স্রষ্টা কেন এত ধর্ম পাঠিয়েছেন? জাকারিয়া মাসুদ
স্রষ্টা কেন এত ধর্ম পাঠিয়েছেন?
লেখকঃ জাকারিয়া মাসুদ
.
যদি স্রষ্টা একজনই হন তবে, তিনি কেন একাধিক ধর্ম পাঠিয়েছেন? আর যদি স্রষ্টা একটি মাত্র ধর্ম পাঠিয়ে থাকেন, তবে স্রষ্টার মনোনীত সেই ধর্ম কোনটি?
হুমায়ুন আজাদ তার লিখনীর মাধ্যমে অল্পজ্ঞানী মানুষদেরকে বিভ্রান্ত করার কিছুটা ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন—যদি স্রষ্টা একজনই হন, তবে তিনি কেন একাধিক ধর্ম পাঠিয়েছেন? কেন একটি ধর্ম পাঠালেন না? তিনি বলেন, “বহু ধর্ম রয়েছে পৃথিবীতে। একটি সরল প্রশ্ন জাগতে পারে যে বিধাতা যদি থাকেন তিনি যদি একলাই স্রষ্টা হন, তবে তিনি কেনো এতো ধর্ম পাঠালেন। তিনি একটি ধর্ম পাঠালেই পারতেন, এবং আমরা পরম বিশ্বাসে সেটি পালন করতাম। তিনি তা করেন নি কেনো?” [হুমায়ুন আজাদ, আমার অবিশ্বাস, পৃষ্ঠা : ১৪৩]
.
তার এই অভিযোগের বিষয়ে আমাদের সরল কথা এটাই, স্রষ্টা পৃথিবীর শুরু থেকে আজ অবধি একটি মাত্র ধর্মই মানব জাতির জন্যে নির্বাচিত করেছেন। আর তা হলো—‘ইসলাম’। স্রষ্টার মনোনীত দ্বীনের মৌলিক বিষয়বস্তু যুগে যুগে একই ছিলো। কিন্তু শরীয়ার প্রকৃতি ছিলো কিছুটা ভিন্ন। প্রশ্ন জাগতে পারে—মৌলিক বিষয় একই ছিলো, কিন্তু শরীয়ার প্রকৃতি কেন ভিন্ন ছিলো?
এই প্রশ্নের উত্তর হলো, আদিম সমাজ থেকে আধুনিক সমাজ তৈরি হতে অনেকটা সময় লেগেছে। এটা এমনি এমনি হয়নি। আমাদের আসবাবপত্র, বাসস্থান, যানবাহনসহ বিশ্বের যত চমকপ্রদ পরিবর্তন, তা তৈরি হতে সময় লেগেছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী এর পেছনে ব্যয়িত হয়েছে। আদিম সমাজ এতটা উন্নত ছিলো না। সে সময়ে কেউ গুহায় বসবাস করেছে, কেউ কেউ গাছের পাতা পরিধান করেছে, কেউবা আগুনে ঝলসিয়ে মাংস ভক্ষণ করেছে।
.
এক এক নবীদের সময়ে এক এক শরীয়ার প্রকৃতি থাকার কারণ হলো, তাদের সময়কার সার্বিক পরিস্থিতি। যে ধরণের হুকুম পালন করা সমসাময়িক মানুষদের জন্যে সহজসাধ্য ছিলো, সেটিই সে সময়ের শরীয়া হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। তাই এক এক নবীর শরীয়ার প্রকৃতি এক এক রকম ছিলো। কিন্তু শরীয়ার প্রকৃতি ভিন্ন ভিন্ন হলেও সকল সময়ে জন্যে স্রষ্টার প্রণীত মৌলিক বিধান একই ছিলো। এই সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, “আল্লাহর ইবাদত করার জন্যে ও তাগুতকে বর্জন করার নির্দেশ দেওয়ার জন্যেই, আমি প্রত্যেক জাতির মধ্যে রাসূল পাঠিয়েছি।” [সূরা আন-নাহল : ৩৬ আয়াত]
.
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, “আমি তোমার পূর্বে এমন কোনো রাসূল প্রেরণ করিনি তার প্রতি এই ওহী ব্যতীত যে, আমি ছাড়া কোনো ইলাহ নাই। সুতরাং আমার ইবাদত করো।” [সূরা আল-আম্বিয়া : ২৫ আয়াত]
.
আল্লাহ তাআলা অন্যত্র আরও বলেন, “তিনি (স্রষ্টা) তোমাদের জন্যে সেই দ্বীন নির্ধারিত করেছেন, যা তিনি নূহকে নির্দেশ দিয়েছেন এবং যা আমি আপনার প্রতি ওহীর মাধ্যমে প্রেরণ করেছি। আর আমি ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে যে নির্দেশ দিয়েছিলাম তা হলো—তোমরা দ্বীন কায়েম করবে এবং এতে বিচ্ছিন্ন হবে না।” [সূরা আশ-শুরা : ১৩ আয়াত]
.
মহান স্রষ্টার এসব আয়াত আমাদের সামনে পরিষ্কার করে দিচ্ছে, স্রষ্টার প্রণীত ধর্ম যুগে যুগে একই ছিলো। যে ধর্মের প্রধান আহ্বান ছিলো—তাগুতকে অস্বীকার করা, আর আল্লাহ তাআলা ব্যতীত কোনো ইলাহ নাই এই কথার সাক্ষ্য দেওয়া। আল্লাহ তাআলার বিধানের সামনে নিজেকে সমর্পণ করে মুসলিম হয়ে যাওয়া।
.
আমাদের স্রষ্টা যুগে যুগে বিভিন্ন কওমের জন্যে বিভিন্ন নবী ও রাসূলদের প্রেরণ করেছেন। নবী-রাসূল প্রেরণ করার ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেন, “সকল মানুষ একই জাতি সত্তার অন্তর্ভুক্ত ছিলো। অতঃপর আল্লাহ পয়গম্বর পাঠালেন সুসংবাদদাতা ও ভীতি প্রদর্শনকরী হিসেবে। আর তাঁদের সাথে অবর্তীর্ণ করলেন সত্য কিতাব, যাতে মানুষের মাঝে বিতর্কমূলক বিষয়ে মীমাংসা করতে পারেন। বস্তুত কিতাবের ব্যাপারে অন্য কেউ মতভেদ করেনি। কিন্তু পরিষ্কার নির্দেশ এসে যাবার পর নিজেদের পারস্পরিক বিদ্বেষবশ তারাই করেছে, যারা কিতাব প্রাপ্ত হয়েছিলো। অতঃপর আল্লাহ ঈমানদারদেরকে হেদায়েত করেছেন সেই সত্য বিষয়ে, যে ব্যাপারে তারা মতভেদে লিপ্ত হয়েছিলো। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সরল পথ বাতলে দেন।” [সূরা আল-বাকারাহ : ২৩১ আয়াত]
.
