ইসলাম কি গর্ভের সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণের ব্যাপারে ভুল তথ্য দেয়?

ইসলাম কি গর্ভের সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণের ব্যাপারে ভুল তথ্য দেয়?
------------------------------------------------------------
সহায়কঃ আ্যন্টিডোট - আশরাফুল আলম
অনেক হাদিস আছে যেখানে বলা হচ্ছে যে লিঙ্গ নির্ধারণ হয় ১২০ দিনে আবার কোন কোন হাদিস বলে ৪০, ৪২, ৪৫ কোনটা ঠিক আবার বলা হচ্ছে বীর্য চল্লিশ দিন গর্ভে থাকে কিন্তু এটি সম্পুর্ন ভুল বিজ্ঞান এরকম কখনই বলেনা লিঙ্গ নির্ধারণ অনেক আগে হয়ে যায় XX, XY ক্রমোসোমের মাধ্যমে।
প্রথমত
উপোরক্ত প্রশ্নকে বেশ কয়েক পয়েন্টে ভাগ করা যাক।
1. হাদিস কি বলে কয়দিনে লিঙ্গ নির্ধারণ হয়?
2. বীর্য কি আসলেই চল্লিশ দিন জমা থাকে?
3. জন্মের অনেক আগেই তো XX, XY ক্রমোসোমের মাধ্যমে সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণ হয় তাহলে হাদিস কেন ৪০,৪২,৪৫,১২০ দিনের কথা বলে?
হাদিস কি বলে কয়দিনে লিঙ্গ নির্ধারণ হয়?
------------------------------------------------------
বুখারির হাদিসে বলা হয়েছে,
‘আবদুল্লাহ্‌ ইবনু মাস’ঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, সত্যবাদী ও সত্যবাদী স্বীকৃত রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের প্রত্যেকেই আপন আপন মাতৃগর্ভে চল্লিশ দিন পর্যন্ত (শুক্র হিসেবে) জমা থাকে। তারপর ঐরকম চল্লিশ দিন রক্তপিন্ড, তারপর ঐরকম চল্লিশ দিন গোশত পিন্ডাকারে থাকে। তারপর আল্লাহ্ একজন ফেরেশতা পাঠান এবং তাকে রিযিক, মৃত্যু, দুর্ভাগ্য ও সৌভাগ্য- এ চারটি বিষয় লিখার জন্য আদেশ দেয়া হয়। ( সংক্ষেপিত) [১]।
উপোরোক্ত হাদিসে কোথাও বলা হচ্ছেনা যে, লিঙ্গ নির্ধারণ হয় ১২০ দিনে এখানে সুস্পষ্ট ভাবেই বলে দেয়া হচ্ছে যে, আল্লাহ্ একজন ফেরেশতা পাঠান এবং তাকে রিযিক, মৃত্যু, দুর্ভাগ্য ও সৌভাগ্য- এ চারটি বিষয় লিখার জন্য আদেশ দেয়া হয়। এখানে স্পষ্ট বলেই দেয়া আছে যে সুনির্দিষ্ট এই উপোরক্ত চারটি বিষয় লিখতে বলা হয়। লিঙ্গের কথা কোথাও বলা হয়নি।
এখন প্রশ্ন হল আসলে লিঙ্গ নির্ধারণ Exact কয়দিনে হয়?
সহিহ মুসলিমের এক রেওয়াতে আছে ৪০ দিন [২] আবার সেই সহিহ মুসলিমেরই হাদিসে বলা আছে ৪২ দিন [৩]। তবে এক হাদিস দিয়ে সম্পুর্ন সমস্যা সমাধান হয় আর সেটি হলঃ
হুযাইফাহ্ ইবুন আসীদ (রহঃ) হতে মারফূ‘ সূত্রে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে বর্ণিতঃ:
তিনি বলেন, জরায়ুতে চল্লিশ অথবা পঁয়তাল্লিশ দিন রেণু জমা থাকার পর সেখানে ফেরেশ্ তা গমন করে। অতঃপর সে বলতে থাকে, হে আমার প্রভু! সে কি হতভাগ্য না সৌভাগ্যবান? তখন উভয়টাতে লিপিবদ্ধ করা হয়। তারপর সে বলতে থাকে, হে আমার রব! সে কি পুরুষ না মহিলা? তখন আদেশ অনুসারে উভয়টা লিপিবদ্ধ করা হয়। তার ‘আমাল, আচরণ, মৃত্যুক্ষণ ও জীবনোপকরণ লিপিবদ্ধ করা হয়। তারপর ফলকটিকে পেঁচিয়ে দেয়া হয়। তাতে কোন অতিরিক্ত করা হবে না এবং ঘাটতিও হবে না।[৪]
সিদ্ধান্তঃ উপোরক্ত হাদিসগুলো আমরা যদি একত্রিত করি তাহলে ফলাফল হিসেবে আমরা।যা পাই তা হল সন্তানের লিঙ্গ ঠিক ৪০ - ৪৫ দিনের মাঝামাঝি সময়ে ঠিক করা হয়।
বীর্য কি আসলেই ৪০ - ৪৫ দিন জমা থাকে?
