বিয়ের পরে একদিন / আরিফ আজাদ
বিয়ের পরে একদিন
আরিফ আজাদ
বিয়ের পরে ছেলেরা আসলে বিন্দাস জীবন কাটায়। তার স্বাভাবিক জীবনে খুব একটা অস্বাভাবিকতা নেমে আসেনা। সে আগের মতোই অফিস করে। আগের মতোই বাসায় আসে। বৃষ্টির দিনে বারান্দায় বসে কফি খায়। খায়-দায়-ঘুমোয়। তার রোজকার জীবনের রুটিনে কোনোরকম ব্যত্যয় ঘটেনা। বরঞ্চ বলা চলে, তার জীবনটা বিয়ের পরে আরো সহজ হয়ে উঠে। স্ত্রীর ভালোবাসা, যত্ন আর পারস্পরিক বোঝাপড়াতে তার জীবন হয়ে উঠে মুখরিত। এমনটাই অবশ্য হওয়া উচিত।
অন্যদিকে, বিয়ের প্রথমদিকের সময়ে একটা মেয়ের জীবন কিন্তু খুব একটা স্বাভাবিক থাকেনা। প্রথমত নিজের পরিবার-পরিজন, মা-বাবা-ভাই-বোনদের ছেড়ে আসার ধাক্কা সামলাতে হয়। তারপর, নতুন সংসারে এসে নতুন নতুন মানুষগুলোকে বুঝে নিতে গিয়ে বেশ হিমশিম খেতে হয় তাকে। নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য তাকে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হয়।
একটা মেয়েকে বুঝে নিতে হয় তার স্বামীর দায়িত্ব। দায়িত্ব বলতে স্বামীর আনুগত্যের ব্যাপারটাই মুখ্য। স্বামীর পছন্দ-অপছন্দ, ভালো লাগা- খারাপ লাগা ইত্যাদি সম্পর্কে তাকে সম্যক অবহিত থাকতে হয়। তাকে খেয়াল রাখতে হয় তার শ্বশুর শাশুড়ির দিকে। স্বামীর পরিবারের সদস্যগুলোকে বুঝে নিতে, তাদের সাথে মানিয়ে নিতে গিয়ে মেয়েটাকে যে কি এক পরীক্ষার ভিতর দিয়ে যেতে হয়!
একটা মেয়ে বিয়ের পরে দু'ধরণের সমস্যার মুখোমুখি হতে পারে। প্রথমত, যদি শ্বাশুড়ির সাথে বনিবনা না হয়। দ্বিতীয়ত, যদি স্বামীর সাথে বোঝাপড়ার অভাব থাকে।
অধিকাংশ মেয়েরাই প্রথম সমস্যাটার মুখোমুখি হয় বেশি। শ্বাশুড়ির সাথে বনিবনা না হওয়ার অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে। কারণগুলো শাশুড়ির দিক থেকে যেমন হতে পারে, আবার হতে পারে মেয়েটার দিক থেকেও।
আমাদের বাঙালী সমাজে শাশুড়িকে অনেকটা 'ডাইনি' চরিত্রে চরিত্রায়িত করা হয়। এর পেছনে অবশ্য শাশুড়ি সমাজের বেশ অবদান আছে। তারা ছেলের বউকে ভেবে বসেন মিসেস পারফেকশনিস্ট। যেন ছেলের বউয়ের প্রতিটা কাজ হতে হবে একেবারে নিঁখুত, দাগহীন। ছেলের বউরা যেন কোন ভুল করতেই পারবেনা। ছেলের বউয়ের ছোট ভুলকেও তারা সুবিশাল বানিয়ে ফেলেন। এরপর নানান কথা এবং আচার আচরণে পুত্রবধুকে বোঝানো হয় যে তিনি তাকে নিয়ে সন্তুষ্ট নন৷ এরপর, এই ব্যাপারে মায়ের মুখ থেকে এবং বউয়ের মুখ থেকে- উভয়দিক থেকেই ছেলের কানে অভিযোগের জোয়ার ভেসে আসে৷ ছেলে বেচারা পড়ে যায় বেকায়দায়। শ্যাম নেবে না কূল নিবে।
তবে, উল্টোচিত্রটাও কম নয়। ডোমিন্যান্ট স্বভাবের পুত্রবধুর সংখ্যাও নেহাত কম নয় আমাদের সমাজে। কথায় কথায় এরা স্বামীকে অধিকার আর আনুগত্যের সীমারেখা শুনিয়ে দেয়। যেন এর বাইরে এসে কিছু করলে তাদের প্র্যাস্টিজে লাগবে। তাদের কাছে সংসারের শান্তি আর শৃঙখলার চেয়ে ওই প্র্যাস্টিজটুকুই যেন বড়!