এই আয়াত থেকে আমরা বুঝতে পারি, আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে তাঁর বান্দাদের সঠিক পথ চেনানোর জন্যে নবী রাসূলদেরকে প্রেরণ করেছেন। আসমানী কিতাব নাযিল করেছেন। এসব আসমানী গ্রন্থে তিনি তৎকালীন সময়ের সমস্যার সমাধান দিয়েছেন। সকল আসমানী গ্রন্থ ও নবীর নাম আমাদের জানা নেই। তবে আল্লাহ তাআলা কোরআন কারীমে ২৫ জন নবীর নাম উল্লেখ করেছেন। কোরআনে উল্লেখিত নবীদের নামগুলো হলো—আদম, ইদরিস, নূহ, হুদ, সালিহ, ইবরাহীম, লূত, ঈসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব, ইউসুফ, আইয়ূব, শুয়াইব, মূসা, হারুন, ইউনুস, দাউদ, সুলাইমান, ইলইয়াস, ইলইয়াসা, যুলফিকল, যাকারিয়্যা, ইয়াহহিয়া, ঈসা (আ.) ও মুহাম্মাদ (স.)।
আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রেরিত নবীদের ওপর অনেক আসমানী কিতাব নাযিল করেছেন। কোরআনে তিনটি কিতাবের কথা বার বার বলা হয়েছে। ১) তাওরাত, ২) যাবূর, ৩) ইনজীল। উক্ত কিতাবত্রয় আল্লাহ তাআলা তিনজন প্রসিদ্ধ নবীকে প্রেরণ করেছিলেন।
.
(১) তাওরাত :
কোরআন থেকে আমরা জানতে পারি, আল্লাহ তাআলা তাঁর নবী মূসা (আ.)-এর ওপর তাওরাত নাযিল করেছিলেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, “অতঃপর আমি মূসাকে গ্রন্থ দিয়েছি, সৎকর্মীদের প্রতি নেয়ামতপূর্ণ করার জন্যে, প্রত্যেক বস্তুর বিশদ বিবরণের জন্যে, হোদায়াতের জন্যে এবং করুণার জন্যে। যাতে তারা স্বীয় পালনকর্তার সাথে সাক্ষাতে বিশ্বাসী হয়।” [সূরা আন‘আম : ১৫৪ আয়াত]
.
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, “আমি তাওরাত অবর্তীর্ণ করেছি। এতে ছিলো হিদায়াত ও আলো। এর মাধ্যমে ইহুদীদেরকে ফয়সালা দিতেন অনুগত নবীগণ, আল্লাহওয়ালাগণ এবং আলিমগণ। কারণ তাদেরকে আল্লাহর কিতাবের রক্ষক করা হয়েছিলো এবং এর ওপর তারা সাক্ষী ছিলো। অতএব, তোমরা মানুষকে ভয় কোরো না, আমাকে ভয় করো। আর আমার আয়াত সমূহের বিনিময়ে স্বল্প মূল্য গ্রহণ কোরো না। এবং আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তার মাধ্যমে যারা ফয়সালা করে না, তারাই কাফের।” [সূরা মায়্যিদাহ : ৪৪ আয়াত]
.
(২) যাবূর :
আল্লাহ তাআলা তাঁর নবী দাউদ (আ.)-কে যাবূর প্রদান করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, “আপনার পালনকর্তা তাদের সম্পর্কে ভালভাবে জ্ঞাত আছেন, যারা আকাশসমূহে ও ভুপৃষ্ঠে রয়েছে। আমি তো কতক পয়গম্বরকে কতক পয়গম্বরের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি এবং দাউদকে যাবূর দান করেছি।” [সূরা বনী ইসরাঈল : ৫৫ আয়াত]
.
(৩) ইনজিল :
আল্লাহ তাআলা তাঁর নবী ঈসা (আ.)-কে ইনজিল প্রদান করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, “আমি তাদের পেছনে মরিয়ম তনয় ঈসাকে প্রেরণ করেছি। তিনি পূর্ববর্তী গ্রন্থ তওরাতের সত্যায়নকারী ছিলেন। আমি তাঁকে ইঞ্জিল প্রদান করেছি। এতে হেদায়াত ও আলো রয়েছে। এটি পূর্ববতী গ্রন্থ তওরাতের সত্যায়ন করে পথ প্রদর্শন করে এবং এটি খোদাভীরুদের জন্যে হেদায়েত উপদেশবাণী।” [সূরা আল-মায়্যিদাহ : ৪৬]
.
উপর্যুক্ত আলোচনা আমাদের সামনে এই কথা পরিষ্কার করে, যুগে যুগে আল্লাহ তাআলা মানব-জাতির হিদায়েতের জন্যে কিতাব নাযিল করেছেন। সে কিতাবগুলোর প্রত্যেকটির বক্তব্য ছিলো—সকল কিছুর গোলামী থেকে নিজেকে মুক্ত করে, এক আল্লাহর বিধানের সামনে নিজের ইচ্ছাকে সমর্পণ করে মুসলিম হয়ে যাওয়া। যত মানরচিত বিধান আছে তা দূরে ঠেলে, মহান আল্লাহর বিধানের মাধ্যমে জীবন পরিচালনা করা।
.
এখন আরেকটি প্রশ্ন জাগতে পারে, যদি যুগে যুগে আল্লাহ তাআলা আসমানী কিতাব নাযিল করে থাকেন, তবে সেগুলোর যে-কোনো একটি অনুসরণ করলেই তো হিদায়াতের রাস্তা পাওয়া সম্ভব। আমাদের কেনো শুধুমাত্র কোরআন অনুসরণ করতে হবে? বিষয়টা আমরা কিছুটা পরিষ্কার করার চেষ্টা করবো ইন শা আল্লাহ। আমাদের কেবলমাত্র কোরআনকেই অনুসরণ করার কারণ প্রধানত ৩ টি।
(১) আল কোরআন ব্যতীত অন্যান্য ধর্ম গ্রন্থ গুলোর বিকৃতি সাধন।
(২) মহান স্রষ্টা কর্তৃক আল-কোরআন সংরক্ষনের ওয়াদা।
(৩) কোরআন সর্বশেষ নবী (স.)-এর ওপর নাযিল হওয়ার কারণে।
.
