আমি দেখলাম, একদম সামনের কাতারে সালেমের জন্য একটা খালি জায়গা রেখে দেওয়া হয়েছে। বুঝতে পারলাম, মসজিদে সালেম মুসল্লি হিসেবে খুব পরিচিত।
আমরা একসাথে জুমার খুতবা শুনলাম।সালেম আমার পরে পরে রুকু-সিজদাতে যাচ্ছিলো, কিন্তু আমার মনে হচ্ছিলো, আমিই তার পরে পরে রুকু-সিজদা করছি।
নামাজের পর সে আমাকে একটি কোরআন এনে দিতে বললো। তার কথা শুনে আমি অবাক হলাম। সে তো অন্ধ। সে কি করে কোরআন তেলাওয়াত করবে?
আমি তার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে চাইলাম, কিন্ত তখন তার অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে এরকম কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিলোনা। আমি তাকে একটি কোরআন এনে দিলাম।
সে আমাকে বললো কোরআনের সূরা কাহাফ খুলে দিতে। আমি কোরআনের পৃষ্টা উল্টাতে লাগলাম আর সূচিপত্র দেখে সূরা কাহাফ খুঁজতে লাগলাম।
সে আমার হাত থেকে কোরআনটি নিয়ে নিলো। সেটি মুখের সামনে ধরলো আর সূরা কাহাফ তিলাওয়াত করতে লাগলো।

ইয়া আল্লাহ!! পুরো সূরা কাহাফ তার মুখস্ত!! আমি যেন এই দৃশ্য কোনভাবেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমি নিজেই নিজের প্রতি লজ্জিত হলাম। এই অন্ধ শিশুটার কাছে আমি কতোই না তুচ্ছ! আমিও একটি কোরআন হাতে নিলাম। তখনও আমার পুরো শরীর কাঁপছিলো।আমি কোরআন তিলাওয়াত করেই যাচ্ছি, করেই যাচ্ছি। আমি আল্লাহর কাছে বারবার মাফ চাইছিলাম আর বলছিলাম, - 'হে আল্লাহ! আমাকে সিরাতুল মুস্তাক্বীমের পথ দেখাও! হে আল্লাহ! আমাকে সিরাতুল মুস্তাক্বীমের পথ দেখাও!

আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। মুহূর্তেই শিশুদের মতো কান্না শুরু করলাম।
মসজিদে তখনও কিছু মুসল্লি অবশিষ্ট ছিলো যারা সুন্নত আদায় করছিলো। আমি লজ্জিত হলাম। তাই আমি কোনরকমে আমার কান্না চেপে যেতে চাইলাম। আমার চাপা কান্না দীর্ঘায়িত হলো আর শরীর খুব কাঁপছিলো।আমি তখন খেয়াল করলাম, একটি ছোট্ট হাত আমার মুখমন্ডল স্পর্শ করছে আর আমার চোখের জল মুছে দিচ্ছে। এটা ছিলো আমার পুত্র সালেম। আমার অন্ধ পুত্র সালেম। আমি তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। বললাম, - 'সালেম, তুমি অন্ধ নও। তুমি অন্ধ হতেই পারোনা। অন্ধ তো আমি, যে অসৎ সঙ্গীদের পাল্লায় পড়েছি, যারা আমাকে জাহান্নামের দোরগোড়ায় নিয়ে যাচ্ছে'।
আমরা বাপ-বেটা বাড়ি চলে এলাম। ততোক্ষনে আমার স্ত্রী সালেমের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লো। কিন্তু তার উদ্বিগ্নতা আনন্দ্রাশুতে পরিণত হল,যখন সে জানতে পারলো সালেমের সাথে আমিও আজকে জুমা'হ আদায় করেছি।
সেদিন থেকে, আমি আর এক ওয়াক্ত সালাতও ছাড়িনি। আমি আমার খারাপ বন্ধুগুলোকে ত্যাগ করলাম এবং মসজিদে নিয়মিত সালাত আদায় করে এরকম কিছু মানুষকে বন্ধু করে নিলাম।
তাদের সাথে মিশতে মিশতে আমি ঈমানের স্বাদ অনুভব করতে লাগলাম। তাদের কাছ থেকে আমি এমন কিছু শিখছিলাম যা আমাকে এই দুনিয়া নয়, পরের দুনিয়া সম্পর্কে ভাবাতে লাগলো।
আমি কোন ধর্মীয় বক্তৃতা মিস করতাম না।
প্রায়ই আমি পুরো কোরআন তিলাওয়াত করে ফেলতা। অনেক সময় সেটা এক মাসের মধ্যেই।
আমি সবসময় আল্লাহর স্মরনে থাকতাম।
ভাবতাম, তিনি অবশ্যই আমার পূর্বের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেবেন। আমি আমার পরিবারের দিকে মন দিলাম। আমার স্ত্রীর চোখে-মুখে সবসময় যে ভয়ের রেখা দেখা যেতো, সেটি আর নেই। একটুকরো হাসি আমার ছেলে সালেমের মুখে লেগেই থাকতো। যে কেউ তার এই হাসি দেখতো, তারা বুঝতে পারতো, সে সম্ভবত দুনিয়ার সবকিছুই অর্জন করে ফেলেছে। আল্লাহর এই বিশেষ রহমতের জন্য আমি তার শুক'রিয়া করলাম।
একদিন আমার ঈমানী বন্ধুরা মানুষকে ঈমানের দাওয়াত দেওয়ার জন্য কিছু দূরে যাওয়ার নিয়্যাত করলো। আমি যাবো কি যাবোনা, এটা নিয়ে দ্বিধায় ভুগছিলাম। আমি ইস্তিখারা করছিলাম আর আমার স্ত্রীর সাথে এই বিষয়ে পরামর্শ করছিলাম।

