বহুবিবাহ প্রসঙ্গ / আব্দুল্লাহ আল মাসুদ

বহুবিবাহ প্রসঙ্গ
লেখকঃ আব্দুল্লাহ আল মাসুদ
বহুবিবাহ ইসলামের একটি বৈধ বিষয়। শর্তসাপেক্ষে একের উপর দুই-তিন-চার জন নারীকে এক সাথে বিবাহ করার সুযোগ ইসলাম রেখেছে। তো এই বহুবিবাহের বিষয়ে ইসলামী শরীয়তের মনোভাবটা কী সেটা তলিয়ে দেখার চেষ্টা করবো এই লেখাতে।
ইসলামের আগমনকালে আরবদেশের সামাজিক অবস্থা ছিলো এমন যে, যার যতো ইচ্ছা বিবাহ করতে পারতো। সেখানে সংখ্যার কোন সামাজিক বাধ্যবাধকতা ছিলো না। ফলে একেকজন দশ-বারো বা ততোধিক বিবাহও করতো। ইসলাম সেটাকে কমিয়ে এনে চারের ভেতর সীমাবদ্ধ করেছে। ফলে যাদের চারের অধিক স্ত্রী ছিলো তারা অধিক স্ত্রীদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলো। যেমন, ইসলাম গ্রহণের আগে গায়লান বিন সালামা আসসাকাফী রাদিয়াল্লাহু আনহুর ছিলো দশ স্ত্রী। পরে চারজনকে রেখে তিনি বাকিদের পরিত্যাগ করেন।[১] তারমানে ইসলাম একাধিক স্ত্রীর ব্যাপারটাকে কম থেকে বেশির দিকে না নিয়ে বরং বেশির থেকে কমের দিকে এনেছে। এই পয়েন্ট মনে রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ। এটা আপনাকে শরীয়াহর মনোভাব বুঝতে সহায়তা করবে।
যাইহোক, বহুবিবাহকে ইসলাম একেবারে নিষেধ করে দেয় নি প্রয়োজনের খাতিরে। যাতে করে প্রয়োজন দেখা দিলে একাধিক বিবাহ করাটা বৈধরূপে বহাল থাকে। এখানে প্রয়োজনটা কেবল শরীরবৃত্তীয় নয়। বরং এর বাইরে গিয়ে সেটা হতে পারে অসহায়কে আশ্রয়দান, নারীর সংখ্যাধিক্যের কারণে পাত্র সংকট ইত্যাদি। তবে এটি মুবাহ বা বৈধ থাকার ফলে প্রয়োজন ছাড়াও যদি কেউ বহুবিবাহ করে সেটাও জায়েয হবে।
বহুবিবাহকে অনেকে ইদানীং সুন্নাহ বলে প্রচার করছেন দেখছি। এটা কি সত্যিই সুন্নাহ? সুন্নাহ বলতে আমি স্বতন্ত্র সুন্নাহর কথা বলছি। প্রয়োজন ও অবস্থা অনুপাতে কখনো ওয়াজিব, কখনো সুন্নাহ আর কখনো মুস্তাহাব হওয়াকে বুঝাচ্ছি না। কারণ এই ধরণের বিধান স্বতন্ত্র বিধান না।
এটা অবস্থার অনুপাতে নির্ণীত হওয়া বিধান। যেমন, অবস্থার অনুপাতে কখনো মদ বা শুকর খাওয়াও আপনার জন্য ওয়াজীব হয়ে যেতে পারে। এটা তো ধর্তব্য না। বরং স্বাভাবিক হুকুম বর্ণনার সময় বিষয়ের স্বাভাবিক অবস্থাটাই লক্ষ্যণীয় হয়। তো মিসওয়াক করা ও ডান হাতে খাওয়া যেমন স্বতন্ত্র সুন্নাহ বহুবিবাহ সেরকম সুন্নাহ কিনা সেই প্রশ্নটাই আমি এখানে করতে চাচ্ছি। আমি যতোটুকু ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখেছি, বিবাহ সংক্রান্ত সব জায়গায় শুধু বিবাহকে সুন্নাহ বলা হয়েছে। যেমন হাদীসে এসেছে,
النكاح من سنتي
"বিবাহ আমার সুন্নত।"[২]
এটা হচ্ছে মুতলাক বিবাহের বিধান। বহুবিবাহের সাথে এর কোন সম্পর্ক নাই। সাধারণ বিবাহ আর বহুবিবাহ কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন দুইটা জিনিস। একটাকে আরেকটার সাথে যেন কেউ গুলিয়ে না ফেলেন। সেজন্যই তো কেউ যদি এক বিবাহ করেই সারাজীবন কাটিয়ে দেয় তবে তার ক্ষেত্রে বলা হয় তিনি বিবাহের সুন্নাহটা আদায় করেছেন।