(১) আল কোরআন ব্যতীত অন্যান্য ধর্ম গ্রন্থ গুলোর বিকৃতি সাধন :
আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে আসমানী কিতাব পাঠিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু প্রবৃত্তি পূজারিরা তাদের স্বার্থকে টিকিয়ে রাখতে—আল্লাহ তাআলা প্রদত্ত কিতাবকে বিকৃত, সংযোজন, বিয়োজন সাধন করেছে। আল্লাহর কিতাবের মধ্যে নিজেদের মতামত ঢুকিয়ে দিয়েছে। তাই এই সকল আসমানী কিতাবের বিশুদ্ধতা বজায় নেই। এগুলোতে আল্লাহ তাআলা ও মানুষের বানানো কথার সংমিশ্রণ রয়েছে। সেখান থেকে কোনটা সৃষ্টিকর্তার কথা আর কোনটি মানুষের কথা, তা আলাদা করার সুযোগ নেই। আল্লাহ তাআলা তাদের বলেন, “হে মুসলমানগণ! তোমরা কি আশা কর যে, তারা তোমাদের কথায় ঈমান আনবে? তাদের মধ্যে একদল ছিলো, যারা আল্লাহর বাণী শ্রবণ করত; অতঃপর বুঝে-শুনে তা পরিবর্তন করে দিত এবং তারা তা অবগত ছিলো।” [সূরা বাকারাহ : ৭৫ আয়াত]
.
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, “অতএব তাদের জন্যে আফসোস! যারা নিজ হাতে গ্রন্থ লেখে এবং বলে, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ-যাতে এর বিনিময়ে সামান্য অর্থ গ্রহণ করতে পারে। অতএব তাদের প্রতি আক্ষেপ, তাদের হাতের লেখার জন্যে এবং তাদের প্রতি আক্ষেপ, তাদের উপার্জনের জন্যে।” [সূরা কারারাহ :৭৯ আয়াত]
.
মহান আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেন, “আর তাদের মধ্যে একদল রয়েছে, যারা বিকৃত উচ্চারণে মুখ বাঁকিয়ে কিতাব পাঠ করে, যাতে তোমরা মনে কর যে, তার কিতাব থেকেই পাঠ করছে। অথচ তারা যা আবৃত্তি করছে তা আদৌ কিতাব নয়। এবং তারা বলে যে, এসব কথা আল্লাহর তরফ থেকে আগত। অথচ এসব আল্লাহর তরফ থেকে প্রেরিত নয়। তারা বলে যে, এটি আল্লাহর কথা। অথচ এসব আল্লাহর কথা নয়। আর তারা জেনে শুনে আল্লাহরই প্রতি মিথ্যারোপ করে।” [সূরা আলি-ইমরান : ৭৮ আয়াত]
.
তাদের বিকৃতির একটি নমুনা লক্ষ করুন : ইয়াহুদিরা দাবি করত যে, উটের গোশত হারাম। অথচ এই বিধানটি আল্লাহ তাআলা তাদের তাওরাতে প্রদান করেননি। আল্লাহ তাআলা এই সব মিথ্যাবাদীদের লক্ষ্য করে বলেন, “তওরাত নাযিল হওয়ার পূর্বে ইয়াকুব যেগুলো নিজেদের জন্যে হারাম করে নিয়েছিলেন, সেগুলো ব্যতীত সমস্ত আহার্য বস্তুই বনী-ইসরায়ীলদের জন্যে হালাল ছিলো। তুমি বলে দাও, তোমরা যদি সত্যবাদী হয়ে থাকো তাহলে তওরাত নিয়ে এসো এবং তা পাঠ করো।” [সূরা আলি-ইমরান : ৯৩ আয়াত]
.
(২) মহান স্রষ্টা কর্তৃক কোরআন সংরক্ষনের ওয়াদা :
আল্লাহ তাআলা অন্য কোনো কিতাবকে কিয়ামত পর্যন্ত সংরক্ষণ করে রাখবেন বলে ওয়াদা করেননি। পূর্ববর্তী সময়ে যতগুলো আসমানী কিতাব এসেছিলো, মানুষ সবগুলোরই বিকৃতি সাধন করেছে। তাই এগুলো থেকে মানবজাতির হিদায়াতের পথ খোঁজে পাওয়া অসম্ভব। কিন্তু কোরআন হলো এর ব্যতিক্রম। আল্লাহ তাআলা কোরআনের বেলায় এই ওয়াদা প্রদান করেছেন যে, তিনি এই কিতাবকে সংরক্ষন করে রাখবেন। তিনি বলেন, “আমি এ উপদেশ গ্রন্থ অবতারণ করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক।” [সূরা আল-হিজর : ৯ আয়াত]
.
এখানে একটি বিষয় ক্লিয়ার করে নেওয়া প্রয়োজন—কেন আল্লাহ অন্যান্য ধর্ম গ্রন্থগুলো বিকৃতির হাত থেকে রক্ষা করলেন না? আসলে এর জবাব ওপরেই রয়েছে। অন্যান্য ধর্ম গ্রন্থগুলো নাযিল হয়েছিলো নির্দিষ্ট একটি সময়ের জন্যে। অন্যান্য কোনো ধর্মগ্রন্থই কিয়ামত পর্যন্ত মানুষের জীবন-বিধান হিসেবে পাঠানো হয়নি। যখন সেগুলো কোনো নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে প্রেরিত হয়েছে, তখন তার বিশুদ্ধতা রক্ষা করার কী প্রয়োজনীয়তা আছে? আর যখন সে সময়ও গত হয়ে গেছে, এবং সে সকল কিতাব রহিতকারী কোরআন নাযিল হয়েছে, তখন সেগুলোর কীই-বা দরকার আছে?
.
(৩) সর্বশেষ নবী (স.)-এর ওপর নাযিল হওয়ার কারণে :
আমরা যদি তর্কের খাতিরে মেনেও নিই যে, পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবগুলো বিকৃত হয়নি; তবুও আমাদের জন্যে ওগুলো মানা ফরয নয়। কেননা পূর্বের ধর্মগ্রন্থগুলো ছিলো তৎকালীন সময়ের জন্যে, তৎকালীন জাতির জন্যে। যখন সেই সময় ও সেই জাতি বিলীন হয়ে গেছে, তখন আর ওইসব ধর্মগ্রন্থের কী প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে? কোরআন কারীমের পূর্বে যে ধর্মগ্রন্থগুলো নাযিল হয়েছিলো, সেগুলোতে তৎকালীন জনগোষ্ঠীর বুদ্ধিবৃত্তি ও মানসিক বৈশিষ্টের ওপর লক্ষ রাখা হয়েছে। আর তাদের ধর্মগ্রন্থগুলোতে সমসাময়িক সমস্যার সমাধান প্রদান করা হয়েছিলো।
.
