“একজন বিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে স্রষ্টার অস্তিত্ব”

“একজন বিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে স্রষ্টার অস্তিত্ব” 
=======================================
.
অনেক সময় এমন সংশয় ছড়ানো হয় যে, এই বিশ্বপ্রকৃতির জন্যে কোনো সৃষ্টিকর্তার প্রয়োজন হয়নি। তবে এ কথা ঠিক যে, মহাবিশ্বের অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। বিশ্বের উৎপত্তি সম্পর্কে চারটি সমাধান দেওয়া যেতে পারে। প্রথমত, পূর্ববর্তী কথার পরিপন্থী—এ বিশ্ব বিভ্রম মাত্র। দ্বিতীয়ত, সম্পূর্ণ শূন্য থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার উৎপত্তি হয়েছে। তৃতীয়ত, আদৌ এ বিশ্বের কোনো শুরু নেই। অনাদিকাল থেকেই মহাবিশ্ব বিদ্যমান। চতুর্থত, এটি সৃষ্টি করা হয়েছে।
.
প্রস্তাবিত সমাধানগুলোর মধ্যে প্রথমটি এটিই প্রমাণ করে যে, একমাত্র অনেক সময় বিভ্রম বলে বিবেচিত মানব মনের চেতনা সম্পর্কিত অধিবিদ্যা সমস্যা ছাড়া, এ ব্যাপারে আর কোনো সমস্যা নেই। স্যার জেমস জিনসের প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে সম্প্রতি বিভ্রমের প্রকল্প পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। আধুনিক পদার্থবিদ্যা সম্পর্কিত ধারণা থেকে তিনি বলেন, “এ বিশ্ব কোনোভাবেই জড় প্রতিরূপকে স্বীকার করতে পারে না। আমার মতে এর কারণ এই যে, এটি শুধুমাত্র মানসিক কল্পনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে।”
.
অনুরূপভাবে কেউ আরও সহজ বলতে পারে, কল্পনার রেলগাড়ি আপাত প্রতীয়মান কাল্পনিক যাত্রী বোঝাই করে মানসিক কল্পনার মালমশলায় তৈরি সেতুর ওপর দিয়ে অবাস্তব নদী অতিক্রম করছে। 
পদার্থ আর শক্তির আধার সমৃদ্ধ এই বিশ্ব একেবারে শূন্য থেকে হঠাত উৎপত্তি সম্পর্কিত দ্বিতীয় ধারণাটিও প্রথম চিন্তাধারার মতো এতটাই অধিক অযৌক্তিক যে, এর বিচার-বিবেচনা নিষ্প্রয়োজন। 
.
তৃতীয় চিন্তাধার হচ্ছে, আবহমানকাল থেকে এই মহাবিশ্ব বিদ্যমান। এতে নূন্যতম একটা বিষয় স্বীকৃত হয়েছে, এবং তা হচ্ছে সৃষ্টি সম্পর্কিত ধারণা। সে সৃষ্টি শক্তি-সন্নিবেশিত কোনো জড় পদার্থ দ্বারাই হোক, বা কোনো স্বয়ংক্রিয় স্রষ্টার দ্বারাই হোক, তাতে কিছু আসে যায় না। তবে সৃষ্টির ধারণা শাশ্বত। এই দুটো ধারণার একটি থেকে অপরটিতে যে বুদ্ধিবৃত্তিক বড়ো রকমের অসুবিধে আছে, তা নয়। কিন্তু তাপ-গতিবিদ্যার নিয়ম-কানুন থেকে এটিই প্রমাণিত হয় যে, এই বিশ্ব ক্রমশ তাপ বিকিরণ করতে করতে নিম্ন তাপের দিকে এগোচ্ছে এবং এমন সময় আসবে যখন গ্রহ-উপগ্রহ অত্যধিক নিম্ন তাপমাত্রায় উপনীত হবে। তখন তাপশক্তি বলতে আর কিছুই থাকবে না। 
.
