'হাদীস থেকে নেওয়া-০২'/ আরিফ আজাদ

কিয়ামতের কথা মনে পড়লে মন খারাপ হয়ে যায়। ভয় লাগে। ভয় লাগাই স্বাভাবিক। যার অন্তরে বিন্দু পরিমাণ ঈমান আছে, যে পরকালে বিশ্বাস করে, তার সামনে মৃত্যুর কথা আলোচনা হলে, কিয়ামতের বিভীষিকাময় দৃশ্যের অবতারণা করা হলে তার ভয় লাগবে। তার পাপের কথা মনে পড়ে যাবে। নির্জনে, নির্ভৃতে যা পাপ করি, তা একে একে মনে ভেসে উঠবে। হাত পা অবশ হয়ে আসার মতো অবস্থা হবে।
পৃথিবীতে গ্রীষ্মের সামান্য খরতাপে জ্বলে-পুড়ে যাওয়ার মতোন অবস্থা হয়, আর কিয়ামতের মাঠে যখন সূর্য খুবই সন্নিকটে থাকবে, সূর্যের দূরত্ব যখন কয়েকশো কোটি মাইল না হয়ে মাত্র কয়েক হাত হবে, সেদিন যদি কোন ছায়াই না থাকে, কোন ছাদ, কোন বৃক্ষ, কোন ঝর্ণা না থাকে, তাহলে কী হবে?
(নোট- এই সূর্য অবশ্যই পৃথিবীর সূর্য না। জাস্ট উপমা...)
অন্যের কথা জানি না। আমার কী হবে? আমার মতো পাপীর সেদিন কী হাল হবে?
চিন্তায় যখন কপালে ভাঁজ পড়ে গেলো, তখন আশা জাগানিয়া একটি হাদীস মনে পড়লো।
হাদীসটি হলো-
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রসুল (সঃ) বলেছেন, সাত প্রকার লোককে আল্লাহ তা'য়ালা হাশরের ময়দানে নিজের আরশের ছায়ায় স্থান দেবেন। যখন সে ছাড়া আর কোন ছায়া থাকবে না। তারা হলেনঃ
(১) মুসলমানদের সুবিচারক শাসক।
(২) সেই যুবক যে আল্লাহ তা'য়ালার ইবাদাতে জীবন (যৌবন) অতিবাহিত করেছে।
(৩) যে ব্যক্তির অন্তর মাসজিদ থেকে বের হওয়ার পর পুনরায় মাসজিদে প্রবেশ না করা পর্যন্ত মসজিদের সাথেই সংশ্লিষ্ট থাকে। অর্থাৎ তার অন্তর থাকে মসজিদে, দেহ থাকে বাইরে।
(৪) যে দু'ব্যক্তি আল্লাহর জন্য একে অপরকে ভালোবাসে এবং সেই মহব্বতের জন্যই তারা একত্রিত হন। এবং সেই মহব্বতের কথা স্মরণ
রেখেই পরস্পর থেকে পৃথক হন।
(৫) যে ব্যক্তি নিভৃতে একাকী অবস্থায় আল্লাহর যিকির করে এবং তার ভয়ে নয়ন যুগল হতে অশ্রু প্রবাহিত হয়।
(৬) যে ব্যক্তিকে কোন পরমা সুন্দরী ও অভিজাত শ্রেণীর মহিলা ব্যভিচারের জন্য আহ্বান জানালে সে সুস্পষ্টভাবে এই উত্তর দেয় যে, - 'আমি আল্লাহ তা'য়ালাকে ভয় করি।'
(৭) যে ব্যক্তি এমন সংগোপনে দান করে যে, তার বাম হাত জানেনা তার ডান হাত কি দান করেছে।
(বুখারী, হাদীস নম্বর- ৬৬০)
হাদীসটি নিয়ে আমি একটু গবেষণায় নামলাম। উদ্দেশ্য, এই সাত ক্যাটাগরির কোন এক ক্যাটাগরিতে যদি নিজেকে ফেলা যায়, অথবা নিজেকে কোন এক ক্যাটাগরির উপযুক্ত করে তোলার জন্য চেষ্টা করা যায়, কীনা....