------------------------------------------------------------
উপোরোক্ত অনুবাদে বীর্য শব্দ ব্যাবহার করা হয়েছে কিন্তু উপোরোক্ত হাদিস সমূহের কোনোটিরই আরবি ইবারতে মানি শব্দ ব্যাবহার করা হয়নি যার অর্থ বীর্য বোঝায় [৫]। বরং সেখানে যে শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে তা হল ْ (يُجْمَعُ خَلْقُهُ) ইউজমা'উ ক্ষলক্কুহু। এইখানে আরবি ( يُجْمَعُ) ইউজমা'উ শব্দের অর্থ হচ্ছে একত্রিত হওয়া বা উপস্থিতি লাভ করা [৬] আর পক্ষান্তরে ( خَلْقُهُ) ক্ষলক্কুহু বলতে সৃষ্ট বোঝায় বা সৃষ্টি করা বোঝায় [৭]।
তাহলে আমরা বলতেই পারি যে উপোরোক্ত হাদিসে কোথাও বলা হয়নি যে, বীর্য চল্লিশ দিন স্থগিত থাকে। বরং বলা হয়েছে যে, একটা সন্তান সৃষ্টি করতে যা যা Components প্রয়োজন সেইসকল components চল্লিশ দিনের মাঝেই একত্রিত হয় আর চল্লিশ - পয়তাল্লিশ দিনের মাঝেই সেটা একটা চোখ, কান, নাক বিশিষ্ট একটি গোশতের টুকরার ন্যায় আকৃতি লাভ করে। এরমানে সম্পুর্ন ব্যাপারটা কখনই স্থগিত থাকেনা এককথায় সেই উপাদান একত্রিত হবার পর সেটা ধীরে ধীরে Grow হতে থাকে এবং চল্লিশ - পয়তাল্লিশ দিনের মাঝেই সেটা একটা গোশতের টুকরায় পরিণত হয়।
অনেকে আমাদের প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য বলবে উপরে আমরা সেইসমস্ত শব্দ নিজে নিজে বসিয়েছি আমরা নিজের থেকে অনুবাদ করেছি কিন্তু আসলে না নিচে ইংরেজি অনুবাদ দেয়া হল সেখানেও কোথাও Sperm বা Semen শব্দ নেই সেখানে বলা হয়েছে,constituents যার অর্থ উপাদান।
ইংরেজি অনুবাদঃ
------------------------
Abdullah (b. Mas'ud) reported that Allah's Messenger (ﷺ) who is the most truthful (of the human beings) and his being truthful (is a fact) said: Verily your creation is on this wise. The constituents of one of you are collected for forty days in his mother's womb in the form of blood, after which it becomes a clot of blood in another period of forty days.(সংক্ষেপিত) [৮]।
উপোরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা এটা বলতে পারি যে, পুরুষ এবং নারীর মিলনে সন্তান জন্ম নেয় এবং সন্তান একটি নারীর গর্ভে জন্ম নেবার জন্য যা যা উপাদান প্রয়োজন তা চল্লিশ দিনেই একত্রিত হয় তবে এক্ষেত্রে মনে রাখার বিষয় যে সেটি একত্রিত হতে চল্লিশ দিন সময় লাগেনা। বরং সেটি একত্রিত বহু আগেই হয়ে যায় এবং কালক্রমে Growing হতে হতে এক পর্যায় চল্লিশ - পয়তাল্লিশ দিনের মাঝে বা ৫ - ৬ সপ্তাহে চোখ নাক কান বিশিষ্ট একটি গোশতের টুকরায় পরিণত হয়।