আবহমানকাল থেকেই যদি এই বিশ্ব বিদ্যমান থাকতো, তাহলে অনন্ত অসীম এই সময়ের ব্যবধানে ইতোমধ্যে অবশ্যই অনুরূপ অবস্থার সৃষ্টি হোতো। কিন্তু উত্তপ্ত সূর্য, নক্ষত্ররাজি, প্রাণ ও সম্পদে পূর্ণ এই ধরা সাক্ষ্য দিচ্ছে, এ মহাবিশ্ব নির্দিষ্ট সময়ে সৃষ্টি হয়েছে। এ থেকে এটিই প্রমাণ হয় যে, অবশ্যই এই বিশ্ব সৃষ্টি হয়েছিলো। এই বিরাট সৃষ্টির মূলে শাশ্বত, সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান এক মহান সৃষ্টিকর্তা অবশ্যই আছেন। আর মহাবিশ্ব তাঁরই সুনিপুণ সৃষ্টি ছাড়া আর কিছুই নয়। 
.
প্রাণী বসবাসের উপযোগী করে পৃথিবীকে এমনভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং বিভিন্ন দিক থেকে এখানে এমনভাবে সমন্বয় সাধন করা হয়েছে যে, সেগুলো বিবেচনা করলে কোনোভাবেই বলা যাবে না যে, হঠাত করে এ পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে। প্রথম কথা হচ্ছে, গোলাকার এই পৃথিবী ভারসাম্য রক্ষা করে মহাশূন্যে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে অবস্থান করছে। এবং সাথে সাথে নিজ অক্ষের চারিদিকে প্রদক্ষিণ করছে। এই দু গতির ফলেই পৃথিবী মহাশূনে নির্দিষ্ট পথে ঘুরতে সক্ষম হচ্ছে, এবং এই পরিক্রমণের সময় পৃথিবী নিজ কক্ষপথে একটু ঝুঁকে থাকার কারণে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ঋতু পরিবর্তিত হচ্ছে। এর ফলে ভূপৃষ্ঠে আবাদী জমির পরিমাণ দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সাথে সাথে একটি নির্দিষ্ট সাথে স্থির পৃথিবীর চাইতে বিচিত্র ধরণের উদ্ভিদ জন্মানো সম্ভব হয়েছে।
.
দ্বিতীয়ত, জীবন রক্ষাকারী গ্যাসে ভর্তি বায়ুমণ্ডল পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে যথেষ্ট ওপর পর্যন্ত বিস্তৃত। সেকেন্ডে প্রায় ত্রিশ মাইল গতিবেগে বিশটি উল্কাপিণ্ড প্রতিদিন ছুটে এলেও—বায়ুমণ্ডলের বিশাল ঘনত্বের কারণে—উল্কার আঘাত থেকে পৃথিবী বেঁচে যাচ্ছে। তাপমাত্রাকে জীবন ধারণের সহনীয় মাত্রায় রাখাও বায়ুমণ্ডলের একটি কাজ। মহাসাগর থেকে সৃষ্ট অত্যাবশ্যকীয় অলবণাক্ত জলীয় বাষ্পকে সিঞ্চন করা বায়ুমণ্ডলের আরেকটি কাজ। এর এই (জলীয় বাষ্পের ফলে সৃষ্ট) বৃষ্টি না হলে, গোটা পৃথিবী প্রাণহীন ধূধূ মরুভূমিতে পরিণত হোতো। তাই বুঝা যাচ্ছে, মহাসাগর ও বায়ুমণ্ডল প্রকৃতির এক সুষম চক্রের ধারক (পানিচক্র)। 
.