বলছিলাম মেয়েদের কথা। আমাদের ভাবা উচিত আমরা কোন মেশিনকে বিয়ে করিনা। যাকে বিয়ে করি সে একজন রক্ত-মাংসের মানুষ। তার ভুল থাকবে, বিচ্যুতি থাকবে, ঘাটতি থাকবে। তাকে তার ভুল, বিচ্যুতি আর ঘাটতিগুলো কাটিয়ে উঠার জন্যে যথেষ্ট সময় দিতে হবে।
সময় দেওয়ার ক্ষেত্রে আপনার-আমার ভূমিকা অবশ্যই এক্সাম সেন্টারের পরিদর্শকের মতো হবেনা যিনি পরীক্ষার্থীদের খাতার উপরে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকেন। আপনার-আমার ভূমিকা হতে হবে বন্ধুত্বপূর্ণ। তাদের ভুলগুলোকে সরাসরি 'ভুল' না বলে উৎসাহ দিয়ে বলতে হবে, 'খুব ভালো করেছো। তবে, এভাবে করলে আরেকটু ভালো হতো'।
সময় দেওয়ার ক্ষেত্রে আপনার-আমার ভূমিকা অবশ্যই এক্সাম সেন্টারের পরিদর্শকের মতো হবেনা যিনি পরীক্ষার্থীদের খাতার উপরে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকেন। আপনার-আমার ভূমিকা হতে হবে বন্ধুত্বপূর্ণ। তাদের ভুলগুলোকে সরাসরি 'ভুল' না বলে উৎসাহ দিয়ে বলতে হবে, 'খুব ভালো করেছো। তবে, এভাবে করলে আরেকটু ভালো হতো'।
আপনার বিয়ের মুখ্য উদ্দেশ্য কিন্তু স্ত্রীর হাতের সুস্বাদু রান্না খাওয়া নয়। যদি এরকম উদ্দেশ্য হয় তাহলে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে কোন নামীদামি শেফ খুঁজে নিবেন যিনি আপনাকে মজার মজার রান্না করে খাওয়াবে। আপনার স্ত্রী যদি রান্না বান্না পারে তো আলহামদুলিল্লাহ। যদি না পারে, তাকে সুযোগ দিন। তাকে এটা বুঝতে দিন যে আপনি চাইলেই বাইরের হোটেলে কাচ্চি আর মোরগ পোলাও খেতে পারেন। কিন্তু খান না। কারণ, আপনি কাচ্চি আর মোরগ পোলাওয়ের চাইতে আপনার প্রিয়তমার হাতের বানানো আলু ভর্তাই বেশি পছন্দ করেন।
তাকে অনুধাবন করান যে আপনি তাকে কতোটা গুরুত্ব দেন। তাকে বুঝতে দেন যে তার কাঁচা হাতের রান্নাও আপনার কাছে অমৃতের মতো। দেখবেন, একদিন সত্যি সত্যিই আপনার স্ত্রী আপনার জন্যে অমৃতের মতোন রান্না করে রাখবে।
তাকে অনুধাবন করান যে আপনি তাকে কতোটা গুরুত্ব দেন। তাকে বুঝতে দেন যে তার কাঁচা হাতের রান্নাও আপনার কাছে অমৃতের মতো। দেখবেন, একদিন সত্যি সত্যিই আপনার স্ত্রী আপনার জন্যে অমৃতের মতোন রান্না করে রাখবে।
আপনার জীবনে আপনার মা-বাবা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি আপনার স্ত্রীও আপনার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যদি তাদের মাঝে কোন সমস্যা দেখেন, তাহলে সেটাকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে সমাধান করুন। মাকে বুঝতে দিন যে তিনি আপনার হৃদয়ে ছিলেন, হৃদয়েই আছেন। স্ত্রীকে বোঝান যে তাকে ছাড়া আপনার জীবন মূল্যহীন। ভারসাম্য করুন। কখনোই মায়ের দূর্বলতা স্ত্রীর কাছে আর স্ত্রীর দূর্বলতা মায়ের কাছে বলবেন না।
স্ত্রীকে যেমন সময় দিবেন, তেমন সময় দিবেন মা-বাবাকেও। কেউই যেন এটা না বুঝে যে সে আপনার কাছ থেকে 'কম গুরুত্ব' পাচ্ছে।