সেই সৌভাগ্যবান সাত ব্যক্তির প্রথম ব্যক্তি হলেন এমন একজন যিনি হবেন একজন নিষ্ঠাবান, সৎ, ন্যায়পরায়ণ শাসক।
আমি যেহেতু শাসক শ্রেণীর কেউ নই, তাই এই ক্যাটাগরি নিয়ে আপাতত ভাবতে পারছি না।
দ্বিতীয় ক্যাটাগরি হলো এমন যুবক, যে তার যৌবন পার করে দেয় আল্লাহর ইবাদাতে।
আলহামদুলিল্লাহ্‌। আমি চাইলেই অনায়েশে এই ক্যাটাগরিতে ঢুকে পড়তে পারি। গুনাহ করেছি অঢেল। পাপ আমার হিমালয় পর্বত সম। কিন্তু তাতে কী? আমার রব তো রহমানুর রহীম। আমি অন্তর থেকে ক্ষমা চাইলেই তিনি ক্ষমা করে দেন।
এখন আমার যৌবন কাল। শক্তিতে, সামর্থে আমি কারো চেয়ে কম যাইনা। এই যৌবন আমি কী কাজে ব্যয় করছি?
আমি যদি খাস দিলে তওবা করে আজ থেকে আল্লাহর ইবাদাতে নিমগ্ন হই, তাহলে আমিও হতে পারি সেই সৌভাগ্যবান সাতজনদের একজন।
তৃতীয় ক্যাটাগরি হলো এমন কেউ, যে মসজিদ থেকে সালাত আদায় করে বের হয় ঠিকই, কিন্তু তার অন্তর মসজিদে পড়ে থাকে।
এটা এরকম- ফজর সালাত মসজিদে পড়ার পরে যোহরের আযান কবে হচ্ছে, কয়টায় জামাত তা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকা। উদ্বিগ্নতা এজন্যই যে, বাই চান্স জামাত না মিস হয়ে যায়।
ফজর থেকে যোহরের এই মধ্যবর্তী সময়ে আমার অনেক কাজ থাকতে পারে। ক্লাস থাকতে পারে। অফিস থাকতে পারে। তবুও, আমাকে সবকিছু এমনভাবেই সেট করতে হবে যাতে আমার জামাতে সালাত মিস না হয়।
ঠিক এভাবেই আসর। ঠিক এভাবেই মাগরীব, এশার সালাতের ব্যাপারেও যদি আমি সতর্ক থাকতে পারি, তাহলে আমিও হতে পারি সেই সৌভাগ্যবান সাতজনদের একজন। আহা! কতোই না সহজ! শুধু দরকার একটুকু প্রচেষ্টা, একটু.....
চতুর্থ ক্যাটাগরি হলো এমন কেউ, যারা আল্লাহর জন্য, আল্লাহকে ভালোবেসে একত্রিত হয়, আল্লাহকে ভালোবেসেই পৃথক হয়।
আমার কাছে মনে হয় এটা এরকম,- ধরুন, আপনি প্রেম ভালোবাসা নামের বিবাহঃপূর্ব অবৈধ সম্পর্কে যুক্ত। এমতাবস্থায়, আপনি জানতে পারলেন যে আপনি যে পথে আছেন, সেটা ঠিক নয়। এটা হারাম। এখন আপনার হাতে দুটি উপায়। প্রেমিকা? না, আল্লাহর হুকুম?
প্রেমিকাকে ভালোবেসে আল্লাহর হুকুম অমান্য করবেন? নাকী, আল্লাহকে ভালোবেসে অনৈসলামিক সম্পর্ক ছাড়বেন?
যদি আপনি আল্লাহকে ভালোবেসে অনৈসলামিক সম্পর্ক ছাড়তে পারেন, তাহলে এটা হলো- 'আল্লাহকে ভালোবেসে পরস্পর পৃথক হওয়া'...
আবার, আপনি যখন তাকে ছেড়ে, সেই জীবন ছেড়ে দ্বীনে আসবেন, এরপর একজন দ্বীনদার মহিলাকে বিয়ে করে দ্বীন পূর্ণ করবেন, সেটা হলো- 'আল্লাহকে ভালোবেসে একে-অপরের কাছে আসা'...
আপনি যদি এরকম করতে পারেন, তাহলে আপনিও হয়ে যেতে পারেন সেই সৌভাগ্যবানদের একজন।
এমনও হতে পারে- ধরুন আপনার কাছে আপনার বাবা মা প্রাণাধিক প্রিয়। অবশ্যই প্রত্যেকের কাছে তাদের পিতা-মাতা প্রাণাধিক প্রিয়। হওয়া উচিত।
ধরুন, আপনি ইসলামকেও সমানভাবে ভালোবাসেন। এমতাবস্থায়, আপনার বাবা-মা ধরুন আপনাকে এমনকিছু করতে বললো যা ইসলাম বিরোধি। যদি তা আপনি না করেন, তারা আপনাকে পুত্র বলে স্বীকার করবে না বা আপনার সাথে সম্পর্ক রাখবে না।
এমতাবস্থায় আপনি কোনটাকে অগ্রাধিকার দিবেন? আল্লাহর হুকুম? নাকী, বাবা-মা'র ইচ্ছাকে?