পানির উল্লেখযোগ্য চারটে বিশেষ ধর্ম হলো, নিম্ন তাপমাত্রায় বিপুল পরিমাণে অক্সিজেন শুষে নেওয়ার ক্ষমতা। হিমাংক বিন্দুর ওপর ৪০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় এর সর্বাধিক ধনত্বের ফলে, হ্রদ আর নদীর পানি তরল অবস্থায় থাকে। বরফের ঘনত্ব পানির ঘনত্বের চেয়ে কম হওয়ায়, বরফ পানির ওপর ভাসমান থাকে। পানি জমে বরফে পরিণত হওয়ার সময় বিপুল তাপ বিকিরণের দ্বারা মহাসাগর, হ্রদ এবং নদীতে শীতকালে জলজ প্রাণীর জীবন রক্ষায় সহায়ক ভূমিকা পালন করে। 
.
মহাশূনের বিশালতার সাথে তুলনা করে অনেক সময় হেঁয়ালি করে পৃথিবীকে অত্যন্ত ক্ষুদ্র বলে উল্লেখ করা হয়। পৃথিবী যদি চাঁদের সমান আকারে ক্ষুদ্র হোতো, বর্তমান ব্যাস যা আছে তা থেকে যদি এক-চতুর্থাংশ কমে যেতো, তাহলে মধ্যাকর্ষণ শক্তি বায়ুমণ্ডল ও পানিকে ধরে রাখতে পারতো না। সাথে সাথে তাপমাত্রাও বেড়ে যেতো। পৃথিবীর ব্যাস বর্তমান ব্যাসের দ্বিগুণ হলে, বর্ধিত পৃথিবীর ওপরিভাগের পরিমাণ বর্তমান ভূপৃষ্ঠ থেকে চারগুণ বেশি হোতো। মধাকর্ষণ শক্তির দ্বিগুণ বৃদ্ধিতে বায়ুমণ্ডলের বিশাল উচ্চতা মারাত্মক রকম হ্রাস পেতো এবং প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে এই বায়ুমণ্ডলের চাপ ১৫ থেকে ৩০ পাউন্ড বেড়ে যেতো। ফলে প্রাণিজগতের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতো। শীতপ্রধান এলাকা যেমন অত্যদিক পরিমাণে বৃদ্ধি পেতো, তেমনই প্রাণীর বসবাসযোগ্য অঞ্চলের পরিমাণ ভয়ানক পরিমাণে হ্রাস পেতো। যার ফলে আজকের সমাজবদ্ধ মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তো। ভ্রমণ অথবা যোগাযোগ-ব্যবস্থা দুঃসাধ্য হয়ে পড়তো। 
.
আমাদের এই পৃথিবীর ঘনত্ব অপরিবর্তিত থেকে আয়তন যদি সূর্যের সমান হোতো, তাহলে মধ্যাকর্ষণ শক্তি ১৫০ গুণ বৃদ্ধি পেতো। বায়ুমণ্ডলের উচ্চতা কমতে কমতে চার মাইলে এসে ঠেকতো। পানির বাষ্পীভবন অসম্ভব হয়ে যেতো, এবং প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে বায়ুমণ্ডলের চাপ এক টনের বেশি হোতো। ফলে এক পাউন্ড একটি প্রাণীর ওজন দাঁড়াতো ১৫০ পাউন্ড। এবং এও বলা যেতে পারে যে, মানুষের আকার ছোটো হতে হতে একেবারে কাঠবিড়ালীর সমান হয়ে যেতো। তখন এত ক্ষুদ্র মানুষের পক্ষে আর ক্রিয়েটিভ কাজ করা সম্ভব হোতো না। 
.