কিন্তু আল কোরআন কোনো নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে অবতীর্ণ হয়নি। যেহেতু কিয়ামত পর্যন্ত মানুষের জীবন-ব্যবস্থা হিসেবে কোরআন পাঠানো হয়েছে, তাই এই কিতাবে কিয়ামত পর্যন্ত সকল সমস্যার সমাধান রয়েছে। আর মুহাম্মাদ (স.)-এর পূর্বে আর কোন নবীই তার ওপর অবতীর্ণ কিতাবের সর্বজনীনতা দাবি করেননি। বরং নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মানুষ ছাড়া তার কিতাব বা ধর্ম প্রচার করতে নিষেধ করেছেন। এজন্যে আপনিও দেখবেন ইসলাম ছাড়া অধিকাংশ প্রচলিত ধর্মই তাদের ধর্মকে সর্বজনীন বলে দাবি করে না। বর্তমানকালে খৃষ্টানগণ তাদের ধর্মকে সর্বজনীন বলে দাবি করে থাকে। অথচ তাদের তাদের মধ্যে বিদ্যমান বাইবেলে যিশু বার বার উল্লেখ করেছেন যে, তিনি কেবলমাত্র বনী ইসরাইলদের জন্য নবী হিসেবে প্রেরিত হয়েছেন। অন্য কোনো গোত্রের জন্য নয়। (মথি : ১০/৬, ১৫/২২,২৪,২৫,২৬)।
.
তাই আমাদের জীবন পরিচালনার একমাত্র মাধ্যম হবে—কোরআন এবং কোরআন যে দ্বীনকে স্বীকৃতি প্রদান করেছে, সে দ্বীন। আর কোরআন কেবলমাত্র একটি মাত্র দ্বীনকে স্বীকৃতি প্রদান করেছে; আর তা হলো ‘ইসলাম’। কোরআন বলছে, “আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্নাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম।” [সূরা আল-মায়্যিদাহ : ০৩ আয়াত]
.
আজাদ তার বইতে এ কথাও বলেছেন যে, প্রতিটি ধর্মই নিজেকে নতুন বলে দাবি করে। আর মক্কার প্রচলিত ধর্ম থেকেই না কি ক্রমান্বয়ে ইসলাম বিকশিত হয়! । তিনি বলেন, “তবে প্রতিটি ধর্মই নিজেকে নতুন বলে দাবি করে...মক্কায় প্রচলিত পৌত্তলিক আরবদের ধর্ম থেকে বিকশিত হয় ইসলাম।” [আমার অবিশ্বাস, পৃষ্ঠা : ৯৬]
.
আমরা আমাদের আলোচনার দ্বারা বুঝিয়েছি যে, ইসলাম কখনওই নিজেকে নতুন বলে দাবি করেনি। বরং ইসলাম বার বার উল্লেখ করেছে, এই দ্বীন পূর্ববর্তী নবীগণেরই দ্বীন। তাঁরা যে দ্বীন প্রচার করেছেন, সেই দ্বীন। তারা যে কথার দাওয়াত দিয়েছেন, ইসলামও ঠিক একই কথার দাওয়াত দেয়। আল্লাহ তাআলা মুহাম্মাদ (স.)-কে লক্ষ্য করে বলেন, “অতঃপর আপনার প্রতি প্রত্যাদেশ প্রেরণ করেছি যে, ইবরাহীমের দ্বীন অনুসরণ করুন, যিনি একনিষ্ঠ ছিলেন এবং শিরককারীদের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন না। [সূরা আন নাহল : ১২৩ আয়াত]
.
ইসলাম শব্দটি আরবী ‘সালাম’ শব্দ থেকে গৃহীত। এর অর্থ শান্তি, নিরাপত্তা, সমর্পণ ইত্যাদি। ইসলাম শব্দের অর্থ আত্মসমর্পণ করা, অনুগত হওয়া ইত্যাদি। আর মুসলিম বলা হয় যারা ইসলামকে মেনে চলে। অর্থাৎ নিজের ইচ্ছাকে স্রষ্টার ইচ্ছার সামনে যে সমর্পণ করে, সে-ই হলো মুসলিম। [ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকিদা, পৃষ্ঠা : ২৪]
.
আর যুগে যুগে প্রত্যেক নবীই মুসলিম ছিলেন। সকল নবীই ইসলাম ধর্মের প্রচারক ছিলেন। যেমন আল্লাহ তায়ালা তার নবী ইবরাহীম (আ.) সম্পর্কে বলেন, “ইবরাহীম ইহুদী ছিলেন না এবং নাসারাও ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন ‘হানীফ’ (অর্থাৎ, সব মিথ্যা ধর্মের প্রতি বিমুখ এবং মুসলিম), এবং তিনি মুশরিক ছিলেন না।” [সূরা আলি ইমরান : ৬৭ আয়াত]
.
আজাদ বলেছেন যে, মক্কার প্রচলিত মুশরিকদের ধর্ম বিশ্বাস থেকে বিকশিত হয় ইসলাম। অথচ আমরা কোরআনের সুস্পষ্ট ঘোষণাতে দেখতে পাই যে, কোনো নবীই মুশরিকদের অনুসারী ছিলেন না। মুশরিকদের কর্মের সমর্থনদাতা ছিলেন না। সবাই শিরকের বিরোধিতা করেছেন। আমরা এও জানি যে, ইসলাম এসে মক্কার পৌত্তলিকদের সকল জাহিলী বিধানকে বাতিল ঘোষণা করে। জাহিলী যুগের মূর্তিপূজা, রক্তপাত, নারীদের প্রতি অবিচার, মদ, জুয়া, কন্যাশিশু হত্যা, পারস্পরিক বিবাদ, উলঙ্গপনা বেহায়াপনা ইত্যাদি সকল কিছুকে চিরতরে নিঃশেষ করে দেয়।
.
মহানবী (স.) বিদায় হজ্জের ভাষণে মুসলিম জাতিকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “তোমাদের রক্ত এবং ধন সম্পদ পরস্পরের জন্য আজকের দিন, বর্তমান মাস এবং বর্তমান শহরের মতই নিষিদ্ধ। শোনো, জাহিলী যুগের সব কিছু আমার পদতলে পিষ্ট করা হয়েছে। জাহিলিয়াতের খুনও খতম করে দেয়া হয়েছে।” [মুবারকপুরী, শফিউর রহমান, আর রাহীকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা : ৪৯৭]
.
তাই ইসলাম মক্কার পৌত্তিকদের কাছ থেকে বিকশিত হয়েছে, এই দাবি আমাদের কাছে বেশ হাস্যকর।
.
