তিন তালাক ও হিল্লা বিবাহ.

তিন তালাক ও হিল্লা বিবাহ.
লিখেছেনঃ SK sadhin=========================

আল্লাহ পাকের কাছে ‘সবচেয়ে অপ্রিয় কিন্তু অনুমোদিত’ কাজ হল তালাকের মাধ্যমে একটা সংসার ভেঙ্গে দেয়া। আল্লাহ তা’য়ালা চাইলেই উম্মতের জন্য এই কাজটা হারাম ঘোষণা করতে পারতেন। আর যদি তাই করা হতো তা হলে সমাজের অবস্থা যে কি হতো তা সহজেই অনুমেয়। বস্তুতপক্ষে মানুষের জটিল এই সমাজবদ্ধ জীবনে বিবিধ কারণে ও প্রয়োজনে বিয়ে করার মত বিয়ের বাঁধন থেকে মুক্ত হওয়ারও দরকার হবে বিধায় কোরআন ও হাদিসে খুব সহজ ভাবে বাতলে দেয়া হয়েছে বিবাহ বিচ্ছেদের বিবিধ পদ্ধতি। এটা যে কোন বিচারে মানব জাতির জন্যে আল্লাহ পকের খুব বড়সড় একটা অনুগ্রহ বৈ কিছু নয়।

কিন্তু মানুষ খুব কমই মনে রাখে তাদের প্রতি আল্লাহ ও তাঁর রসূল (সা:)-এর অপার স্নেহ, ভালবাসা আর অনুগ্রহের কথা। তাই নিজের সীমাহীন অজ্ঞতার কারণে সে অহরহ অপব্যবহার করে থাকে আল্লাহর দেয়া নেয়ামত ও অনুগ্রহ সমূহ। দায়িত্বজ্ঞানহীন ভাবে যুক্তিযুক্ত প্রকৃত কোন কারণ ছাড়াই যখন তখন, অযথা এবং যেনতেন কারণে ‘তালাক’-এর ক্ষমতা ব্যবহার করে একটা ঘর ভেঙ্গে ফেলা তেমনই একটা নিদারুণ অকৃতজ্ঞতা। এটা খুব বেশী সত্য ‘তিন তালাকের’ ক্ষেত্রে। যেহেতু ‘তিন তালাকের’ তাৎক্ষনিক বিবাহ বিচ্ছেদ ক্ষমতাটা শুধুমাত্র স্বামীদের হাতে দেয়া হয়েছে তাই অন্য যে কোন তালাকের চাইতে এই ‘তালাকের’ অপব্যবহারই হয়ে থাকে সবচেয়ে বেশী। অথচ আল্লাহ পাক প্রবর্তিত মানুষের বিয়ে এবং বিচ্ছেদের আইনগুলো একটু গভীর ভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে ‘তিন তালাকে’র যে কোন ধরণের অপপ্রয়োগ আসলে আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতার চরম অপব্যবহারের শামিল। আর তাই সেটা আল্লাহর সাথে এক প্রকারের বেঈমানি এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূল (সা:)-এর সাথে এক ধরণের বেয়াদবিও বটে।