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাধারণত সুন্নাহের কাজে উৎসাহ দিতেন। অনেক ক্ষেত্রে এর ফজিলতও বর্ণনা করতেন। বহুবিবাহের জন্য তিনি উৎসাহ দিয়েছেন বা এর ফজিলত বর্ণনা করেছেন এমনটি আমরা দেখি না। বরং উপরে বলা সেই একই হাদীসে যেটা দেখতে পাই সেটা হলো, নবীজী বলেছেন,
"তোমরা অধিক সন্তানদানে সক্ষম ও স্নেহপরায়ণ নারীকে বিবাহ করো। কারণ আমি তোমাদের সংখ্যাধিক্য নিয়ে অন্যান্য উম্মতের উপর গৌরব করবো।"
তো লক্ষ্য করুন, এখানে উম্মতের সংখ্যা বেশি হওয়ার জন্য তিনি বিবাহের কথা বলতে গিয়ে অধিক সন্তানদানে সক্ষম মহিলাকে বিবাহের কথা বলছেন। একাধিক বিবাহের কথা বলছেন না। অথচ অধিক সন্তানদানে সক্ষম মহিলার চেয়ে একাধিক বিয়ে করার কথা বলাটা বেশি সন্তানলাভের জন্য অধিক সহায়ক। এর সাথে যদি অধিক সন্তানদানে সক্ষম প্লাস বহুবিবাহ দুইটার প্রতি উৎসাহ দেওয়া হতো তবে সেটা হতো অধিক উম্মত হবার পথে আরো বেশি সহায়ক। কিন্তু তিনি এই পথে হাঁটলেন না। বলে দিলেন, অধিক সন্তানদানে সক্ষম স্ত্রীকে বিবাহ করতে। মোটকথা হলো, নববী যিন্দেগী থেকে বহুবিবাহের প্রতি উৎসাহ দেওয়ার কোন নির্দেশনা আমরা পাই না। তাঁর পরে সাহাবা ও তাবেয়ীদের থেকেও পাই না। তারা নিজেরা বহুবিবাহ করেছেন অনেকে, কিন্তু এর জন্য উৎসাহীত করা ও একে ফলাওকরে প্রচার করার চিত্র আমরা দেখি না। যেহেতু এটি বৈধ বিধান তাই তাদের প্রয়োজন হলে বা ইচ্ছা হলে তা তারা করেছেন। কিন্তু এটাকে প্রসার করার আলাদা কোন পদক্ষেপ ও প্রচেষ্টা হাতে তুলে নেন নি। এখান থেকে আমাদের কর্মপদ্ধতি কী হবে তার একটা ধারণা পাওয়া যায়।
বহুবিবাহের বৈধতা বিষয়ক আয়াতকে সামনে রাখলেও দেখা যায় কুরআন এই কাজে উৎসাহ প্রদান করে নি। বরং বর্ণনাভঙ্গিটাই কেমন যেন নিরুৎসাহমূলক। আমি আয়াতটি তুলে দিচ্ছি:
"আর তোমরা যদি আশংকা করো যে, এতিম মেয়েদের প্রতি ইনসাফ করতে পারবে না তবে অন্য নারীদের মধ্য থেকে যাকে তোমাদের ভালো লাগে তাকে বিয়ে করে নাও। দুই দুই জন, তিন তিন জন, এবং চার চার জন করে। আর যদি আশঙ্কা করো যে, (তাদের মধ্যে) সুবিচার করতে পারবে না তবে এক স্ত্রী অথবা তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসী-ই যথেষ্ট। এটা তোমাদের অবিচার না করার অধিকতর নিকটবর্তী।"[৩]
তো এখানে সুবিচার করতে না পারার অবস্থায় বহুবিবাহকে নিষেধ করার কারণ হলো, গুনাহ হবার আশঙ্কা। খানবী রাহ. লিখেছেন, 'ইনসাফ বজায় রাখতে না পারার প্রবল আশঙ্কা থাকলে একাধিক বিবাহকে নিষেধ করার কারণ হলো, সেই ব্যক্তিকে (ইনসাফ না করার কারণে) গুনাহগার হতে হবে। তবে এর মানে এই নয় যে, বিবাহ সহীহ হবে না। বরং নিশ্চিতভাবে বিবাহ সহীহ হয়ে যাবে।"[৪]
আমরা জানি, উসুল হলো, প্রতিটি নিষেধাজ্ঞার পেছনে ইল্লত বা কারণ থাকে। সেই কারণটি পাওয়া গেলে হুকুমও চলে আসে। একটা উদাহরণ দেই। তাহলে সহজে বুঝবেন। নেশাগ্রস্ত হয়ে বুদ্ধি লোপ পাওয়া হলো খাবার জাতীয় জিনিস নিষিদ্ধ হবার একটা কারণ। সুতরাং এটা যেই খাবারেই পাওয়া যাক না কেন তা হারাম হবে। যদিও কুরআন-হাদীসে সরাসরি তার উল্লেখ না থাকে। তো কুরআনে মদ হারাম হবার কথা আছে। কারণ এটি বুদ্ধিকে লোপ করে। এই কারণটা ইয়াবা, ফেন্সিডিল, হিরোইন প্রভৃতি বস্তুর মধ্যেও পাওয়া যায় বিধায় সেগুলোও হারাম হবে। যদিও সেগুলোর উল্লেখ সরাসরি কুরআনে নাই।