এই অবস্থায়, বাবা-মা'র ইচ্ছাকে ত্যাগ করে আল্লাহর হুকুম পালন করার ফলে যদি আপনাকে পরিবার ত্যাগ করা লাগে, সেটাই হলো- 'আল্লাহকে ভালোবেসে পরস্পর দূরে যাওয়া'...
পঞ্চম ক্যাটাগরি হলো এমন কেউ, যে নিভৃতে, নির্জনে আল্লাহর ভয়ে অশ্রু বিসর্জন দেয়।
ভাবুন তো, এক বছরে আমরা কতো রাত তাহাজ্জুদের সালাত পড়তে দাঁড়াই? এভারেইজে এটা কী ৩ বার ক্রস করবে? মনে হয় না।
অথচ, এমন কোন দিন আছে কী যেদিন আপনি রাত একটা, দুইটা, তিনটা পর্যন্ত ফেইসবুকিং করেন না?
ফেইসবুকিং করার চেয়ে তাহাজ্জুদ নামাজে দাঁড়িয়ে আল্লাহর কাছে কান্না করা, নিজের গুনাহ মাফ চাওয়া কী খুব বেশি কষ্টের?
যদি এই অভ্যাস গড়ে তুলতে পারি, তাহলে আমিও হতে পারি সৌভাগ্যবান সাত জনের একজন।
ষষ্ঠ ক্যাটাগরি হলো এমন কেউ, যার কাছে অবৈধ সম্পর্কের প্রস্তাব আসলে সে বলে,- 'আমি আল্লাহকে ভয় করি'....
এইটা খুব ভয়ানক। এটা শুরু হয় অবৈধ রিলেশান প্রেমের নামে, আর শেষ হয় দৈহিক সম্পর্ক দিয়ে।
তাই, ভার্চুয়াল আর রিয়েল যে জগতেই হোক, যখনই আপনার কাছে কোন প্রেম প্রস্তাব আসে, কোন অবৈধ প্রস্তাব আসে, তখন যদি বলতে পারেন,- 'আমি আমার আল্লাহকে ভয় করি। আমি এসবে জড়াতে পারবো না',
তাহলে আপনিও হয়ে যাবেন সৌভাগ্যবান সাত ব্যক্তিদের একজন।
সপ্তম ক্যাটাগরি হলো এমন কেউ, যে কোনকিছু তার ডান হাতে দান করলে সেটা তার বাম হাতে জানতে পারেনা।
আমাদের সমাজে দানের ব্যাপারটা এখন অনেকটা লোক দেখানোর পর্যায়ে চলে গেছে।
আমরা এখন দান করি সমাজে নিজের প্রভাব, সম্পত্তির পরিমাণ বুঝানোর জন্য।
মাইকিং করে দান করার প্রচলনও আজকাল দেখা যায়।
কিন্তু দানের নিয়ম এমন যে, আপনি যা দান করবেন তা আপনি, যাকে দিচ্ছেন তিনি এবং আল্লাহ ছাড়া আর কেউই জানবে না।
এখানে মূলত এই ক্যাটাগরির লোককেই বুঝানো হয়েছে।
যা-ই দান করি না কেনো, তা যদি 'লোক দেখানো' থেকে বিরত হয়ে করতে পারি, তাহলে আমিও হতে পারি সৌভাগ্যবানদের একজন।
তাহলে, প্রথম ক্যাটাগরি ছাড়া বাকী ছয় ক্যাটাগরির প্রত্যেকটাতেই আমি চাইলে সহজেই এক্সেস নিতে পারছি।
ভাবুন তো, কিয়ামতের মাঠে যখন কোথাও কোন ছায়া নেই, যখন তৃষ্ণায় বুক ফেঁটে যাবে, যখন সবাই অসহায় ভঙ্গিতে একটু সাহায্যের জন্য এদিক-ওদিক তাকাবে, তখন যদি আল্লাহ আপনাকে অনুগ্রহ করে আরশের ছায়ার নিচে আশ্রয় দেন, আপনার কেমন লাগবে?
এরজন্য কী আপনাকে খুব বেশিই কষ্ট করতে হবে? একদম না। বিশ্বাস করুন, অনেককককক সহজ, অনেকককক।
ভাবুন....অনুধাবন করুন।
'হাদীস থেকে নেওয়া-০২'/ আরিফ আজাদ

No comments

Note: Only a member of this blog may post a comment.

Powered by Blogger.