বই : ভ্রান্তিবিলাস
লেখকঃ জাকারিয়া মাসুদ
.
যদি স্রষ্টা একজনই হন তবে, তিনি কেন একাধিক ধর্ম পাঠিয়েছেন? আর যদি স্রষ্টা একটি মাত্র ধর্ম পাঠিয়ে থাকেন, তবে স্রষ্টার মনোনীত সেই ধর্ম কোনটি?
হুমায়ুন আজাদ তার লিখনীর মাধ্যমে অল্পজ্ঞানী মানুষদেরকে বিভ্রান্ত করার কিছুটা ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন—যদি স্রষ্টা একজনই হন, তবে তিনি কেন একাধিক ধর্ম পাঠিয়েছেন? কেন একটি ধর্ম পাঠালেন না? তিনি বলেন, “বহু ধর্ম রয়েছে পৃথিবীতে। একটি সরল প্রশ্ন জাগতে পারে যে বিধাতা যদি থাকেন তিনি যদি একলাই স্রষ্টা হন, তবে তিনি কেনো এতো ধর্ম পাঠালেন। তিনি একটি ধর্ম পাঠালেই পারতেন, এবং আমরা পরম বিশ্বাসে সেটি পালন করতাম। তিনি তা করেন নি কেনো?” [হুমায়ুন আজাদ, আমার অবিশ্বাস, পৃষ্ঠা : ১৪৩]
.
তার এই অভিযোগের বিষয়ে আমাদের সরল কথা এটাই, স্রষ্টা পৃথিবীর শুরু থেকে আজ অবধি একটি মাত্র ধর্মই মানব জাতির জন্যে নির্বাচিত করেছেন। আর তা হলো—‘ইসলাম’। স্রষ্টার মনোনীত দ্বীনের মৌলিক বিষয়বস্তু যুগে যুগে একই ছিলো। কিন্তু শরীয়ার প্রকৃতি ছিলো কিছুটা ভিন্ন। প্রশ্ন জাগতে পারে—মৌলিক বিষয় একই ছিলো, কিন্তু শরীয়ার প্রকৃতি কেন ভিন্ন ছিলো?
এই প্রশ্নের উত্তর হলো, আদিম সমাজ থেকে আধুনিক সমাজ তৈরি হতে অনেকটা সময় লেগেছে। এটা এমনি এমনি হয়নি। আমাদের আসবাবপত্র, বাসস্থান, যানবাহনসহ বিশ্বের যত চমকপ্রদ পরিবর্তন, তা তৈরি হতে সময় লেগেছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী এর পেছনে ব্যয়িত হয়েছে। আদিম সমাজ এতটা উন্নত ছিলো না। সে সময়ে কেউ গুহায় বসবাস করেছে, কেউ কেউ গাছের পাতা পরিধান করেছে, কেউবা আগুনে ঝলসিয়ে মাংস ভক্ষণ করেছে।
.
এক এক নবীদের সময়ে এক এক শরীয়ার প্রকৃতি থাকার কারণ হলো, তাদের সময়কার সার্বিক পরিস্থিতি। যে ধরণের হুকুম পালন করা সমসাময়িক মানুষদের জন্যে সহজসাধ্য ছিলো, সেটিই সে সময়ের শরীয়া হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। তাই এক এক নবীর শরীয়ার প্রকৃতি এক এক রকম ছিলো। কিন্তু শরীয়ার প্রকৃতি ভিন্ন ভিন্ন হলেও সকল সময়ে জন্যে স্রষ্টার প্রণীত মৌলিক বিধান একই ছিলো। এই সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, “আল্লাহর ইবাদত করার জন্যে ও তাগুতকে বর্জন করার নির্দেশ দেওয়ার জন্যেই, আমি প্রত্যেক জাতির মধ্যে রাসূল পাঠিয়েছি।” [সূরা আন-নাহল : ৩৬ আয়াত]
.
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, “আমি তোমার পূর্বে এমন কোনো রাসূল প্রেরণ করিনি তার প্রতি এই ওহী ব্যতীত যে, আমি ছাড়া কোনো ইলাহ নাই। সুতরাং আমার ইবাদত করো।” [সূরা আল-আম্বিয়া : ২৫ আয়াত]
.
আল্লাহ তাআলা অন্যত্র আরও বলেন, “তিনি (স্রষ্টা) তোমাদের জন্যে সেই দ্বীন নির্ধারিত করেছেন, যা তিনি নূহকে নির্দেশ দিয়েছেন এবং যা আমি আপনার প্রতি ওহীর মাধ্যমে প্রেরণ করেছি। আর আমি ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে যে নির্দেশ দিয়েছিলাম তা হলো—তোমরা দ্বীন কায়েম করবে এবং এতে বিচ্ছিন্ন হবে না।” [সূরা আশ-শুরা : ১৩ আয়াত]
.
মহান স্রষ্টার এসব আয়াত আমাদের সামনে পরিষ্কার করে দিচ্ছে, স্রষ্টার প্রণীত ধর্ম যুগে যুগে একই ছিলো। যে ধর্মের প্রধান আহ্বান ছিলো—তাগুতকে অস্বীকার করা, আর আল্লাহ তাআলা ব্যতীত কোনো ইলাহ নাই এই কথার সাক্ষ্য দেওয়া। আল্লাহ তাআলার বিধানের সামনে নিজেকে সমর্পণ করে মুসলিম হয়ে যাওয়া।
.
আমাদের স্রষ্টা যুগে যুগে বিভিন্ন কওমের জন্যে বিভিন্ন নবী ও রাসূলদের প্রেরণ করেছেন। নবী-রাসূল প্রেরণ করার ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেন, “সকল মানুষ একই জাতি সত্তার অন্তর্ভুক্ত ছিলো। অতঃপর আল্লাহ পয়গম্বর পাঠালেন সুসংবাদদাতা ও ভীতি প্রদর্শনকরী হিসেবে। আর তাঁদের সাথে অবর্তীর্ণ করলেন সত্য কিতাব, যাতে মানুষের মাঝে বিতর্কমূলক বিষয়ে মীমাংসা করতে পারেন। বস্তুত কিতাবের ব্যাপারে অন্য কেউ মতভেদ করেনি। কিন্তু পরিষ্কার নির্দেশ এসে যাবার পর নিজেদের পারস্পরিক বিদ্বেষবশ তারাই করেছে, যারা কিতাব প্রাপ্ত হয়েছিলো। অতঃপর আল্লাহ ঈমানদারদেরকে হেদায়েত করেছেন সেই সত্য বিষয়ে, যে ব্যাপারে তারা মতভেদে লিপ্ত হয়েছিলো। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সরল পথ বাতলে দেন।” [সূরা আল-বাকারাহ : ২৩১ আয়াত]
.