স্ত্রীকে যেমন সময় দিবেন, তেমন সময় দিবেন মা-বাবাকেও। কেউই যেন এটা না বুঝে যে সে আপনার কাছ থেকে 'কম গুরুত্ব' পাচ্ছে।
শাশুড়ি সমাজের উচিত পুত্রবধুদের 'মেশিন' না ভাবা। তাদের মেয়ে ভাবা। মেয়ের ভুলকে তারা হাইলাইট করতে পছন্দ করেন না, সেরকম ছেলের বউয়ের বেলাতে করতে পারলে সম্পর্কটা আর বউ-শাশুড়ি থাকেনা, মা-মেয়ে হয়ে যায়।
ছেলের বউদেরও উচিত স্বামীর বাপ-মা'কে কেবল 'শ্বশুর-শাশুড়ি' না ভাবা। বাড়িতে রেখে আসা নিজের বাবা-মা'র জায়গায় ভাবতে পারলেই অধিকাংশ সমস্যা মিটে যাবে। সন্তান কখনোই তার বাবা-মা'র সাথে এমন আচরণ করবেনা যা উপরন্তুর সমস্যা বৃদ্ধি করে।
ছেলের বউদেরও উচিত স্বামীর বাপ-মা'কে কেবল 'শ্বশুর-শাশুড়ি' না ভাবা। বাড়িতে রেখে আসা নিজের বাবা-মা'র জায়গায় ভাবতে পারলেই অধিকাংশ সমস্যা মিটে যাবে। সন্তান কখনোই তার বাবা-মা'র সাথে এমন আচরণ করবেনা যা উপরন্তুর সমস্যা বৃদ্ধি করে।
বোনদেরও বলি। প্রত্যেক স্বামীই চায় তার স্ত্রীটা সাংসারিক হোক। তার ঘরে আলো ছড়াক। মেয়েলীসূলভ সবটা গুণে গুণান্বিত হোক তার প্রিয়তমা।
একজন স্বামী চায় তার মা'র মুখ থেকে তার স্ত্রীর প্রশংসা শুনতে। তার বাবার কাছ থেকে স্ত্রীর ব্যাপারে সুনাম শুনতে।
বৃষ্টি বাদলের দিন কফির কাপে একসাথে চুমুক দিতে পারার মধ্যে রোমান্টিসিজম আছে বটে, সংসারের সুখের মধ্যে আছে অন্তরের প্রশান্তি। আপনি যখন নিজ থেকে স্বামীর জন্যে বাড়তি কিছু করেন, গোছানো কিছু করেন বা করতে চান- বিশ্বাস করুন তিনি সুযোগ হলেই তার কলিগদের কাছে সেই গল্প করেন। আপনার ভূয়সী প্রশংসা করে তিনি নিজে যে কি পরিমাণ আপ্লুত হোন, তা আপনি কোনোদিনও জানতে পারবেন না।
একজন স্বামী চায় তার মা'র মুখ থেকে তার স্ত্রীর প্রশংসা শুনতে। তার বাবার কাছ থেকে স্ত্রীর ব্যাপারে সুনাম শুনতে।
বৃষ্টি বাদলের দিন কফির কাপে একসাথে চুমুক দিতে পারার মধ্যে রোমান্টিসিজম আছে বটে, সংসারের সুখের মধ্যে আছে অন্তরের প্রশান্তি। আপনি যখন নিজ থেকে স্বামীর জন্যে বাড়তি কিছু করেন, গোছানো কিছু করেন বা করতে চান- বিশ্বাস করুন তিনি সুযোগ হলেই তার কলিগদের কাছে সেই গল্প করেন। আপনার ভূয়সী প্রশংসা করে তিনি নিজে যে কি পরিমাণ আপ্লুত হোন, তা আপনি কোনোদিনও জানতে পারবেন না।
বেশি কিছুই না। একটু ভালো রকমের বোঝাপড়া, দু'পক্ষের একটু বাড়তি চেষ্টা আর একটু বেশিই ভালোবাসা একটি সুখী সংসারের জন্য খুব যথেষ্ট।
আপনার (ছেলে-মেয়ে দু'জনের) ভুলগুলোকে 'ভুল' বলে স্বীকার করতে পারা এবং সেটা শুধরিয়ে নিতে পারার মানসিকতা সংসারের আশি ভাগ সমস্যারই সমাধান করে দেয়। জাস্ট ট্রাই।
আপনার (ছেলে-মেয়ে দু'জনের) ভুলগুলোকে 'ভুল' বলে স্বীকার করতে পারা এবং সেটা শুধরিয়ে নিতে পারার মানসিকতা সংসারের আশি ভাগ সমস্যারই সমাধান করে দেয়। জাস্ট ট্রাই।
No comments
Note: Only a member of this blog may post a comment.