সত্য কখনো ধ্বংস হয় না / লেখকঃ জাকারিয়া মাসুদ

সত্য কখনো ধ্বংস হয় না
লেখকঃ জাকারিয়া মাসুদ

একদিন আল্লাহর রাসূল (স) ও আবূ বাকর (রা) পাশাপাশি বসা। রাসূল (স) তখন জান্নাতের বিবরণ দিচ্ছিলেন। জান্নাত কেমন হবে, কী কী নিআমাত জান্নাতিদের প্রদান করা হবে, জান্নাতের দরজা কটি থাকবে ইত্যাদি বিষয়ে আলোকপাত করছিলেন। তো কথার ফাঁকে তিনি বললেন, “যে সালাত আদায়কারী, তাকে সালাতের দরজা দিয়ে ডাকা হবে। যে মুজাহিদ, তাকে জিহাদের দরজা দিয়ে ডাকা হবে। যে সিয়াম পালনকারী, তাকে রায়্যাব দরজা দিয়ে ডাকা হবে। সে সাদাকা দানকারী, তাকে সাদাকার দরজা দিয়ে ডাকা হবে।”
রাসূল (স)-এর এ কথা শোনার পর আবূ বাকর (রা) ক্ষণিকের জন্যে চিন্তায় পড়ে গেলেন। এরপর তিনি বললেন, “হে আল্লাহর রাসূল! আমার পিতা-মাতা আপনার জন্যে কুরবান হোক!...(এমন কেউ কি নেই) যাকে সব দরজা থেকেই ডাকা হবে?”
.
সুবহানাল্লাহ! রাসূল (স)-এর সাহাবিদের চিন্তাধারা কতটা পরিশুদ্ধ ছিল! আমরা হলে হয়তো বলতাম, “কোন কাজ করলে পরে অমুক দরজা দিয়ে সহজেই প্রবেশ করতে পারব? অথবা অমুক দরজা আমাকে ডাকবে এমন কোনো শর্টকার্ট ওয়ে আছে কি?” রাসূল (স)-এর সাহাবি এসব কিছুই বলেননি। বরং তিনি বলেছেন, সব দরজাই ডাকবে, এমন কেউ নেই? তাঁর প্রশ্নের জবাবে রাসূল (স) বললেন, “হ্যাঁ (আছে)। আর আমি আশা করি তুমি তাঁদের মধ্যে হবে।”[বুখারি : ২৭৪১, ৩২১৬, ৩৬৬৬, মুসলিম : ১০২৭]
.
আবূ বাকর (রা) ভিন গ্রহের কোনো প্রাণি ছিলেন না। ফেরেশতাও ছিলেন না। তিনি আমাদের মতোই অনুভূতিসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। কিন্তু দ্বীনের জন্যে ত্যাগ ও কুরবানি তাঁকে ফেরেশতাদের ওপরের পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছে। তাইতো ফেরেশতারা পর্যন্ত তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে ব্যাকুল হয়ে পড়বে। সবাই চাইবে, আবূ বাকর (রা) তাঁর হেফাজতে থাকা দরজা দিয়েই জান্নাতে প্রবেশ করুক। সবাই মিলে তাঁকে ডাকতে থাকবে—‘এই দিকে আসুন। এই দরজায় আসুন। এখান দিয়ে প্রবেশ করুন...।’ 
ইমাম ইবনু তাইমিয়্যা (রাহ) বলেছেন, “ফেরেশতাদের বানানো হয়েছে আকল দিয়ে, কামনাবাসনা দিয়ে নয়। জন্তু-জানোয়ারদের বানানো হয়েছে কামনা-বাসনা দিয়ে, আকল দিয়ে নয়। কিন্তু মানবজাতিকে বানানো হয়েছে উভয়টি—আকল ও কামনা-বাসনা—দিয়ে। এ কারণে যার আকল কামনা-বাসনার ওপরে বিজয়ী হয়, সে ফেরেশতাদের ছাড়িয়ে যায়। আর যার কামনা-বাসনা আকলের ওপর জয়ী হয়, সে জন্তু জানোয়ারকে ছাপিয়ে যায়।” [মাজমাউল ফাতাওয়া : ১৫/৪২৮]
.