উল্লেখ্য, যে কোন বিবেচনাতেই নারী-পুরুষের বিয়ে কোন ছেলেখেলার বিষয় নয়। পবিত্র এই বন্ধনে শুধুমাত্র দুটি সত্ত্বাই জড়িত হয় না, সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয় অনেকগুলো পরিবারের মাঝে বন্ধন। ফলে বৃদ্ধি পায় সুস্থ সামাজিক পরিসর। তাই জগত ও জীবনের যাবতীয় অভাব-অনটন, টানাপোড়ন, খুনসুটি উপেক্ষা করে আমৃত্যু টেকসই হবে এই সম্পর্ক সেটাই কাম্য ও প্রার্থিত। আর বস্তুত: সেজন্যেই ‘তিন তালাকের’ তাৎক্ষনিক বিচ্ছেদ ক্ষমতাটা শুধুমাত্র স্বামীদের হাতে দিয়ে আল্লাহ পাক এর অপব্যবহারের সম্ভাবনা প্রথমেই কমিয়ে দিয়েছেন পঞ্চাশ ভাগ (২:২২৯) এই আয়াতের ব্যাখ্যা এবং সহি বোখারী শরীফের এ সংক্রান্ত হাদিস সমূহ দ্রষ্টব্য)। শুধুমাত্র পুরুষদেরকে দেয়া এই ক্ষমতাটা এই জগতকে সুষ্ঠু ভাবে পরিচালনার প্রয়োজনে একের দ্বারা অন্যকে নিয়ন্ত্রণে রাখার আল্লাহ পাক অনুসৃত সার্বজনীন কর্মপন্থারই অংশ বিশেষ (২:২৫১)।
আবার যেহেতু সংসারে স্ত্রীর উপরে স্বামী দায়িত্বশীল (২:২২৮)। তাই তালাকের মত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বামীরা চরম ধৈর্য ও দায়িত্ববোধের পরিচয় দেবে সেটা স্বাভাবিক ভাবেই কাম্য। আর তাই ‘তিন তালাকের’ ক্ষমতা শুধুমাত্র স্বামীদের হাতে দেয়াটা যে কোন সৃষ্টিকে চূড়ান্ত ক্ষণ পর্যন্ত সময় দেয়া বিষয়ে আল্লাহ পাকের নির্ধারিত সুনির্দিষ্ট নীতিমালার সাথেও অতি সংগতিপূর্ণ (৬:৬৭; ২৯:৫৩)।
এই ক্ষমতা যদি সমান ভাবে স্বামী-স্ত্রী দুই পক্ষেরই থাকতো তাহলে ঘর ভাঙ্গা-গড়া ছাড়া মানুষের পক্ষে বোধহয় অন্য আর কিছুই করা সম্ভব হতো না। যা এখন হচ্ছে পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে। অতিমাত্রায় শিক্ষিত ও পরিশীলিত জাতি হওয়ার পরও এই সব দেশে আস্ত একটা ঘর খুঁজে পাওয়া রীতিমত দুরূহ কাজ। এসব দেশে এখনও যে সব সংসার টিকে আছে সেগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে সেসব টিকে আছে মূলত: সহায়, সম্পদ আর অর্থকড়ির হাতিয়ে নেয়ার সবচেয়ে লাভজনক সময় সুযোগের অন্বেষণে। সেখানে সাংসারিক সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের অপার্থিব বোধ, অনুভূতি ও বন্ধন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত। আর এই কারণেই এসব দেশের ছেলে-মেয়েরা লিখিত বিয়ের চাইতে দলিল বিহীন গার্লফ্রেণ্ড-বয়ফ্রেণ্ড কালচারেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে বেশী।
আল্লাহর আইন দ্বারা কঠিন ভাবে নিয়ন্ত্রিত হওয়ার পরও তালাকের এই ক্ষমতা যে কোন সমাজে জন্য হতে পারে অস্বস্তি ও অস্থিরতার উপসর্গ। এই ক্ষমতার অহেতুক ভাবাবেগ সর্বস্ব ব্যবহার সৃষ্টি করতে পারে অযথা সামাজিক বিশৃঙ্খলা। কারণ একটা তালাকের পরিণতি কোন ব্যক্তি একা ভোগ করে না। এর সাথে জড়িত থাকে অন্তত আরও একটা জীবন। আরও একটা পরিবার। কখনও কখনও কয়েকটা পরিবার। এটা আবার অতিমাত্রায় এবং অতি নিষ্ঠুর ভাবে সত্য ‘তিন তালাকে’র তাৎক্ষণিক বিবাহ বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে। তাই বস্তুতপক্ষে কারো মধ্যে আল্লাহ পাকের প্রতি অকৃতজ্ঞতা বোধ প্রবল হলেই শুধুমাত্র এই ক্ষমতার অপব্যবহার করা সম্ভব।