এই আয়াত থেকে আমরা বুঝতে পারি, আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে তাঁর বান্দাদের সঠিক পথ চেনানোর জন্যে নবী রাসূলদেরকে প্রেরণ করেছেন। আসমানী কিতাব নাযিল করেছেন। এসব আসমানী গ্রন্থে তিনি তৎকালীন সময়ের সমস্যার সমাধান দিয়েছেন। সকল আসমানী গ্রন্থ ও নবীর নাম আমাদের জানা নেই। তবে আল্লাহ তাআলা কোরআন কারীমে ২৫ জন নবীর নাম উল্লেখ করেছেন। কোরআনে উল্লেখিত নবীদের নামগুলো হলো—আদম, ইদরিস, নূহ, হুদ, সালিহ, ইবরাহীম, লূত, ঈসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব, ইউসুফ, আইয়ূব, শুয়াইব, মূসা, হারুন, ইউনুস, দাউদ, সুলাইমান, ইলইয়াস, ইলইয়াসা, যুলফিকল, যাকারিয়্যা, ইয়াহহিয়া, ঈসা (আ.) ও মুহাম্মাদ (স.)।
আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রেরিত নবীদের ওপর অনেক আসমানী কিতাব নাযিল করেছেন। কোরআনে তিনটি কিতাবের কথা বার বার বলা হয়েছে। ১) তাওরাত, ২) যাবূর, ৩) ইনজীল। উক্ত কিতাবত্রয় আল্লাহ তাআলা তিনজন প্রসিদ্ধ নবীকে প্রেরণ করেছিলেন।
.
(১) তাওরাত :
কোরআন থেকে আমরা জানতে পারি, আল্লাহ তাআলা তাঁর নবী মূসা (আ.)-এর ওপর তাওরাত নাযিল করেছিলেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, “অতঃপর আমি মূসাকে গ্রন্থ দিয়েছি, সৎকর্মীদের প্রতি নেয়ামতপূর্ণ করার জন্যে, প্রত্যেক বস্তুর বিশদ বিবরণের জন্যে, হোদায়াতের জন্যে এবং করুণার জন্যে। যাতে তারা স্বীয় পালনকর্তার সাথে সাক্ষাতে বিশ্বাসী হয়।” [সূরা আন‘আম : ১৫৪ আয়াত]
.
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, “আমি তাওরাত অবর্তীর্ণ করেছি। এতে ছিলো হিদায়াত ও আলো। এর মাধ্যমে ইহুদীদেরকে ফয়সালা দিতেন অনুগত নবীগণ, আল্লাহওয়ালাগণ এবং আলিমগণ। কারণ তাদেরকে আল্লাহর কিতাবের রক্ষক করা হয়েছিলো এবং এর ওপর তারা সাক্ষী ছিলো। অতএব, তোমরা মানুষকে ভয় কোরো না, আমাকে ভয় করো। আর আমার আয়াত সমূহের বিনিময়ে স্বল্প মূল্য গ্রহণ কোরো না। এবং আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তার মাধ্যমে যারা ফয়সালা করে না, তারাই কাফের।” [সূরা মায়্যিদাহ : ৪৪ আয়াত]
.
(২) যাবূর :
আল্লাহ তাআলা তাঁর নবী দাউদ (আ.)-কে যাবূর প্রদান করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, “আপনার পালনকর্তা তাদের সম্পর্কে ভালভাবে জ্ঞাত আছেন, যারা আকাশসমূহে ও ভুপৃষ্ঠে রয়েছে। আমি তো কতক পয়গম্বরকে কতক পয়গম্বরের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি এবং দাউদকে যাবূর দান করেছি।” [সূরা বনী ইসরাঈল : ৫৫ আয়াত]
.
(৩) ইনজিল :
আল্লাহ তাআলা তাঁর নবী ঈসা (আ.)-কে ইনজিল প্রদান করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, “আমি তাদের পেছনে মরিয়ম তনয় ঈসাকে প্রেরণ করেছি। তিনি পূর্ববর্তী গ্রন্থ তওরাতের সত্যায়নকারী ছিলেন। আমি তাঁকে ইঞ্জিল প্রদান করেছি। এতে হেদায়াত ও আলো রয়েছে। এটি পূর্ববতী গ্রন্থ তওরাতের সত্যায়ন করে পথ প্রদর্শন করে এবং এটি খোদাভীরুদের জন্যে হেদায়েত উপদেশবাণী।” [সূরা আল-মায়্যিদাহ : ৪৬]
.
উপর্যুক্ত আলোচনা আমাদের সামনে এই কথা পরিষ্কার করে, যুগে যুগে আল্লাহ তাআলা মানব-জাতির হিদায়েতের জন্যে কিতাব নাযিল করেছেন। সে কিতাবগুলোর প্রত্যেকটির বক্তব্য ছিলো—সকল কিছুর গোলামী থেকে নিজেকে মুক্ত করে, এক আল্লাহর বিধানের সামনে নিজের ইচ্ছাকে সমর্পণ করে মুসলিম হয়ে যাওয়া। যত মানরচিত বিধান আছে তা দূরে ঠেলে, মহান আল্লাহর বিধানের মাধ্যমে জীবন পরিচালনা করা।
.
এখন আরেকটি প্রশ্ন জাগতে পারে, যদি যুগে যুগে আল্লাহ তাআলা আসমানী কিতাব নাযিল করে থাকেন, তবে সেগুলোর যে-কোনো একটি অনুসরণ করলেই তো হিদায়াতের রাস্তা পাওয়া সম্ভব। আমাদের কেনো শুধুমাত্র কোরআন অনুসরণ করতে হবে? বিষয়টা আমরা কিছুটা পরিষ্কার করার চেষ্টা করবো ইন শা আল্লাহ। আমাদের কেবলমাত্র কোরআনকেই অনুসরণ করার কারণ প্রধানত ৩ টি।
(১) আল কোরআন ব্যতীত অন্যান্য ধর্ম গ্রন্থ গুলোর বিকৃতি সাধন।
(২) মহান স্রষ্টা কর্তৃক আল-কোরআন সংরক্ষনের ওয়াদা।
(৩) কোরআন সর্বশেষ নবী (স.)-এর ওপর নাযিল হওয়ার কারণে।
.