আবূ বাকর একদিনে এই পর্যায়ে পৌঁছাননি। দীর্ঘ ত্যাগ, সাধনা ও কষ্টের পর তিনি এই পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন। একটা উদাহরণ দিই, তাহলে ব্যাপারটা একটু পরিষ্কার হবে। সময়টা নবম হিজরির। প্রচণ্ড গরম ছিল সে সময়। কিছু মানুষ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছিল। এরই মধ্যে তাবুক যুদ্ধের ঘোষণা এল। রাসূল (স) ও তাঁর সাহাবারা প্রস্তুতি নিলেন। সাহাবারা যুদ্ধের জন্যে সর্বোচ্চ পরিমাণে দান করতে লাগলেন। উসমান (রা) দিলেন নয় শ উট, এক শ ঘোড়া। আব্দুর রহমান ইবনু আঊফ (রা) দিলেন সাড়ে উনত্রিশ কিলো সোনা। উমার (রা) মনে মনে ভাবতে থাকেন—‘এই সুযোগ। আবূ বাকরের ঘরে তেমন সম্পদ নেই। এবার আবূ বাকরকে ঠিক পেছনে ফেলে দেব।’ 
.
তো যে কথা সেই কাজ। উমার (রা) তাঁর অর্ধেক সম্পদ নিয়ে হাজির হলেন। রাসূল (স) উমারের দান দেখে সন্তুষ্ট হলেন। এবার উমার (রা) অপেক্ষা করছেন—আবূ বাকর (রা) কী আনেন, সেটা দেখার জন্যে। কিছুক্ষণ পর আবূ বাকর (রা) এলেন। পুরোনো কাপড়ে বাঁধা পুঁটলিটা মাথা থেকে নামালেন। উমার (রা)-এর দৃষ্টি পুঁটলির দিকে। আবূ বাকর (রা) সেটা খুললেন। তাঁর যত সম্পদ ছিল, সবই ওই কাপড়ে বেঁধে এনেছেন। রাসূল (স) আবূ বাকর (রা)-এর দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। এরপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাসার সব কিছুই কি নিয়ে এসেছ?’
আবূ বাকর (রা) বললেন, ‘সবই নিয়ে এসেছি, কিন্তু ঘর খালি করে আসিনি।’
উমার (রা) জিজ্ঞেস করলেন, ‘কীভাবে? এখানে তো আপনার সব জিনিসপত্র দেখা যাচ্ছে।’
আবূ বাকর (রা) মুচকি হেসে বললেন, ‘ঘরে আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে রেখে এসেছি।’ [আর রাহীকুল মাখতুম : ১৮৮]
.
আবূ বাকর (রা)-এর কথা শুনে সাহাবারা যারপরনাই বিস্মিত হলেন। তিনিই সে ব্যক্তি, যিনি দ্বীনের জন্যে সবকিছু উজাড় করে দিয়েছেন। দ্বীনের সামনে সমস্ত ধন-সম্পদকে তুচ্ছ মনে করেছেন। তাইতো রাসূল (স) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার ধন-সম্পদ দিয়ে, সাহচর্য দিয়ে আমার ওপর সবচেয়ে বেশি ইহসান করেছে, সে ব্যক্তি হলো আবূ বাকর।’[বুখারী : ৩৩৯২] 
.
