পৌত্তলিক (pagan) vs মনোথিস্ট (Abrahamic Monotheist)

পৌত্তলিক (pagan) vs মনোথিস্ট (Abrahamic Monotheist)
.লিখেছেনঃ আহমেদ আলী
.
পৌত্তলিক: ভাই, আপনি কি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন?
মনোথিস্ট: হ্যাঁ, বলুন, কী দরকার? এত কিছু ছেড়ে ছুড়ে আজকাল লোকে ঈশ্বর তত্ত্ব নিয়ে পড়েছে দেখি!
পৌত্তলিক: ঈশ্বর কেমন বলুন তো ভাই? সাকার না নিরাকার?
মনোথিস্ট: কোনোটাই না!
পৌত্তলিক: এ কী! আপনি দেখি নাস্তিকের মত কথা বলছেন! এই যে বললেন যে, আপনি ঈশ্বরে মানেন!
মনোথিস্ট: হ্যাঁ ঠিকই তো বলেছি। আপনি যা বলার বলুন আগে।
পৌত্তলিক: আচ্ছা আমিই বলি তাহলে। ঈশ্বর সাকার, নিরাকার দুই-ই হতে পারেন।
মনোথিস্ট: কীভাবে?
পৌত্তলিক: জল যেমন নিরাকার, বরফ যেমন সাকার, ঈশ্বর তেমনি সাকার-নিরাকার দুই-ই হতে পারেন।
মনোথিস্ট: তার মানে বলতে চাচ্ছেন যে, ঈশ্বর তার সৃষ্টির মত?
পৌত্তলিক: মানে?
মনোথিস্ট: মানে হল গিয়ে জল আর বরফ দুটোই সৃষ্টির অংশ, তার মানে ঈশ্বর তার মানে তার সৃষ্টির মত!
পৌত্তলিক: আসলে সাহিত্যে ঈশ্বরকে দেখবেন অনেক সময় mother nature বলা হয়। বেদান্তেও আমরা ঈশ্বরকে "পুরুষ" আর "প্রকৃতি" এই দুই ভাগে বিবেচনা করি। এখানে নিরাকার ঈশ্বরের অংশের সাকার প্রকাশেই জগৎ তৈরি হয়েছে।
মনোথিস্ট: তার মানে ঈশ্বর ভাগ হয়ে গেছে আর তার আসলে নতুন কিছু সৃষ্টির কোনো ক্ষমতা নেই?
পৌত্তলিক: মানে! কী বলেন মশাই?
মনোথিস্ট: ঈশ্বর পুরুষ-প্রকৃতি, শিব-শক্তি, কৃষ্ণ-রাধা, ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর ইত্যাদি নানাভাবে ভাগ হয়ে গেছে, তাহলে এক ঈশ্বর আসলে আর এক নেই, এখানে এক খণ্ড, ওখানে এক খণ্ড এরকমই তো হচ্ছে! আর ঈশ্বরের অংশ যদি রূপান্তরিত হয়ে সৃষ্টি আসে, তার অর্থ হল ঈশ্বর নতুন কিছু সৃষ্টির ক্ষমতা রাখে না, যেমনভাবে গাছের কাঠ দিয়ে চেয়ার বানানো হয়, এখানে কাঠের রূপান্তর হয়েছে মাত্র, মহাবিশ্বে নতুন কিছু সৃষ্টি হয়নি; একইভাবে ঈশ্বর নিজের অংশ রূপান্তর করেছে মাত্র, নতুন কিছু সৃষ্টির কোনো ক্ষমতা তার নেই।
পৌত্তলিক: আসলে পৃথক সৃষ্টি বলে কিছু নেই। সৃষ্টি আছে, এই ধারণাটাই মিথ্যা! বৈদিক দর্শনে আমরা একে বলি "মায়া"! আমরা সৃষ্টিকে দেখছি, এটাই আমাদের বিভ্রম!
মনোথিস্ট: ভাল! তাহলে এই নিন একটা থাপ্পড় খান!
পৌত্তলিক: এটা কী হল! আপনি আমায় মারলেন?
মনোথিস্ট: কেন! আপনিই তো বললেন, জগতটা মিথ্যা, তাহলে এত সিরিয়াস হওয়ার কী আছে?
পৌত্তলিক: ইয়ে মানে, আসলে আমি বলতে চাইছি...