নিচে ভ্রুণের ৬ - ৭ সপ্তাহের মাঝামাঝি সময়ের একটি ছবি দেয়া হল।
এখানে চিহ্নিত অংশ গুলোর মাঝে
1. Arm Bud - বাহু, 2. Branchial Arches, 3. Early Membranes, 4. Eye - চক্ষু, 5. Genital Tubercle, 6. Heart Bulg, 7. Leg Bud - পা, 8. Tail - লেজ 9. Umbilical Cord - নাড়ী। [৯] ; [১০]।
ভ্রুণে ৬ সপ্তাহ আগে বা ৪২ দিনের আগে ভ্রুণের এইরকম স্পষ্ট সদৃশ চোখ, কান, গোশত আকৃতিতে গঠিত হয় না।
[এরজন্য দেখুনঃ Drawing of embryo at 6 - 7 weeks. The appearance at this time cannot be distinguished as that of a human embryo. ( Reproduced with permission from CIBA, clinical symposia Vol. 28 No.3)]
আর হাদিসেও এটিই বলা হয়েছে।
হাদিসঃ
------------
‘আমির ইবনু ওয়াসিলাহ্ (রহঃ) ‘আবদুল্লাহ ইবনু মাস‘উদ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেছেন, দুর্ভাগ্য সে লোক, যে তার মায়ের গর্ভ হতে দুর্ভাগা আর সৌভাগ্যবান লোক সে, যে অন্যের নিকট হতে উপদেশ লাভ করে। অতঃপর তিনি রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সহাবাদের মধ্য থেকে একজন সহাবা যাকে হুযাইফাহ্ ইবনু আসীদ আল গিফারী বলা হয় তার কাছে আসলেন। তখন তিনি তাঁর নিকট ‘আবদুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ)-এর কথা বর্ণনা করলেন এবং বললেন, ‘আমালহীন কোন লোক কিভাবে দুর্ভাগ্যবান হতে পারে? অতঃপর তিনি [হুযাইফাহ্ (রাঃ)] তাঁকে বললেন, তুমি কি এতে আশ্চর্য হচ্ছ? আমি রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি যে, তিনি বলেছেন, যখন (মাতৃগর্ভে) শুক্রকীটের উপর বিয়াল্লিশ দিন চলে যায় তখন আল্লাহ তা‘আলা একজন ফেরেশ্তা প্রেরণ করেন। তিনি ওটাকে (শুক্রকে) একটি রূপ দান করে, তার কান, চোখ, চামড়া, গোশ্ত ও হাড় সৃষ্টি করে দেয়। তারপর ফেরেশতা বলে, হে আমাদের রব! সেটা কি পুরুষ, না মহিলা হবে? তখন তোমার প্রভু যা চান সিদ্ধান্ত দেন এবং ফেরেশ্তা আদেশ অনুসারে তা লিখে ফেলেন। তারপর সে বলতে থাকে, হে আমাদের রব! তার জীবিকা কি হবে? তখন তোমার রব তাঁর মর্জি অনুযায়ী ফায়সালা করেন এবং ফেরেশ্তা তা লিপিবদ্ধ করেন। এরপর ফেরেশ্তা তাঁর হাতে একটি লিপিবদ্ধ কিতাব নিয়ে বের হন। সে এটাকে বৃদ্ধিও করে না এবং ঘাটতিও করে না। [১১]
জন্মের অনেক আগেই তো XX, XY ক্রমোসোমের মাধ্যমে সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণ হয় তাহলে হাদিস কেন ৪০,৪২,৪৫,১২০ দিনের কথা বলে?