বদরেরর ময়দান। নবিজি (স) চিন্তিত হয়ে পায়চারি করছেন। সাহাবারা যুদ্ধের জন্যে ময়দানে আসেননি, এসেছিলেন কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলা আক্রমণ করার জন্যে। কিন্তু এখন যুদ্ধের দামামা বেজে গেছে। পিছু হটার উপায় নেই। যুদ্ধই একমাত্র সমাধান। নবিজি (স) ভাবছেন—সাহাবারা কি যুদ্ধের জন্যে রাজি হবে? মুহাজিররা না-হয় রাজি হলো, কিন্তু আনসাররা? তারা তো মদীনার বাইরে আমাকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্যে চুক্তিবদ্ধ হয়নি, তাহলে? ওরা যদি যুদ্ধ না করে চলে যায়! নবিজি (স) সাহাবাদের ডাকলেন। তাঁদের কাছে পরামর্শ চাইলেন। আবূ বাকর ও উমার (রা) যুদ্ধ করার পক্ষে মত দিলেন। নবিজি (স) চাচ্ছিলেন আনসাররা মতামত দিক। আনসার সাহাবারাই সংখ্যায় বেশি। এই মুহূর্তে তাঁদের মতামত জানাটা খুব জরুরি। আনসারদের পতাকাবাহী সাদ ইবনু মুআয (রা) নবিজি (স)-এর মনোভাব বুঝতে পারলেন। তিনি সামনে এলেন। এরপর দৃঢ়চিত্ত কণ্ঠে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি আমাদের মতামত জানতে চান?’
নবিজি (স) বললেন, ‘হ্যাঁ, তোমরা আমাকে পরামর্শ দাও। 
.
সাদ ইবনু মুআয (রা) বললেন, ‘আমরা আপনার ওপর ঈমান এনেছি। আপনাকে সত্য বলে মেনে নিয়েছি। আপনার কথা শুনবো ও মানবো বলে ওয়াদা করেছি। আপনি আমাদের নিয়ে মোটেও চিন্তিত হবেন না। আমরা ভীরু ও কাপুরুষ নই। আমাদের ধন-সম্পদ আপনার জন্যে, যত প্রয়োজন হয় খরচ করুন। যেদিকে খুশি আমাদেরকে নিয়ে চলুন। আল্লাহর শপথ! আমরা একজনও পেছনে পড়ে থাকবো না। ইন শা আল্লাহ শত্রুর মোকাবিলায় আমাদের যোগ্যতা ও কৃতিত্ব দেখে আপনার জুড়োবে। আল্লাহর শপথ! আপনি যদি আমাদের সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন, আমরা তা-ই করবো। আপনি যদি আমাদের আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন, আমরা সেটাও পালন করবো। আমাদের নিয়ে সামনে বাড়ুন।’ [যাদুল মাআদ : ২/২৫৩, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া : 3/৪৬২; আর রাহীকুল মাখতুম : ২৩২-২৩৩]
.
সাদ ইবনু মুআয (রা) তাঁর কথাগুলোকে সত্যে পরিণত করেছিলেন। তিনি যখন মারা গেলেন, তখন আল্লাহর আরশ পর্যন্ত কেঁপে উঠেছিল। জাবির (রা) বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল (স)-কে বলতে শুনেছি—“সাদ ইবনু মুআযের মৃত্যুতে আল্লাহ তাআলার আরশ কেঁপে উঠেছিল।” [বুখারি : ৩৮০৫] 
.
আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠা কি খুব মামুলি বিষয়? এমনি এমনি আল্লাহর আরশ কাঁপেনি। সাদ ইবনু মুআয (রা) বীরত্বের সাথে লড়াই করেন। আঘাতে জর্জরিত হয়ে দেহে যখম সৃষ্টি হয়। সে যখম ফেটে গিয়ে অবিরাম রক্ত প্রবাহিত হতে শুরু করে। আর এভাবেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
.
আজ আমরা তাঁদের মতো হতে চাই না, যাদের মৃত্যুতে আল্লাহর আরশ পর্যন্ত কেঁপে উঠে; যাদেরকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে ফেরেশতারা ব্যাকুল থাকে। আমরা কেন ইসলামের হিরোদের অনুসরণ করতে চাই না? কেন তাঁদের মতো কুরবানি করতে চাই না? কী অজুহাত আছে আমাদের? আমরা আল্লাহর কাছে কী জবাব দেব? 
.