মনোথিস্ট: আসলে আপনি বলতে চাইছেন যে, মায়ার মধ্যে মায়ার অনুভূতি কাজ করে, তাই ভাল-মন্দ বোধও এর মধ্যে কাজ করে, তাই তো?
পৌত্তলিক: হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন, আপনি দেখি জানেন বিষয়টা!
মনোথিস্ট: তাহলে মশাই এবার আমায় দয়া করে বলুন দেখি, মায়া যে আছে, সেটা কেন আছে?
পৌত্তলিক: কারণ এটা ঈশ্বরের ইচ্ছা।
মনোথিস্ট: না আমি বলতে চাইছি যে, এটা কোথা থেকে আসল?
পৌত্তলিক: আপনি কি পাগল নাকি? এটা ঈশ্বরের কাছ থেকেই এসেছে!
মনোথিস্ট: কিন্তু আপনি আমি নাকি ঈশ্বরের অংশ! অথচ ঈশ্বরের ওপর জন্ম-মৃত্যুর অনুভূতি তথা মায়ার প্রভাব নেই, অথচ আমাদের ওপর এই মায়ার প্রভাব কেন?
পৌত্তলিক: কারণ তিনি ঈশ্বর, তিনি সবকিছুর উর্ধ্বে।
মনোথিস্ট: কিন্তু তাহলে পরমাত্মা রূপে ঈশ্বর অবিনশ্বর, আর তার থেকে আসা আত্মা, যা আপনি আর আমি, তারাও অবিনশ্বর হয় কী করে? পরমাত্মাও অবিনশ্বর, আত্মাও অবিনশ্বর! তবে কেন মানতে যাব যে, পরমাত্মা সবকিছুর উর্ধ্বে?
পৌত্তলিক: এটাই তো মায়ার প্রভাব!
মনোথিস্ট: আমিও তো বলছি যে, মায়া কোথা থেকে আসল এর কোনো উত্তর নেই, কারণ আত্মাও অবিনশ্বর আর পরমাত্মাও অবিনশ্বর। যদি আত্মা মায়ার দ্বারা প্রভাবিত হয়, তাহলে যুক্তি অনুযায়ী যেহেতু পরমাত্মাও অবিনশ্বর, তাই একই পরমাত্মা বা অবিনশ্বর ঈশ্বরেরও মায়ার দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার কথা।
পৌত্তলিক: আপনি আসলে কী বলতে চান?
মনোথিস্ট: মায়া আছে, এটা যেমন অন্ধ বিশ্বাস, তেমনি ঈশ্বর মায়ায় প্রভাবিত হন না কারণ তিনি এগুলোর উর্ধ্বে, এটাও আরেকটা অন্ধবিশ্বাস, এগুলোর কোনো প্রমাণ নেই!
পৌত্তলিক: তাহলে নিরাকার ঈশ্বরের জগতরূপে সাকার প্রকাশের উপায় কী?
মনোথিস্ট: ঈশ্বর যে সাকার বা নিরাকার, এটা আপনাকে কে বলল?
পৌত্তলিক: যুগে যুগে অনেক মুনি-ঋষি তাদের ধ্যানে এটা উপলব্ধি করে গেছেন।
মনোথিস্ট: এর অর্থ হল ঋষিরা যা লিখে গেছেন, সেটা তাদের নিজেদের আবিষ্কার, ঠিক?
পৌত্তলিক: হ্যাঁ ঠিক, যেমন আজ বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করছে।
মনোথিস্ট: অর্থাৎ ঈশ্বর নিজে তাদের ওপর কিছু অবতীর্ণ করেন নি। আর মানুষ সৃষ্টিরই অংশ, তাই তার ক্ষমতারও একটা সীমা আছে। তার ভুল হওয়াটাও অস্বাভাবিক কিছু না। যেমন বিজ্ঞানীদের মধ্যেও হয়, আর একারণেই সময়ে সময়ে অনেক থিওরি পরিবর্তন হয়। আমরা আব্রাহামিক মনোথিইজমে এটা দাবি করি না যে, Prophets যাদের আমরা Messenger of God বলি, তারা নিজে নিজে আবিষ্কার করে বই পত্র লিখে গেছেন। বরং আমরা বলি যে, সৃষ্টিকর্তা নিজেই তাঁদেরকে মানবজাতির মধ্য থেকে নির্বাচন করেছেন এবং তাঁদের ওপর তাঁর বাণী অবতীর্ণ করেছেন।
পৌত্তলিক: ও বাবা! তাই? আচ্ছা, তাহলে এটা কী? "God created man in *his own image"* (Bible, Genesis 1:27); "পৃথিবী পৃষ্ঠে যা আছে সবই ধ্বংসশীল, কিন্তু চিরস্থায়ী *তোমার প্রতিপালকের চেহারা* - যিনি মহীয়ান, গরীয়ান" (The Quran, 55:26-27); এর মানে God, ঈশ্বর, আল্লাহ, ইয়াহোয়ে যাই বলি না কেন, তিনি হলেন সাকার!