এখন ইনসাফ রক্ষা করতে না পারার প্রবল আশঙ্কা বিদ্যমান থাকলে একাধিক বিবাহকে নিধেষ করার কারণ হিসেবে আমরা জানলাম, ব্যক্তির গুনাহগার হবার আশঙ্কা। সুতরাং যদি বহুবিবাহের কারণে তাকে ইনসাফের বাইরে আরো কোন গুনাহে জড়িত হয়ে যাবার আশঙ্কা বিদ্যমান থাকে সেখানেও বহুবিবাহ তার জন্য নিষিদ্ধ হবে। কিন্তু এরপরও যদি সে করে ফেলে তবে বিবাহ সহীহ হবে।
বহুবিবাহ সম্পূর্ণ মুবাহ বা বৈধ বিধান। কেউ যদি এটাকে নাজায়েজ বা অবৈধ মনে করে তবে তার ঈমান নিয়ে শঙ্কা আছে। যদি জেনেবুঝে এমন করে, তবে ইসলামের গণ্ডি থেকে সে বের হয়ে যাবে। কারণ এর বৈধতা সরাসরি কুরআনের স্পষ্ট নস দ্বারা প্রমাণিত।
আমাদের সমাজে বহুবিবাহকে বাঁকা চোখে দেখা হয়। এটি বৈধ এবং শরীয়ত অনুমোদিত বিষয় এটা হজম করতে অনেকের কষ্ট হয়। তো সাধারণ মানুষের এই মনোভাব দূর করার জন্য এর বৈধতার দলিল-প্রমাণ ও যৌক্তিক দিকগুলো তুলে ধরা যেতে পারে। কারো প্রয়োজন হলে তিনি নিজে বহুবিবাহও করতে পারেন। তবে ঢাকঢোল পিটিয়ে সামাজিকভাবে জনেজনে বহুবিবাহের প্রতি উৎসাহিত করাটা কোনক্রমেই উচিত নয়। এটি ভুল পন্থা। একটা ভুল বিষয়কে অপর ভুল বিষয় দিয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা শেষপর্যন্ত কোন ভালো ফলাফল বয়ে আনে না। সুতরাং যারা ভুলকে ভু্ল দিয়ে ঠিক করার পন্থাকে অবলম্বন করছেন তারা নিশ্চিত ভুল করছেন।
মজার ব্যাপার হলো, মুসলিম সমাজে বহুবিবাহকে বাঁকা চোখে দেখার ভাইরাসের আমদানি হয়েছে পশ্চিমা সমাজ থেকে। সেখানে এটাকে ভালো চোখে দেখা হয় না। অথচ এক নারীর স্থলে শতো নারীগমন আবার তাদের সমাজে তেমন নিন্দনীয় নয়। বরং সেটাকে ব্যক্তি স্বাধীনতার মোড়কে পরিয়ে হালাল ও স্বাভাবিক বিষয় হিসেবেই উপস্থাপন করা হয়। মানুষের বিবেক-বুদ্ধি পঁচে গেলে যা হয় আর কি!
সর্বশেষ এক কথায় বহুবিবাহের বিষয়ে শরীয়তের যে মনোভাব আমার সামনে পরিস্ফুট হয়েছে তা হলো, বহুবিবাহ মুবাহ বা বৈধ একটি বিষয়। ফজিলতপূর্ণ স্বতন্ত্র কোন সুন্নাহ নয়। এটি তাশকীল করে নানানভাবে উৎসাহ দেওয়ার মতো বিষয়ও নয়। তবে কোথাও যদি এই বিধানকে অজ্ঞতার কারণে অস্বীকার করা হয় বা বাঁকা চোখে দেখা হয় তবে তা আলোচনার ও বুঝানোর মাধ্যমে ঠিক করতে হবে। অজ্ঞতাকে দূর করতে হবে।
পুনশ্চ: এখানে বলা কথাগুলোকে চূড়ান্ত কিছু মনে করার দরকার নেই। আমি বিষয়টি নিয়ে পড়ে যতোটুকু বুঝেছি তা বললাম এখানে। কোন কথা নিয়ে যদি কারো আপত্তি থাকে তবে দালিলিকভাবে তা তুলে ধরলে এবং সেটা যদি সত্যিই যৌক্তিক মনে হয় আমার কাছে তবে নিজের এই মতামত থেকে সরে আসবো আমি ইনশাআল্লাহ।
তথ্যসূত্র:
[১] তাফসীরে ইবনু কাসীর: ১/৫৫৪
[২] ইবনে মাজাহ:১৮৪৬, হাদীসটি সহীহ।
[৩] সূরা নিসা: ৩
[৪] বায়ানুল কুরআন ১/৩১৭

No comments

Note: Only a member of this blog may post a comment.

Powered by Blogger.