এই ধরণের দায়িত্বজ্ঞানহীন অকৃতজ্ঞতার কাজ থেকে মানুষকে যতদূর সম্ভব দূরে থাকতে বাধ্য করার অতি বাস্তবসম্মত উপায় হল তিন তালাকের পড় স্ত্রী হারাম হওয়া এবং অন্য কারও সাথে বিয়ে হয়ে সেখানে যদি তালাক হয় তবেই পূর্বের স্বামী পূনরায় সেই স্ত্রীকে বিয়ে করতে পারবে এই শর্তের ব্যতিক্রমধর্মী টনিক। এটা যেমন অধৈর্য হয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করার শাস্তি তেমনি অসুখ যাতে আদতেই না হতে পারে তারও অসুখ-পূর্ব যথার্থ প্রতিরোধ ব্যবস্থা। প্রকৃত প্রস্তাবে ধৈর্য, সহ্য ও ক্ষমার নির্দেশিত পথে সংসার টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা-তদবির না করেই যারা কাণ্ডজ্ঞানহীন ভাবে প্রয়োগ করবে আল্লাহ পাকের অপ্রিয় তালাকের আইন তাদের পুনর্মিলনের পথে এমন আইন হল কুইনাইন স্বরূপ। এসব অধৈর্য-অকৃতজ্ঞ দম্পতির দুরবস্থা থেকে শিক্ষা নিয়ে সমাজের অন্য দম্পতিরা সংসার জীবনে ধৈর্যশীল হবে এবং ব্যক্তিগত ছোটখাটো স্বার্থগুলোকে উপেক্ষা করে পবিত্র বৈবাহিক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখাতে সদা সচেষ্ট থাকবে এটাই বোধকরি সুকঠিন এই বিধান প্রবর্তনের পেছনে আল্লাহ পাকের প্রধান উদ্দেশ্য।
নির্যাতিত নারীর মুক্তি উপায় ও সংসারে ধৈর্য হারানোর শাস্তি।
ঘর-সংসার বেঁধে সমাজে বসবাস করার পরও নিভৃত গৃহ কোণে কূল বধূ আসলে কেমন আছে তা বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই রয়ে যায় অজ্ঞাত। স্বামী যদি হয় নিতান্তই অর্বাচীন। স্বামী হিসেবে নিজের দায়-দায়িত্ব সম্বন্ধে তার যদি কোন বোধই না থাকে। স্ত্রীকে যদি অহর্নিশি থাকতে হয় সংসার ভাঙ্গার হুমকির মুখে। আর সেসব তথ্য যদি থেকে যায় অগোচরে তা হলে কি হবে সেই গৃহবধূর মুক্তির উপায়? মূলত: এহেন স্বামীদের দ্বারাই ঘটে থাকে ‘তিন তালাকের’ যত কুকীর্তি। আর সেটাই হল ঐ নির্যাতিতার মুক্তি লাভের মোক্ষম উপায় ও মাহেন্দ্রক্ষণ। অর্থাৎ দায়িত্বজ্ঞানহীন স্বামীর স্বেচ্ছাচারিতা এবং জুলুমের কবল থেকে নির্যাতিতা স্ত্রীকে অত্যন্ত কার্যকর ভাবে মুক্ত করতে পারে এই অভাবনীয় আইন (২:২৩০)। এটা ‘তিন তালাকের’ ক্ষেত্রে বেশী দৃশ্যমান হয়।
অনেকে মনে নমে করে ইসলাম হিল্লাহ বিয়ের অনুমতি দেয়। অথছ ইসলাম হিল্লা বিয়ের অনুমতি দেয়নি। আল্লাহ যে সিস্টেমের কথা বলেছেন তা কিন্তু হিল্লাহ বিয়ের নয় বরং স্বাভাবিক ভাবে যদি তালাক প্রাপ্ত নারী অন্য কাউকে বিয়ে করে সেখানেও তালাক প্রাপ্ত হয় তখন ই পূর্বের স্বামি সেই স্ত্রীকে বিয়ে করতে পারবে। এমন কোন শর্তে নয় যে বিয়ে করে একদিন পড়েই তালাক দেয়া হবে। হিল্লাহ বিয়ের অনুমতি ইসলাম দেয় না।
যখন কোন ব্যক্তি এ নারীকে তালাক দেয়ার নিয়তে বিয়ে করে, যেন সে তার পূর্বের স্বামীর জন্য হালাল হয়, তখন এ বিয়ে হারাম ও বাতিল বলে গন্য।
ইমাম আহমদ ইব্ন হাম্বল রাহিমাহুল্লাহ বর্ণনা করেন :
ﻋَﻦْ ﺃَﺑِﻲ ﻫُﺮَﻳْﺮَﺓَ، ﻗَﺎﻝ : ” ﻟَﻌَﻦَ َﺭﺳﻮﻝُ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﺍﻟْﻤُﺤِﻞَّ ﻭَﺍﻟْﻤُﺤَﻠَّﻞَ ﻟَﻪُ “
আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিল্লাকারী ও যার জন্য হিল্লা করা হয় উভয়কে লানত করেছেন”। আহমদ : (২/৩২৩),
এ হাদিসটি ইমাম বুখারি হাসান বলেছেন। তার সূত্রে হাফেজ ইব্ন হাজার তার “তালখিস” (৩/৩৭৩) গ্রন্থে ইমাম বুখারির এ মন্তব্য উল্লেখ করেন।
ইমাম হাকেম রহ. ও ইমাম তাবরানি রহ. তার ‘আওসাত’ গ্রন্থে ওমর ইব্ন নাফে থেকে বর্ণনা করেন, সে তার পিতা নাফে সূত্রে বলেন :
জনৈক ব্যক্তি আব্দুল্লাহ ইব্ন ওমর রাদিআল্লাহু আনহুর নিকট আগমন করে এক ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, যে তার স্ত্রীকে তিন তালাক দিয়েছে, অতঃপর তার এক ভাই কোন পরামর্শ ছাড়াই তালাক প্রাপ্তা নারীকে বিয়ে করে তার ভাইয়ের জন্য হালাল করার নিয়তে, এভাবে কি প্রথম স্বামীর জন্য স্ত্রী হালাল হবে ? তিনি বললেন : না, পছন্দ ও আগ্রহের বিয়ে ব্যতীত হালাল হবে না, আমরা এটাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে যেনা বিবেচনা করতাম। আল-মুসতাদরাক লিল হাকেম : হাদিস নং : (২৭৩১)

No comments

Note: Only a member of this blog may post a comment.

Powered by Blogger.