মনোথিস্ট: পেগানিজমের ভূত মাথায় পোরা থাকলে এর বাইরে আপনি আর কী বা বুঝবেন? image, চেহারা, হাত, পা এগুলো দিয়ে আপনি কী বুঝলেন?সৃষ্টিকর্তা দেখতে মানুষের মত?
পৌত্তলিক: এটাই তো common sense!
মনোথিস্ট: আসলে এটা common sense না, এটা absence of proper knowledge!
পৌত্তলিক: কী বলতে চাইছেন আপনি!!!
মনোথিস্ট: এটা কী দেখুন 👉 *"God is not a man,* that he should lie.." (Bible, Numbers 23:19); *"..I am God, and there is none like me"* (Bible, Isaiah 46:9); *"তাঁর সমতুল্য কিছুই নেই"* (Quran, 112:4); *"..কোনো কিছুই তাঁর অনুরূপ নয়.."* (Quran, 42:11); এর অর্থ হল সৃষ্টিকর্তা আত্মাও নন, পরমাত্মাও নন, বরং তিনি আত্মা ও অন্য সকল কিছুর একমাত্র স্রষ্টা এবং তিনি সৃষ্টির কোনো কিছুর মতনই নন। তাই তাঁর চেহারা, হাত, পা ইত্যাদি যে প্রকাশভঙ্গিগুলোর কথা বলা হচ্ছে, এগুলো সৃষ্টির মত কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নয়, বরং এগুলো কেবলই তাঁর বৈশিষ্ট্য বা সিফাত বা attributes.
পৌত্তলিক: কী সব উল্টো পাল্টা প্যাঁচাচ্ছেন! কিছুই তো বোঝা যাচ্ছে না!
মনোথিস্ট: আপনি দেখতে পান, আমিও দেখতে পাই। একইভাবে সৃষ্টিকর্তাও দেখতে পান, এটাই হল বৈশিষ্ট্য। আবার আপনি আমি শুনতে পাই, সৃষ্টিকর্তাও শুনতে পান। কিন্তু আমাদের দেখার জন্য চোখ লাগে, আলো লাগে। শোনার জন্য বাতাস বা অন্য কোনো মাধ্যম লাগে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার দেখতে বা শুনতে এসব কিছুই লাগে না। কারণ "তিনি কোনো কিছুর মুখাপেক্ষী নন" (Quran, 112:2); আর যেহেতু তিনি সৃষ্টির কোনো কিছুর মতই নন, তাই তাঁর দেখা, শোনা, চেহারা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যও মানুষের বা কোনো সৃষ্টির মত নয়। তিনি সাকারও নন, নিরাকারও নন। বরং তিনি সৃষ্টি হতে সম্পূর্ণ পৃথক অবস্থায় বিরাজমান (Quran, 7:54)
পৌত্তলিক: সাকারও নন, নিরাকারও নন! তাহলে তিনি কেমন শুনি?
মনোথিস্ট: তিনি অচিন্তনীয়! আগেই তো দেখালাম 👉 *"..I am God, and there is none like me"* (Bible, Isaiah 46:9); *"..কোনো কিছুই তাঁর অনুরূপ নয়.."* (Quran, 42:11)
পৌত্তলিক: এটা কী করে মানে? এটা হয় নাকি আবার?
মনোথিস্ট: আইনস্টাইন এর মতে, দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা হল তিন ডাইমেনশন এর মধ্যে, আর সময় হল চতুর্থ ডাইমেনশন। সেই সময়টা কেমন দেখতে ভাই?
পৌত্তলিক: সময় দেখা যায় না, বোঝা যায়, মাপা যায় মাত্র। কিন্তু উপলব্ধি তো করা যাচ্ছে!