------------------------------------------------------------
প্রথমেই নাস্তিকেরা ভুল করে ফেলে আর সেটা হল তারা বলে ক্রোমোসোমের কারণে নাকি লিঙ্গ নির্ধারিত হয়। আসলে ব্যাপারটা মোটেও এরকম না বরং লিঙ্গ নির্ধারণ হয় ক্রোমোসোমে থাকা জিন এর কারণে মোট ৭০ ধরণের জিন ক্রোমোসোমে রয়েছে যেটার মাধ্যমে লিঙ্গ নির্ধারণ হয় বস্তুত এইসকল জিনিস হয় আল্লাহর ইচ্ছায় তবে বিজ্ঞানের ভাষায় লিঙ্গ নির্ধারণ হয় ক্রোমোসোমের মাধ্যমে নয় বরং সেখানে থাকা ৭০ ধরনের জিন এর মাধ্যমে [১২]
এছাড়া সাধারণ অর্থে আমরা যদি কাউকে জিজ্ঞাস করি যে, আপনি আপনার সন্তান ছেলে নাকি মেয়ে আএটা বুঝলেন কিভাবে? সে নিশ্চয়ই উত্তর দিবে যে, কেন? তার যৌনাঙ্গ দেখে। কেউই বলবেনা যে আমি জেনেটিকালি পরীক্ষা করে নিজেকে পুরুষ বা নারী বলছি।
আবার আমিরা জানি যে, XY হলে ছেলে আর XX হলে মেয়ে এরকম কিন্তু অনেক সময় এরকমটা হয়না৷ কারণ কিছু ক্ষেত্রে সন্তানের লিঙ্গ এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্য ছেলেদের মতো হলেও তার জেনেটিক সেক্স হয় ‘XX’ অর্থাৎ, মেয়েদের মতো! এই সমস্যা হয় অ্যাড্রেনাল হাইপারপ্লাশিয়া হলে। আবার কিছু সময় সন্তানের লিঙ্গ এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্য মেয়েদের মতো হলেও তার
আবার কিছু সময় সন্তানের লিঙ্গ এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্য মেয়েদের মতো হলেও তার জেনেটিক সেক্স হয় ‘XY’ অর্থাৎ, ছেলেদের মতো! এই সমস্যা হয় টেস্টিকুলার ফেমিনাইজেশান হলে। এগুলোকে ‘সিউডো হারমাফ্রোডিটিজম’ বলা হয়।[১৩]
তাই ক্রোমোসোমের লজিক দেখিয়ে হাদিসকে ভুল প্রমাণ করার অপচেষ্টা মূলত হাদিসের ভুল না বরং তাদের জানার ভুল তাদের অল্প বিদ্যার ফল।
সাধারণত মানুষের প্রজননতন্ত্র দেখেই বোঝা যায় যে, সন্তান ছেলে নাকি মেয়ে। মানুষের প্রজননতন্ত্র মূলত তিনটি জিনিস নিয়ে গঠিত। প্রথমত, গোনাড বা শুক্রাশয় এবং ডিম্বাশয়। তারপরে, জেনিটাল ডাক্ট যা পরবর্তীতে মেসোনেফ্রিক ও প্যারামেসোনেফ্রিক ডাক্টে রূপান্তরিত হয়। এবং সবশেষে, এক্সটারনাল জেলিটালিয়া বা, বাহ্যিক যৌন অঙ্গ। এগুলোর সাহায্যে কারো জেন্ডার নির্ণয় করা না গেলে তখন হরমোন এবং সাইকোলজিক্যালি জেন্ডার নির্ণয় করা হয়। মানুষের ভ্রূণে ৬ সপ্তাহ পর্যন্ত প্রজননতন্ত্রের এই প্রধান অংশগুলির কোনো অংশই পার্থক্য করা যায় না। অর্থাৎ, এই অবস্থায় ছেলে বা মেয়ের জননতন্ত্রের অংশগুলো একই থাকে। এই অবস্থাকে বলে ইন-ডিফ্রেন্ট স্টেজ।[৪] আবার ভ্রূণবিদ্যা থেকে এটাও জানা যায় যে, ৬ সপ্তাহের আগে অর্থাৎ, বিয়াল্লিশ দিনের আগে সাধারণভাবে ভ্রূণটি ছেলে নাকি মেয়ে সেটা আলাদা করা অসম্ভব।”[১৪]
আর রাসুল সাঃ বাহ্যিকভাবে যে প্রজনন্তন্ত্র দেখা যায় তারই কথা বলেছে। আশা করি উত্তর পেয়েছেন।
তথ্যসূত্রঃ
1. সহীহ বুখারী ৬৫৯৪
2. মুসলিম ৬৬১৬
3. মুসলিম ৬৬১৯
4. মুসলিম ৬৬১৮
5. Differences between semen (maniy) and urethral fluid (madhiy) Islamqa Fatwaa 2458 -
https://www.google.com/amp/s/islamqa.info/amp/…/answers/2458
9. Reproduce With per mission from England, Color atlas of life before birth Chicago - Year book medical publisher inc.1983
10. Drawing of embryo at 6 - 7 weeks. The appearance at this time cannot be distinguished as that of a human embryo. ( Reproduced with permission from CIBA, clinical symposia Vol. 28 No.3)
11. মুসলিম ৬৬১৯
13. Medical Book of Forensic Medicine and Toxicology; Written by Reddy; 33rd edition; page: 65
14. The Developing Human, Clinically Oriented Embryology By Dr. Keith L. Moore(8th edition); Page: 327





No comments

Note: Only a member of this blog may post a comment.

Powered by Blogger.