(১) আল কোরআন ব্যতীত অন্যান্য ধর্ম গ্রন্থ গুলোর বিকৃতি সাধন :
আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে আসমানী কিতাব পাঠিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু প্রবৃত্তি পূজারিরা তাদের স্বার্থকে টিকিয়ে রাখতে—আল্লাহ তাআলা প্রদত্ত কিতাবকে বিকৃত, সংযোজন, বিয়োজন সাধন করেছে। আল্লাহর কিতাবের মধ্যে নিজেদের মতামত ঢুকিয়ে দিয়েছে। তাই এই সকল আসমানী কিতাবের বিশুদ্ধতা বজায় নেই। এগুলোতে আল্লাহ তাআলা ও মানুষের বানানো কথার সংমিশ্রণ রয়েছে। সেখান থেকে কোনটা সৃষ্টিকর্তার কথা আর কোনটি মানুষের কথা, তা আলাদা করার সুযোগ নেই। আল্লাহ তাআলা তাদের বলেন, “হে মুসলমানগণ! তোমরা কি আশা কর যে, তারা তোমাদের কথায় ঈমান আনবে? তাদের মধ্যে একদল ছিলো, যারা আল্লাহর বাণী শ্রবণ করত; অতঃপর বুঝে-শুনে তা পরিবর্তন করে দিত এবং তারা তা অবগত ছিলো।” [সূরা বাকারাহ : ৭৫ আয়াত]
.
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, “অতএব তাদের জন্যে আফসোস! যারা নিজ হাতে গ্রন্থ লেখে এবং বলে, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ-যাতে এর বিনিময়ে সামান্য অর্থ গ্রহণ করতে পারে। অতএব তাদের প্রতি আক্ষেপ, তাদের হাতের লেখার জন্যে এবং তাদের প্রতি আক্ষেপ, তাদের উপার্জনের জন্যে।” [সূরা কারারাহ :৭৯ আয়াত]
.
মহান আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেন, “আর তাদের মধ্যে একদল রয়েছে, যারা বিকৃত উচ্চারণে মুখ বাঁকিয়ে কিতাব পাঠ করে, যাতে তোমরা মনে কর যে, তার কিতাব থেকেই পাঠ করছে। অথচ তারা যা আবৃত্তি করছে তা আদৌ কিতাব নয়। এবং তারা বলে যে, এসব কথা আল্লাহর তরফ থেকে আগত। অথচ এসব আল্লাহর তরফ থেকে প্রেরিত নয়। তারা বলে যে, এটি আল্লাহর কথা। অথচ এসব আল্লাহর কথা নয়। আর তারা জেনে শুনে আল্লাহরই প্রতি মিথ্যারোপ করে।” [সূরা আলি-ইমরান : ৭৮ আয়াত]
.
তাদের বিকৃতির একটি নমুনা লক্ষ করুন : ইয়াহুদিরা দাবি করত যে, উটের গোশত হারাম। অথচ এই বিধানটি আল্লাহ তাআলা তাদের তাওরাতে প্রদান করেননি। আল্লাহ তাআলা এই সব মিথ্যাবাদীদের লক্ষ্য করে বলেন, “তওরাত নাযিল হওয়ার পূর্বে ইয়াকুব যেগুলো নিজেদের জন্যে হারাম করে নিয়েছিলেন, সেগুলো ব্যতীত সমস্ত আহার্য বস্তুই বনী-ইসরায়ীলদের জন্যে হালাল ছিলো। তুমি বলে দাও, তোমরা যদি সত্যবাদী হয়ে থাকো তাহলে তওরাত নিয়ে এসো এবং তা পাঠ করো।” [সূরা আলি-ইমরান : ৯৩ আয়াত]
.
(২) মহান স্রষ্টা কর্তৃক কোরআন সংরক্ষনের ওয়াদা :
আল্লাহ তাআলা অন্য কোনো কিতাবকে কিয়ামত পর্যন্ত সংরক্ষণ করে রাখবেন বলে ওয়াদা করেননি। পূর্ববর্তী সময়ে যতগুলো আসমানী কিতাব এসেছিলো, মানুষ সবগুলোরই বিকৃতি সাধন করেছে। তাই এগুলো থেকে মানবজাতির হিদায়াতের পথ খোঁজে পাওয়া অসম্ভব। কিন্তু কোরআন হলো এর ব্যতিক্রম। আল্লাহ তাআলা কোরআনের বেলায় এই ওয়াদা প্রদান করেছেন যে, তিনি এই কিতাবকে সংরক্ষন করে রাখবেন। তিনি বলেন, “আমি এ উপদেশ গ্রন্থ অবতারণ করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক।” [সূরা আল-হিজর : ৯ আয়াত]
.
এখানে একটি বিষয় ক্লিয়ার করে নেওয়া প্রয়োজন—কেন আল্লাহ অন্যান্য ধর্ম গ্রন্থগুলো বিকৃতির হাত থেকে রক্ষা করলেন না? আসলে এর জবাব ওপরেই রয়েছে। অন্যান্য ধর্ম গ্রন্থগুলো নাযিল হয়েছিলো নির্দিষ্ট একটি সময়ের জন্যে। অন্যান্য কোনো ধর্মগ্রন্থই কিয়ামত পর্যন্ত মানুষের জীবন-বিধান হিসেবে পাঠানো হয়নি। যখন সেগুলো কোনো নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে প্রেরিত হয়েছে, তখন তার বিশুদ্ধতা রক্ষা করার কী প্রয়োজনীয়তা আছে? আর যখন সে সময়ও গত হয়ে গেছে, এবং সে সকল কিতাব রহিতকারী কোরআন নাযিল হয়েছে, তখন সেগুলোর কীই-বা দরকার আছে?
.
(৩) সর্বশেষ নবী (স.)-এর ওপর নাযিল হওয়ার কারণে :
আমরা যদি তর্কের খাতিরে মেনেও নিই যে, পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবগুলো বিকৃত হয়নি; তবুও আমাদের জন্যে ওগুলো মানা ফরয নয়। কেননা পূর্বের ধর্মগ্রন্থগুলো ছিলো তৎকালীন সময়ের জন্যে, তৎকালীন জাতির জন্যে। যখন সেই সময় ও সেই জাতি বিলীন হয়ে গেছে, তখন আর ওইসব ধর্মগ্রন্থের কী প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে? কোরআন কারীমের পূর্বে যে ধর্মগ্রন্থগুলো নাযিল হয়েছিলো, সেগুলোতে তৎকালীন জনগোষ্ঠীর বুদ্ধিবৃত্তি ও মানসিক বৈশিষ্টের ওপর লক্ষ রাখা হয়েছে। আর তাদের ধর্মগ্রন্থগুলোতে সমসাময়িক সমস্যার সমাধান প্রদান করা হয়েছিলো।
.