মনোথিস্ট: কিন্তু ভাই চতুর্থ ডাইমেনশন এর পরেও বিজ্ঞানীরা দশম ডাইমেনশন পর্যন্তও আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে। এই উপরের ডাইমেনশনগুলো আপনি আপনার ব্রেন দিয়েও চিন্তা করতে পারবেন না! তাহলে আপনি এই বেলায় তো বলছেন না যে, ডাইমেনশন এমন হয় আমি মানি না, অথচ যখন আমরা বলি যে, ঈশ্বর সাকার- নিরাকার কোনোটাই না, তখন আপনাদের যত সমস্যা! পদার্থের কয়টা অবস্থা দেখা যায় সাধারণত?
পৌত্তলিক: কঠিন, তরল, গ্যাসীয় - এই তিনটে।
মনোথিস্ট: কিন্তু আজ বিজ্ঞান দেখিয়েছে যে, পদার্থের অসংখ্য অবস্থা রয়েছে। তাহলে সামান্য পদার্থের যদি কঠিন, তরল, গ্যাসীয় অবস্থার বাইরের অবস্থাও থাকতে পারে, তাহলে সৃষ্টিকর্তা কেন সাকার- নিরাকারের উর্ধ্বে হতে পারেন না?
পৌত্তলিক: তাহলে আপনি আমায় শুধু এটার জবাব দিন। *"..আমি তার গলার শিরা থেকেও নিকটবর্তী।"* (Quran, 50:16); এটা থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, ঈশ্বর আত্মারূপে সৃষ্টির মধ্যে বিরাজমান, তিনি সৃষ্টি থেকে পৃথক নন।
মনোথিস্ট: এটা আপনার ধারণা মাত্র। সৃষ্টিকর্তা আত্মারূপে সৃষ্টির মধ্যে বিরাজমান হলে নিশ্চয় মূর্তিপূজা নিষিদ্ধ হওয়ার কথা নয়? *"Do not worship idols. Do not make statues of gods for yourselves. I am the LORD your God."* (Bible, Leviticus 19:4); *"মদ, জুয়া আর মূর্তি ও ভাগ্য নির্ধারক তীর ঘৃণিত শয়তানী কাজ, তোমরা তা বর্জন কর, যাতে তোমরা সাফল্যমন্ডিত হতে পার।"* (Quran, 5:90)
পৌত্তলিক: তাহলে ঈশ্বর কীভাবে গলার শিরার থেকেও নিকটবর্তী হন?
মনোথিস্ট: "আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু রয়েছে তাঁরই, তোমরা যাতে ব্যাপৃত তিনি তা জানেন; যেদিন *তারা তাঁর কাছে ফিরে যাবে,* সেদিন তিনি তাদেরকে জানিয়ে দিবেন তারা যা করত; **তিনি সর্ব বিষয়ে সর্বজ্ঞ।"** (Quran, 24:64); অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টি হতে পৃথক এবং তিনি জ্ঞানের দ্বারা সর্বত্র বিরাজমান। অর্থাৎ গলার শিরার থেকেও নিকটে কেবল একটা রূপক প্রকাশভঙ্গি মাত্র, এটা আক্ষরিক নয়। এর অর্থ তিনি আক্ষরিকভাবে সৃষ্টির মধ্যে উপস্থিত না থেকেও তিনি সকল কিছুই জানতে, দেখতে ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাখেন। আর এই পৃথক সৃষ্ট মানুষ একদিন তাঁর নিকট ফিরে যাবে যখন তাদের বিচারকার্য সম্পন্ন হবে।
পৌত্তলিক: ধুর! মুডটাই নষ্ট হয়ে গেল! বুদ্ধিভ্রষ্ট ম্লেচ্ছ, অনার্য, বর্বর, দস্যু জাতি ধর্ম-অধর্মের কী বুঝবে! তোদের মত যবন জাতির জন্যই এই পৃথিবীটা শেষ হয়ে গেল! তোদের সাথে কথা বলাটাই ভুল হয়ে গেছে। আমি তাই চললাম!
মনোথিস্ট: এত চিন্তা করবেন না সাধুবাবা! জগতটা তো আপনার কাছে মায়া, স্বপ্নের মত! তাই এই ঘটনাকে না হয় স্বপ্ন মনে করে ভুলে যান! 😛

No comments

Note: Only a member of this blog may post a comment.

Powered by Blogger.