আমি ভেবেছিলাম সে আমায় যেতে নিষেধ করবে।
কিন্তু হলো তার উল্টোটি। এটা শুনে সে খুবই খুশি হলো এবং আমাকে যেতে বেশ উৎসাহ দিলো। কারন, সে ইতিপূর্বে কখনো কোথাও যাওয়ার আগে আমাকে তার সাথে পরামর্শ করতে দেখেনি।
আমি সালেমের কাছে গেলাম এবং বললাম যে আমাকে কিছু দিনের জন্য দাওয়াতি কাজে বেরোতে হবে। সে অশ্রুসজল চোখে আমার দিকে তার দুই বাহু প্রসারিত করে দিলো। আমি তাকে বুকে জড়িয়ে নিলাম। তার কপালে, গালে চুমু খেলাম। স্ত্রী, খালেদ, উমার আর সালেমের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি বেরিয়ে পড়লাম দাওয়াতি কাজে।
প্রায় সাড়ে তিন মাসের মতো আমি বাইরে ছিলাম। সেই সময়টাউ যখনি সুযোগ পেতাম, ফোনে আমার স্ত্রী আর সন্তানদের সাথে কথা বলতাম। আমি তাদের অনেক মিস করতাম। বিশেষ করে সালেমকে। আমি তার কন্ঠ শোনার জন্য ব্যাকুল ছিলাম কিন্তু আমি চলে আসার পর থেকে সবার সাথে কথা হলেও, তার সাথে আমার কোন কথা হয়নি।
আমি যখনই বাড়িতে ফোন করতাম,তখন সে হয় স্কুলে থাকতো, নয়তো মসজিদে। যখনই আমি আমার স্ত্রীকে বলতাম যে, সালেমকে আমি কতোটা মিস করছি, তখন সে আনন্দে আর গর্বে হাসতো। শুধু শেষবার যখন ফোনে তার সাথে সালেমের ব্যাপারে কথা বলি, সেবার তাকে আমি আগের মতো উৎফুল্ল পাইনি। তার কন্ঠস্বর কেমন যেন বদলে গেলো। আমি বললাম,- 'সালেমকে আমার সালাম দিও'।

সে শুধু বললো,- 'ইনশাআল্লাহ! এরপর চুপ করে গেলো।'
এর কিছুদিন পর আমি বাড়ি এলাম। দরজায় আওয়াজ করলাম। আমি ভেবেছিলাম সালেমই আমার জন্য দরজা খুলে দিবে। কিন্ত আমাকে অবাক করে দিয়ে খালেদই সেবার দরজা খুলে দিলো যার বয়স চার ছিলো চার বছরের মতো। খালেদ আমাকে 'বাবা বাবা' বলে ডাকতে শুরু করলো। আমি তাকে কোলে তুলে নিলাম। আদর করলাম। কিন্তু কেনো জানিনা, যখন থেকে ঘরে ঢুকলাম,তখন থেকেই আমার মনের ভেতর একটা ভয় কাজ করছিলো। এক অদ্ভুত রকমের চাপা ভয়!
আমি শয়তানের প্ররোচনা থেকে আল্লাহর কাছে পানা চাইলাম। আমার স্ত্রীর কাছে ছুটে গেলাম। তার চেহারা আগের মতো সতেজ নেই। জগতের সমস্ত দুঃখ যেন তার চেহারায় এসে ভর করেছে। আমাকে দেখে সে অপ্রস্তুত হয়ে গেলো এবং 'সে ভালো আছে' এরকম অভিনয় করতে লাগলো।
আমি তাকে বললাম,- 'কি হয়েছে তোমার?'
- 'কিছুইনা।'- সে জবাব দিলো।

হঠাৎ, আমার সালেমের কথা মনে পড়লো।আমি বললাম,- 'সালেম কোথায়?'
সে কিছুই বললনা। মাথা নিচু করে ফেললো।তার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো।
হঠাৎ আমি ভয়ে কুঁকড়ে গেলাম। আমি কান্না শুরু করলাম।চিৎকার করে বললাম,- 'সালেম কোথায়? সালেম?'
তখন দেখলাম, আমার চার বছরের ছেলে খালেদ তার অস্পষ্ট স্বরে বলছে, - 'বাববা! তালেম ভাই দান্নাতে তলে গেথে আল্লার তাতে।'
আমার স্ত্রী এটা সহ্য করতে পারলোনা।সে কাঁদতে কাঁদতে দ্রুত রুম ছেড়ে চলে গেলো।
পরে আমি জানতে পারলাম, আমি যাওয়ার দুই সপ্তাহ পরে সালেম জ্বরে আক্রান্ত হয়। আমার স্ত্রী তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু সে আর সেরে উঠেনি। জ্বরের উসিলায় সে আল্লাহর সাক্ষাতে চলে গেলো।
[ এটি একটি বাস্তব গল্প। একজন শায়খের সাথে ঘটা। একটি ইংরেজি ম্যাগাজিন থেকে অনুবাদ করেছি। এর আগে ২০১৬ সালে দু'বার পোস্ট করেছিলাম।]

No comments

Note: Only a member of this blog may post a comment.

Powered by Blogger.