কিন্তু আল কোরআন কোনো নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে অবতীর্ণ হয়নি। যেহেতু কিয়ামত পর্যন্ত মানুষের জীবন-ব্যবস্থা হিসেবে কোরআন পাঠানো হয়েছে, তাই এই কিতাবে কিয়ামত পর্যন্ত সকল সমস্যার সমাধান রয়েছে। আর মুহাম্মাদ (স.)-এর পূর্বে আর কোন নবীই তার ওপর অবতীর্ণ কিতাবের সর্বজনীনতা দাবি করেননি। বরং নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মানুষ ছাড়া তার কিতাব বা ধর্ম প্রচার করতে নিষেধ করেছেন। এজন্যে আপনিও দেখবেন ইসলাম ছাড়া অধিকাংশ প্রচলিত ধর্মই তাদের ধর্মকে সর্বজনীন বলে দাবি করে না। বর্তমানকালে খৃষ্টানগণ তাদের ধর্মকে সর্বজনীন বলে দাবি করে থাকে। অথচ তাদের তাদের মধ্যে বিদ্যমান বাইবেলে যিশু বার বার উল্লেখ করেছেন যে, তিনি কেবলমাত্র বনী ইসরাইলদের জন্য নবী হিসেবে প্রেরিত হয়েছেন। অন্য কোনো গোত্রের জন্য নয়। (মথি : ১০/৬, ১৫/২২,২৪,২৫,২৬)।
.
তাই আমাদের জীবন পরিচালনার একমাত্র মাধ্যম হবে—কোরআন এবং কোরআন যে দ্বীনকে স্বীকৃতি প্রদান করেছে, সে দ্বীন। আর কোরআন কেবলমাত্র একটি মাত্র দ্বীনকে স্বীকৃতি প্রদান করেছে; আর তা হলো ‘ইসলাম’। কোরআন বলছে, “আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্নাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম।” [সূরা আল-মায়্যিদাহ : ০৩ আয়াত]
.
আজাদ তার বইতে এ কথাও বলেছেন যে, প্রতিটি ধর্মই নিজেকে নতুন বলে দাবি করে। আর মক্কার প্রচলিত ধর্ম থেকেই না কি ক্রমান্বয়ে ইসলাম বিকশিত হয়! । তিনি বলেন, “তবে প্রতিটি ধর্মই নিজেকে নতুন বলে দাবি করে...মক্কায় প্রচলিত পৌত্তলিক আরবদের ধর্ম থেকে বিকশিত হয় ইসলাম।” [আমার অবিশ্বাস, পৃষ্ঠা : ৯৬]
.
আমরা আমাদের আলোচনার দ্বারা বুঝিয়েছি যে, ইসলাম কখনওই নিজেকে নতুন বলে দাবি করেনি। বরং ইসলাম বার বার উল্লেখ করেছে, এই দ্বীন পূর্ববর্তী নবীগণেরই দ্বীন। তাঁরা যে দ্বীন প্রচার করেছেন, সেই দ্বীন। তারা যে কথার দাওয়াত দিয়েছেন, ইসলামও ঠিক একই কথার দাওয়াত দেয়। আল্লাহ তাআলা মুহাম্মাদ (স.)-কে লক্ষ্য করে বলেন, “অতঃপর আপনার প্রতি প্রত্যাদেশ প্রেরণ করেছি যে, ইবরাহীমের দ্বীন অনুসরণ করুন, যিনি একনিষ্ঠ ছিলেন এবং শিরককারীদের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন না। [সূরা আন নাহল : ১২৩ আয়াত]
.
ইসলাম শব্দটি আরবী ‘সালাম’ শব্দ থেকে গৃহীত। এর অর্থ শান্তি, নিরাপত্তা, সমর্পণ ইত্যাদি। ইসলাম শব্দের অর্থ আত্মসমর্পণ করা, অনুগত হওয়া ইত্যাদি। আর মুসলিম বলা হয় যারা ইসলামকে মেনে চলে। অর্থাৎ নিজের ইচ্ছাকে স্রষ্টার ইচ্ছার সামনে যে সমর্পণ করে, সে-ই হলো মুসলিম। [ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকিদা, পৃষ্ঠা : ২৪]
.
আর যুগে যুগে প্রত্যেক নবীই মুসলিম ছিলেন। সকল নবীই ইসলাম ধর্মের প্রচারক ছিলেন। যেমন আল্লাহ তায়ালা তার নবী ইবরাহীম (আ.) সম্পর্কে বলেন, “ইবরাহীম ইহুদী ছিলেন না এবং নাসারাও ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন ‘হানীফ’ (অর্থাৎ, সব মিথ্যা ধর্মের প্রতি বিমুখ এবং মুসলিম), এবং তিনি মুশরিক ছিলেন না।” [সূরা আলি ইমরান : ৬৭ আয়াত]
.
আজাদ বলেছেন যে, মক্কার প্রচলিত মুশরিকদের ধর্ম বিশ্বাস থেকে বিকশিত হয় ইসলাম। অথচ আমরা কোরআনের সুস্পষ্ট ঘোষণাতে দেখতে পাই যে, কোনো নবীই মুশরিকদের অনুসারী ছিলেন না। মুশরিকদের কর্মের সমর্থনদাতা ছিলেন না। সবাই শিরকের বিরোধিতা করেছেন। আমরা এও জানি যে, ইসলাম এসে মক্কার পৌত্তলিকদের সকল জাহিলী বিধানকে বাতিল ঘোষণা করে। জাহিলী যুগের মূর্তিপূজা, রক্তপাত, নারীদের প্রতি অবিচার, মদ, জুয়া, কন্যাশিশু হত্যা, পারস্পরিক বিবাদ, উলঙ্গপনা বেহায়াপনা ইত্যাদি সকল কিছুকে চিরতরে নিঃশেষ করে দেয়।
.
মহানবী (স.) বিদায় হজ্জের ভাষণে মুসলিম জাতিকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “তোমাদের রক্ত এবং ধন সম্পদ পরস্পরের জন্য আজকের দিন, বর্তমান মাস এবং বর্তমান শহরের মতই নিষিদ্ধ। শোনো, জাহিলী যুগের সব কিছু আমার পদতলে পিষ্ট করা হয়েছে। জাহিলিয়াতের খুনও খতম করে দেয়া হয়েছে।” [মুবারকপুরী, শফিউর রহমান, আর রাহীকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা : ৪৯৭]
.
তাই ইসলাম মক্কার পৌত্তিকদের কাছ থেকে বিকশিত হয়েছে, এই দাবি আমাদের কাছে বেশ হাস্যকর।
.
বই : ভ্রান্তিবিলাস
No comments
Note: Only a member of this blog may post a comment.