পৃথিবী সূর্য থেকে যতটুকু দূরে আছে, তার থেকে দ্বিগুণ দূরে সরিয়ে নিলে, পৃথিবীর উত্তাপ বর্তমান উত্তাপের চেয়ে এক চতুর্থাংশ কমে যেত। ফলে পৃথিবীর বার্ষিক গতিবেগ অর্ধেক হয়ে যেতো। যার কারণে শীতকালে তাপমাত্রা বর্তমান সময়ের থেকে দ্বিগুণ বেড়ে যেতো এবং পৃথিবীর সব প্রাণী ঠাণ্ডায় বরফে পরিণত হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতো। পৃথিবীর সৌর দূরত্ব যদি অর্ধেক হোতো, তাহলে সূর্য থেকে পৌঁছনো তাপ বর্তমান সময়ের চেয়ে চারগুণ বেড়ে যেতো। নিজ কক্ষপথে পৃথিবীর গতিবেগ দ্বিগুণ হোতো। প্রতিটি ঋতুকাল অর্ধেক হয়ে যেতো। যদি কোনো কারণে এই পরিবর্তনকে প্রশমিত করা যেতো, তবুও তাপের তীব্রতার কারণে পৃথিবীতে প্রাণীর জীবন ধারণ করা অসম্ভব হয়ে পড়তো। 
.
প্রোটিন প্রতিটি জীবন্ত কোষের অপরিহার্য উপাদান। এর মূল উপাদান হলো, কার্বন, অক্সিজেন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন, সালফার, ফসফরাস। যার মলিকুলার ওয়েট কমপক্ষে ৫০০০। এর একেকটি অণুতে ৪০০০০ পরমাণু থাকে। একটি মাত্র আমিষ অণু সৃষ্টি করার জন্যে যে পরিমাণ পদার্থ নাড়াচাড়ার প্রয়োজন আছে, তার পরিমাণ সমগ্র বিশ্বের পদার্থের পরিমাণ অপেক্ষা লক্ষ কোটি গুণ বেশি। আর এই পৃথিবীতে একটি প্রোটিন অণু তৈরি হতে লক্ষ কোটি বছরের প্রয়োজন হবে। 
.
অ্যামাইনো এসিড থেকে সুদীর্ঘ প্রক্রিয়ায় প্রোটিন সৃষ্টি হয়। যেভাবে এই প্রক্রিয়া একত্রে সন্নিবেশিত হয়েছে, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি কোনো কারণে একটি প্রক্রিয়ার একটুখানি ব্যতিক্রম হয়, তাহলে তা আর প্রোটিনে পরিণত হতে পারবে না। প্রফেসর জে.বি. লেথস (ইংল্যান্ড) হিসেব করে দেখেছেন, একটি ক্ষুদ্র প্রোটিন অণু সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় যে যোগসূত্র আছে, তা লক্ষ লক্ষ উপায়ে একত্রিত করা যেতে পারে। কিন্তু প্রোটিন উপাদানের একটিমাত্র অণু সৃষ্টি করার জন্যে এসব প্রক্রিয়ায় যুগপৎ মিলন ঘটানো সসম্ভব ব্যাপার। 
.
রাসায়নিক পদার্থ হিসেবে আমিষ প্রাণহীন। যখন এরা প্রাণীদেহে প্রবেশ করে তখন এরা রহস্যজনকভাবে জীবিত হয়। এরূপ একটি অণু প্রাণের যে আধার হতে পারে, তা প্রত্যক্ষ করার ক্ষমতা একমাত্র অনন্ত অসীম স্রষ্টার পক্ষেই সম্ভব। একমাত্র অসীম স্রষ্টাই পারেন এই অণু সৃষ্টি করতে এবং জীবন্ত রাখতে। 
.
প্রফেসর ড. ফ্যাংক অ্যালেন 
সাবেক অধ্যাপক, ম্যানিটোবা বিশ্ববিদ্যালয় (কানাডা)
গোল্ড মেডেলিস্ট, (রয়েল সোসাইটি অব কানাডা)
.
.
তথ্যসূত্র : চল্লিশজন সেরা বিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে আল্লাহর অস্তিত্ব, পৃষ্ঠা : 20-24; (John Clover Monsma সম্পাদিত ‘The Evidence of God in Expanding Universe’ বইয়ের বাংলা অনুবাদ)। [ঈষৎ সম্পাদিত]

No comments

Note: Only a member of this blog may post a comment.

Powered by Blogger.