উহুদের দিন আল্লাহর রাসূল (স) যাইদ ইবনু সাবিত (রা)-কে পাঠান সাদ ইবনুর রবী (রা)-কে খুঁজে বের করার জন্যে। যুদ্ধে নিহত সাহাবিদের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে যাইদ (রা) এক সময় তাঁকে পেয়ে যান। তখন তিনি অন্তিম শয্যায় শায়িত। তাঁর দেহে সত্তরটিরও বেশি আঘাতের চিহ্ন। কিছু আঘাত বল্লমের, কিছু আঘাত তরবারির আর কিছু আঘাত তিরের। যাইদ (রা) তাঁকে ওই অবস্থায় পেয়ে বললেন, “সাদ! আল্লাহর রাসূল আপনাকে সালাম দিয়েছেন। আর আপনার অবস্থা এখন কেমন, সেটা জানতে চেয়েছেন।”
জবাবে সাদ (রা) বললেন, “আল্লাহর রাসূল (স) ও তোমার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। তাঁকে বোলো—হে আল্লাহর রাসূল, আমি জান্নাতের সুঘ্রাণ পাচ্ছি। আর আমার গোত্র আনসারদের বোলো—তোমাদের কারও চোখের পলক ফেলার মতো শক্তি থাকা পর্যন্ত আল্লাহর রাসূলের যদি কিছু হয়, তবে আল্লাহর কাছে বলার মতো তোমাদের কোনো অজুহাত থাকবে না।” [হাকিম আল মুসতাদরাক : ২০১, সহীহ সীরাতুন নবি : ২/১৮১-১৮২] 
.
সাদ ইবনুর রবী (রা) এই কথা বলার পরপরই আল্লাহর কাছে চলে যান। একটু মন দিয়ে চিন্তা করুন, জীবনের শেষ মুহূর্তে এসেও সাদ (রা) তাঁর প্রিয় রাসূল (স)-কে ভুলে যাননি। যখন তাঁর দেহ আঘাতে আঘাতে জর্জরিত, প্রাণ কণ্ঠাগত; তখনও তিনি রাসূল (স)-এর কথা মনে রেখেছেন। এও বলেছেন, চোখের পলক যতক্ষণ আছে, ততক্ষণ যেন আনসাররা আল্লাহর রাসূল (স)-কে সুরক্ষা দিয়ে যায়। নয়তো আল্লাহর কাছে পেশ করার মতো কোনো অজুহাত থাকবে না। 
.
একজন বলেছিলেন, আমাদের তিনহাত। ডানহাত, বামহাত আর অজুহাত। আমরা ডান কিংবা বাম কোনো হাতই ব্যবহার করি না, কেবল অজুহাত ব্যবহার করি। সবক্ষেত্রেই অজুহাত দেখাই। তুচ্ছ জিনিসের জন্যে আল্লাহর দ্বীনকে বিক্রি করে দিই। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে রাসূল (স)-এর পবিত্র সুন্নাহ নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করি। আর যখন রাসূল (স)-এর সুরক্ষার প্রশ্ন আসে, তখন বিড়ালের মতো ঘরের কোণে চুপটি করে বসে থাকি। 
.
হে ইসলামের সন্তানেরা! নিজেদের প্রতিভাকে ধ্বংস কোরো না। তোমাদের মাঝেই আবূ বাকর, উমার, সাদ ইবনু মুআয-রা লুকিয়ে আছে। তাদের বিকশিত হতে দাও। এমনভাবে দুনিয়ার জীবন সমাপ্ত করো, যেন তোমার মৃত্যুতেও আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠে। যেন তোমাকেও অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে ফেরেশতারা ব্যাকুল থাকে। যেন মহামহিম আল্লাহ তোমার ওপর সন্তুষ্ট থাকে। কেবল ক্যারিয়ার নিয়ে পড়ে থেকো না। সম্পদের মোহে অন্ধ হয়ে যেয়ো না। সতর্ক হও। এক্ষুনি। মৃত্যু তোমার দুয়ারে দাঁড়িয়ে...
.
.
❝আর আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে যারা অগ্রগামী এবং যাবতীয় কাজে যারা তাদেরকে অনুসরণ করেছে, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন, আর তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। আর তাদের জন্যে প্রস্তুত করে রেখেছেন জান্নাত, যার তলদেশ দিয়ে ঝর্ণা প্রবাহিত। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। এটাই হলো মহাসাফল্য।❞ 
[সূরা তাওবা : ১০০ আয়াত]

No comments

Note: Only a member of this blog may post a comment.

Powered by Blogger.